দেশ বিদেশ
খুলনায় ইউপি চেয়ারম্যান হত্যা
সেই ‘ভূমিদস্যু’ আওয়ামী লীগ নেতা আটক
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে
৯ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
আটক আওয়ামী লীগ নেতা তারা বিশ্বাস
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম রবি হত্যা মামলায় আলোচিত ভূমিদস্যু ও আওয়ামী লীগ নেতা আজগর বিশ্বাস তারাকে আটক করেছে পুলিশ। এসময়ে তার অফিস কক্ষ তল্লাশি করে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে আজগর বিশ্বাস তারাকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এদিকে শেখ রবিউল ইসলাম রবি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ডুমুরিয়া ও ফুলতলার বেশ কয়েকজন সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের উপর নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ।
নিহত চেয়ারম্যানের ভাগ্নে সাইফুর রহমান রাজু ও চাচাতো ভাই মোতাহার শেখ অভিযোগ করে বলেন, রবির কাছে পরাজিত ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী শরাফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল্লাহ হাওলাদার, আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত পরাজিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেন এবং ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত আজগর আলী বিশ্বাস এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তাদেরকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে।
ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত সাহা জানান, সোমবার রাতে নিহত ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম রবির স্ত্রী শায়লা ইরিন বাদী হয়ে স্বামী হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৫/৬ জনের নাম উল্লেখ করে আরো অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।
এদিকে সোমবার বেলা ১২টার দিকে জেলা ডিবি পুলিশের একটি টিম রায়েরমহলস্থ বিশ্বাস প্রোপার্টিজে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক ও খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আজগর বিশ্বাস তারা আটক করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। পরে ডুমুরিয়া থানা পুলিশ বেলা সাড়ে ১২টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত দুই ঘন্টা ওই প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালিয়ে ৫৭ রাউন্ড গুলি, ৯টি গুলির খোসা, একটি শটগান, একটি খেলনা পিস্তল, একটি রিভলবার সদৃশ্য লাইটার উদ্ধার করে। এসব অস্ত্র উদ্ধার ঘটনায় তারা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা হবে বলে জানান ওসি। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্দারে তারা বিশ্বাস নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করেছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শরাফপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম রবি হত্যাকান্ডে কয়েকজন রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিদের নাম প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের পর বলা যাবে।
খুলনা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বলেন, হত্যা সম্পর্কিত কোন তথ্য আমার জানা নেই। তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। পরে জানানো হবে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে উপজেলার গুটুদিয়া ওয়াপদার মোড় এলাকায় শেখ রবিউল ইসলাম রবি হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। রবি ভূমিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। মন্ত্রীর কর্মসূচি থেকে ফেরার পথেই তিনি খুন হন।
উল্লেখ্য, খুলনা আলোচিত ভূমি দস্যু তারা বিশ্বাস বিশ্বাসের হত্যা, হামলা, নির্যাতন, সরকারি খাল, জলাধার, হতদরিদ্র মানুষের জমি দখল নিয়ে গত ৪ঠা এপ্রিল দৈনিক মানবজমিনে ‘খুলনার আতঙ্ক তারা ও তারেক’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশের পরে প্রসাশনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। খুলনা জুড়ে আলোচনায় আসে ভূমি দস্যু আওয়ামী লীগ নেতা তারা বিশ্বাস।
কে এই তারা বিশ্বাস: বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, খুলনা মহানগরীর রায়ের মহল হামিদনগর এলাকার বাসিন্দা হারেজ বিশ্বাসের ছেলে আজগর আলী বিশ্বাস তারা। হারেজ বিশ্বাস ছিলেন একজন ফড়িয়া। গ্রাম থেকে ধান সংগ্রহ করে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তারা তার ছোট ভাই তারেক বয়রা, মুজগুন্নী আবাসিক এলাকায় বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করতেন। স্থানীয় পিএমজি স্কুল ও রায়ের মহল স্কুলে লেখাপড়া করার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তারা। সরকারি বিএল কলেজে পড়ার সময় তিনি শিবিরের শীর্ষ নেতাদের নজরে আসেন। যে কারণে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতাদের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা- ৫ আসনে জামায়াত নেতার পক্ষ হয়ে প্রচার-প্রচারণা করেন বলে স্থানীয়রা জানান। ওই সময় একটি জীবন বীমা কোম্পানির মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। একই সময় হামিদনগর এলাকায় উদয়ন সমবায় সমিতি নামে একটি সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি গঠন করে সভাপতি হন। অভিযোগ রয়েছে ওই সমিতির সদস্যদের সঞ্চয়ের ৪ লাখ টাকা ও বীমা কোম্পানির গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে খুলনা থেকে লাপাত্তা হন। জোট সরকারের বিদায়কালে তিনি ঢাকায় গিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আজগর আলী তারা খুলনা ফিরে এসে জমির দালালি শুরু করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে জমির দালাল থেকে পর্যায়ক্রমে আবাসন ব্যবসায়ীতে পরিণত হন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার আশীর্বাদে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লুফে নেন জেলা কমিটির সদস্যপদ। আলোচনায় চলে আসতে শুরু করেন অভিনব প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে।
যশোর থেকে শুরু করে খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ মহাসড়কের দুপাশে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীর ছবির সঙ্গে নিজের ছবি লাগিয়ে বড় বড় বিলবোর্ড লাগিয়েছেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একজন ডোনার হিসেবে পরিচিত।
এলাকাবাসীর অভিমত তারা বিশ্বাসের ছাত্র রাজনীতি যাদের হাতে তাদের কথা ভুলতে পারেনি। সে এখনো জামায়াত ইসলামীর একজন বড়ো মাপের ডোনার। বিগত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে হামিদনগরের একটি স্কুলের পাশে সৈয়দপুর ট্রাস্টের জমিতে বিশ্বাস প্রোপার্টিজের সাইন বোর্ড লাগিয়ে দখল করেন। ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিছুর রহমান বিশ্বাস দখলদার উচ্ছেদ করতে গেলে তারা বিশ্বাস প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হুংকার দিয়ে আলোচনায় আসেন। ক্যাডার হিসেবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। শুধু এখানেই শেষ নয়, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে দলীয় মনোনয়ন বোর্ডে সাক্ষাৎকার দিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন।
বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শতকোটি টাকা খরচ করে প্রচার প্রচারণায় সবার শীর্ষে থেকেও ভোট পেয়েছে তিন প্রাথীর মধ্যে সবচেয়ে কম। ভোটের মাঠে অনেকটা নাজেহাল হতে হয়েছে এই ধনকুবের। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ভূমি মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের একসময় কাছে লোক ছিলেন তারা বিশ্বাস। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রার্থী হওয়ার কারণে অনেকটা বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।
বহুরূপী তারি নিজেকে কখনো সাংবাদিক, কখনো মানবাধিকার নেতা, শিক্ষানুরাগী দাবি করেন। তবে তার একটি ভিজিটিং কার্ডে দেখা যায় থানা পুলিশিং ফোরামের সভাপতি, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক, খুলনা চেম্বার কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সদস্য। খুলনার অভিজাত খুলনা ক্লাবের সদস্য।