অর্থ-বাণিজ্য
প্রস্তাবিত বাজেটে কর অব্যাহতির সুবিধা রহিত করায় শঙ্কায় হাই-টেক পার্ক
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
(৫ মাস আগে) ১৩ জুন ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ২:৫২ অপরাহ্ন
নীতি সহায়তার ফাঁদে পড়ে ঝুঁকিতে পড়েছে বেসরকারি হাই-টেক পার্ক অনুমোদনপ্রাপ্ত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলো। কর অব্যাহতির নীতিসুবিধা পাওয়ায় ইতিমধ্যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তারা। কিন্তু চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি হাই-টেক পার্ক অনুমোদনপ্রাপ্ত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর অব্যাহতির সুবিধা রহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা ইলেকট্রনিক্স, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যারসহ বিভিন্ন হাই-টেক পণ্য ও সেবা খাতের ভবিষ্যতকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।
গত ২৯শে মে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক জারিকৃত আয়কর প্রজ্ঞাপন (এসআরও নং-১৫৮ ও ১৬০) অনুযায়ী বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত পুরাতন কোম্পানির জন্য প্রদেয় কর হার দাঁড়িয়েছে ২৭.৫ শতাংশ। এ খাতের যেকোনো নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য যা মাত্র ৫ শতাংশ। আর সরকারি হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সম্পূর্ণ কর অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে।
হঠাৎ করে বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর অব্যাহতির সুবিধা রহিত করাকে এ খাতের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে এই খাতের বিশাল বিনিয়োগ ও বিপুল কর্মসংস্থান। তাদের মতে, এটা গাছে উঠিয়ে টান দিয়ে মই সরিয়ে নেয়ার মতো।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, এটি নীতি ও কর বৈষম্য। একটি সেক্টর মাথা তুলে দাঁড়াতে সময় লাগে। যারা এই সেক্টরকে টিকিয়ে রাখলো, পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর অব্যাহতির সুবিধা রহিত করার মাধ্যমে তাদের অনুৎসাহিত করা হলো। অবশ্যই এর প্রভাব বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পড়বে, এমনকি পরোক্ষভাবে অন্যান সকল খাতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগেও এর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, এ সেক্টরের আরও বিকাশে নীতিসহায়তা খুব জরুরি, যাতে তারা আরো ভালো করতে পারে। একটি সেক্টরকে সরকার চাইলে শক্তিশালী ও বাইরের বিনিয়োগ আনার মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। কয়েক বছরের ব্যবধানে নীতির পরিবর্তন হলে সেই বিষয়গুলো বাধাগ্রস্থ হয়। নীতি সহয়তা আয়কর সংক্রান্ত নতুন এই বিধি পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে, এবং পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজনও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর অব্যাহতিসহ নানান নীতিসহায়তা দেয়ার ফলে গত এক দশকে হাই-টেক শিল্পখাতে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। এই খাতে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। দেশেই গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিকমানের অত্যাধুনিক বিশাল কারখানা। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি। হাই-টেক খাতকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক ইকো-সিস্টেম।
এর ফলে এক সময়ের পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর খাতটি সম্পূর্ণ উৎপাদন নির্ভর ও রপ্তানিমুখী হয়ে উঠেছে। স্থানীয় উৎপাদনকৃত পণ্য ও সেবা দিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও শুরু হয়েছে। যা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এমন সময়ে কর অব্যাহতিসহ বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া সুবিধা রহিত করলে দেশ আবার উৎপাদন নির্ভরতা থেকে আমদানি নির্ভরতায় চলে যেতে পারে। কারণ এর ফলে বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত পুরাতন বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইলেকট্রনিক্স খাত। কারণ এই খাতে দেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৮০% হয়েছে বেসরকারি হাই-টেক পার্কে। পাশাপাশি এখাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, হাই-টেক পার্কে দুই ধরনের করহার বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বৈষম্যের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতিতে প্রভাব পড়বে। নতুন-পুরাতন সবার জন্য কর হার যেন যুক্তিসংগত হয়, সেটা দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, একটি দেশের রিজার্ভ, ট্যাক্স পলিসি দেখেই সেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন। দীর্ঘমেয়াদী নীতি সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে সরকার বিনিয়োগকারীদের একটা প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিল্পোদ্যাক্তারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের ঝুঁকি নেন। কিন্তু সরকার যদি হঠাৎ করে নীতি সহায়তা দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তবে ভবিষ্যতে সরকারের ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদী নীতি সহায়তার প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবেন না। এরকম চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে কেউ আগ্রহী হবে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিনিয়োগ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের একটি বড় অংশ এসেছে ব্যাংক থেকে। হঠাৎ করে কর অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করলে ব্যাংকগুলো রুগ্ন হয়ে পড়বে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার শ্রমিক ছাটাই করতে বাধ্য হবে। যা দেশের শ্রমবাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি হাই-টেক পার্ক তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর অব্যাহতির সুবিধা রহিত করা হলেও সরকারি হাই-টেক পার্কের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শতভাগ কর অব্যাহতির সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে বৃহৎ বিনিয়োগকৃত বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। অসম প্রতিযোগিতায় ফেলে দেয়া হচ্ছে এ খাতে নতুন ও পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কারণ পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে বৃহৎ আকারে বিনিয়োগ করেছে। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ও কর্মপরিধির আকার অনেক বৃহৎ, কর্মসংস্থানও অনেক বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি হাই-টেক পার্কের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সেখানে জায়গা কম। বিশাল বিনিয়োগের সুযোগ কম। ফলে সেখানেও ছোটো আকারে বিনিয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি হাই-টেক পার্ক ঘোষিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে এ খাতে বিপুল বিনিয়োগ গড়ে উঠেছে। তৈরি পোশাকশিল্পের পর হাই-টেক শিল্পখাত সবচেয়ে সম্ভবনাময় রপ্তানি উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইলেকট্রনিক্স, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যারসহ বিভিন্ন হাই-টেক পণ্য ও সেবা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশীয় হাই-টেক শিল্প বিকাশ ও সংরক্ষণের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে যারা এই খাতে অবদান রেখে আসছে তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতি-নির্ধারণ করা জরুরি। এতে বৃহৎ আকারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি আগ্রহী হবে। যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ধারাকে বেগবান করতে আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবে।