দেশ বিদেশ
যশোরে ভেঙে পড়েছে কৃষিজাত পণ্যের সাপ্লাই চেইন
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর থেকে
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার
কৃষিনির্ভর যশোরের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। যশোরের ফুল, শাক-সবজি, মাছ, পোল্ট্রি খাতের বেহাল দশা। চলমান কারফিউ এর কারণে সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে বিপাকে পড়েছেন এই অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক, মুটে-মজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। বাজার জাতের অভাবে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে ফসল। সময়মতো কষ্টার্জিত ফসল বিক্রি করতে না পারায় তাদের মাথায় হাত উঠেছে। অন্যদিকে সরবরাহের অপ্রতুলতার দোহাই দিয়ে বাজারে কৃষিজাত এসব পণ্যের দাম হাঁকাচ্ছে আকাশ ছোঁয়া।
গত এক সপ্তাহের কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ও তা দমনে দেশব্যাপী সরকারের পক্ষ থেকে কারফিউ জারির ফলে যশোরাঞ্চলের কৃষিজাত পণ্যের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। সড়ক পথে সব রকমের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এসব কৃষিজাত পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, যশোর দেশের অন্যতম সবজি উৎপাদনকারী অঞ্চল। এখানকার উৎপাদিত সবজি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা শহরে সরবরাহ হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি শত শত ট্রাক শাক-সবজি যশোরাঞ্চলের হাটবাজার ও গ্রাম থেকে লোড হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। কিন্তু চলমান ছাত্র আন্দোলন ও পরবর্তীতে দেশব্যাপী কারফিউ দেয়ার ফলে গত ১ সপ্তাহ ধরে এই অঞ্চলের কৃষিজাত পণ্যের সরবরাহ কার্যক্রমে ধস নামে। যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, যশোরের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর।
এই জেলায় ৮০ শতাংশ মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এই জেলা কৃষি উৎপাদনে সারপ্লাস। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই জেলার কৃষকরা প্রতি বছর কয়েকশ’ কোটি টাকার কৃষিপণ্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ করে। বিশেষ করে মাছ, শাক-সবজি, খেজুরগুড়, ফুল, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, মুরগি ও ডিম উল্লেখযোগ্য। যশোরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের পোল্ট্রি ও চামড়া এবং পাটজাত শিল্প কল কারখানা। বিশেষ করে আফিল পোল্ট্রি ও আফিল এ্যাগ্রো, আফিল ফিস, এসকেএফ, চাঁদ পোল্ট্রি, আকিজ জুট মিল, আফনান জুটমিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু টানা আন্দোলন ও চলমান কারফিউ’র কারণে এসব প্রতিষ্ঠানকে কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, যশোরের মাৎস সেক্টরের সুনাম দেশজুড়ে। এখানে রয়েছে শতাধিক বিশ্বমানের রেণু পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি। এসব হ্যাচারিতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কার্ফু, শিং, মাগুরসহ শত শত প্রজাতির দেশি-বিদেশি মাছের ডিম থেকে রেণু পোনার উৎপাদন হয়। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর প্রতি বছর যশোরের হ্যাচারি মালিকরা ২/৩শ’ কোটি টাকার রেণু পোনা দেশে ও বিদেশে বিশেষ করে ভারতে রপ্তানি করে।
একইসঙ্গে যশোরের মৎস্যচাষিরা দেশের মাছের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে বড় রকমের ভূমিকা পালন করছেন। এই জেলার চাষিরা বছরে কমপক্ষে ১ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদন করে থাকে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি করা হয়। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে এসব কৃষিজাত পণ্যের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ার কারণে কৃষকরা কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
একই অবস্থা দেশের ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালীর ফুলচাষিদের। গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহেরর কারণে এখানকার ফুলচাষিরা কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, গড়ে প্রতিদিন গদখালীর বাজারে ৩০/৪০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনা পরিক্রমায় ফুল বিক্রি জিরোতে নেমেছে। কৃষকের ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে রজনীগন্ধা, গ্লাডিউলাস, গোলাপ, জারবেরাসহ হরেক রকমের ফুল।
এ বিষয়ে যশোর ফুল ব্যবসায়ী ও উৎপাদক সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, গদখালীর কৃষকরা বছরে প্রায় ৭শ’ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন করে। কিন্তু উৎপাদিত এই ফুল বাজারজাত না করতে পারলে তার কোনো মূল্য নেই। বাসি ফুলের কোনো কদর নেই। ফুল যত টাটকা হবে দাম তার তত বেশি। কিন্তু গত কয়েকদিনের ছাত্র আন্দোলন এবং তারপর এই লাগাতার কারফিউ’র কারণে যশোরাঞ্চলের চাষিরা তাদের ফুল রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতে পারছেন না। কোটি কোটি টাকার ফুল কৃষকের ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে।
গদখালীর পানিসারা গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, এ বছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে রজণীগন্ধা, বিভিন্ন জাতের গোলাপ, জারবেরা ও গাঁদাফুলের চাষ করেছেন। এ বছর রেকর্ড তাপমাত্রার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও ক্ষেতে যে পরিমাণ ফুল ছিল তা সঠিকভাবে বাজার জাতের ব্যবস্থা থাকলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে আমরা বাজারে যেতে পারছি না। ক্ষেত থেকে ফুল সংগ্রহ করতে পারছি না। তিনি বলেন, যশোরের ঝিকরগাছা, কেশবপুর, শার্শা সাতক্ষীরার কলারোয়াসহ এই অঞ্চলের ৪০/৫০ গ্রামের প্রায় ২ লাখ কৃষক-কৃষাণী এই ফুল চাষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ফুলের চাষই হচ্ছে এই অঞ্চলের মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফুল হচ্ছে এসব চাষিদের প্রধান অর্থকরী ফসল।