ঢাকা, ১৯ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ওয়েবিনার

তিস্তার পানি বণ্টনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি

স্টাফ রিপোর্টার
২৪ জুন ২০২৪, সোমবার

পানির ন্যায্য বণ্টনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির বিষয়ে শুধু কারিগরি বা কূটনৈতিক আলোচনা করে সুফল মিলবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এসব ক্ষেত্রে কূটনীতিক দিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা নেই। প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ভারতের সঙ্গে ১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৯৬ সালের যে চুক্তিগুলো হয়েছে সবগুলোই রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে। গতকাল ‘বাংলাদেশ-ভারত পানি বণ্টন অভিজ্ঞতা, আশঙ্কা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, বাংলাদেশ ভারতের ওপর যত নির্ভরশীল হবে দরকষাকষি শক্তি তত কমবে। ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হলে দরকষাকষি করা যায় না। বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি করতে মারাত্মকভাবে ফেল করেছে। পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে ভারতকে ট্রানজিটসহ যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কারণ পানির বিষয়টা হেলাফেলার বিষয় না। এটা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিষয়। পানিটা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন- এভাবেই এটাকে বিবেচনা করা দরকার। সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে মূল বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত, কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. খালেকুজ্জামান, ওয়াটার্সকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল। সমাপনী বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ। প্রফেসর আফিস নজরুল তার বক্তব্যে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার কারণেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। ভারতের সংবিধান দেখলে দেখতে পাবেন যে, আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পূর্ণভাবে ফেডারেল সরকারের আওতাভুক্ত। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তি থাকলে ভারত সরকার চুক্তি করতে পারবে না এটা যদি কেউ মনে করি তাহলে আমি বলবো আমাদের ফেডারেল গভর্নমেন্ট সম্পর্কে ধারণার অভাব আছে। এমন হলে তো ফেডারেল সরকার কোনো কাজই করতে পারবে না। মূলত চুক্তিটা হচ্ছে না ভারত সরকারের কারণে, কোনো রাজ্যের সরকারের জন্য না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৫৪ অভিন্ন নদী রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র একটি নদীর ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে পূর্ণ চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য নদী নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। এমনকি তিস্তা নিয়ে ১৯৮৪ সালের আগ থেকে আলোচনা চলছে কিন্তু আজ পর্যন্ত হয়নি। ২০১১ সালে একটা চুক্তি হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু হয়নি। সেখানে কমন একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জন্য হয়নি। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় মিটিংগুলো দেখলে দেখা যাবে কোনো মিটিংয়েরই মূল এজেন্ডাতে তিস্তার বিষয় দেখতে পাওয়া যায় না। সাইড টক হিসেবে বা অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন আলোচনায় মাঝে মাঝে আশ্বাস দেয়া হয় কিন্তু এজেন্ডাতে থাকে না। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ভারতের নদী চুক্তি বা নদী ভাগাভাগির ভিত্তিটা কী? প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত বলেন, তিস্তার ক্ষেত্রে গতকাল (শনিবার) যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতে আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত। সেখানে বলা হয়েছে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের পানি ব্যবস্থাপনা ও পানি সংরক্ষণে দুই দেশের কারিগরি দল কথাবার্তা বলবে। বাংলাদেশে হিলট্রাক্স ছাড়া সংরক্ষণের জায়গা নেই। বলা হচ্ছে আমরা ড্রেজিং করলে সমাধান হবে। কিন্তু ড্রেজিং করলে তো পানি উৎপাদন হবে না। কাজেই ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তিটা এন্টেরিয়াম হলেও করে নিতে হবে। একইসঙ্গে এটি যেন সময়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকে। আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে ১৯৭৭ সালে। ওই চুক্তিটায় আমরা আমাদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। তার আগে ১৯৭৪ সালের ১৮ই এপ্রিল নিজেরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। আবার ১৯৯৬ সালের গঙ্গাচুক্তিটাও আমরা ৩০ বছরের জন্য করেছি। যদিও সেটিতে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। তাই নতুন করে গঙ্গা চুক্তিতে যেন সেই সময়ের বাধা না থাকে। 
তিনি বলেন, পানির ন্যায্য বণ্টনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির বিষয়ে শুধু কারিগরি বা কূটনৈতিক আলোচনা করে সুফল মিলবে না। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। তিনি বলেন, কূটনীতিক দিক গুরুত্বপূর্ণ। তারা দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। বিভিন্ন তথ্যের আদান-প্রদান করে। তাদের তথ্য তৈরি করার ক্ষমতা নেই। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় কথা এ সিদ্ধান্ত হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। ১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৯৬ সালের যে চুক্তিগুলো হয়েছে সবগুলোই রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে। এখন আমাদের পলিটিক্যাল এপ্রোচের ক্ষেত্র তৈরি করে দেবেন কারিগরি বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেক্ষেত্রে তারাতো খোলাখুলি কথা বলতে পারেন না। আইনুন নিশাত বলেন, এর সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক রয়েছে। আমি যদি পানি সংরক্ষণের জন্য বর্ষার অতিরিক্ত পানি জলাধারে ধরে রাখতে চাই তাহলে সেখানে পরিবেশ ও সামাজিক সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেটাকে বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্বল ডিপার্টমেন্ট হচ্ছে পানি মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের কোনো কথাবার্তা শুনিই না। তারা সবসময় ঝুঁকিতে থাকেন এ বুঝি কোনো একটা ভুল হয়ে গেল। তাদেরকে বকাবুকি করা হবে। প্রফেসর আইনুন নিশাত আরও বলেন, নদীর অনেকগুলো ব্যবহার আমরা ইগনোর করি। ভারত নেভিকেশনে যতটা আগ্রহী আমরা ততটা আগ্রহী না। কালকের দুই দেশের আলোচনাতে দেখলাম যে, ভারত বাংলাদেশের রেললাইন ব্যবহার করতে চায়। আপত্তি নেই যদি উইন উইন সিস্যুয়েশন হয়। এ ধরনের আন্তর্জাতিক রুট অনেক আছে। কিন্তু দুই পক্ষের স্বার্থ থাকতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের ওপর যত নির্ভরশীলতা তৈরি হবে দরকষাকষির শক্তি তত কমবে। তাই নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ড. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, পানিকে আমাদের ডিপ্লোম্যাসির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি ন্যায্য পানি না পাই, তাহলে ট্রানজিটসহ ভারতকে যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে- সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে। প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট না থাকায় পানির ন্যায্যতা নিয়ে সোচ্চার নয় সরকার। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য চীন, ভুটান ও নেপালের মতো তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কাছে পানির বিষয়টা হেলাফেলার বিষয় না। এটা আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। পানিটা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন- এভাবেই এটাকে বিবেচনা করা দরকার। 
 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status