ঢাকা, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

নজিরবিহীন হামলা

মানবজমিন ডেস্ক
১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার
mzamin

নজিরবিহীন। এতদিন শত্রুতা, বাগাড়ম্বরতা থাকলেও এবার প্রথমবার সরাসরি ইসরাইলে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইসরাইলিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে ইরান। আরও বড় একটি যুদ্ধ অত্যাসন্ন হয়ে উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, সেই যুদ্ধ আরও বৃহৎ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্বনেতারা। যারা এতদিন ইসরাইলকে সমর্থন করেছেন, তারা পর্যন্ত ইরানের হামলার প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদ ইরানকে গুঁড়িয়ে দিতে চাপ সৃষ্টি করেছে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর। সোমবার ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে জার্মানি। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের কিনারায় পৌঁছে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ। ইরান ও ইসরাইলের আকাশসীমায় ফ্লাইট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটকে বহু পথ ঘুরে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন
ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা এড়িয়ে চলতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ইরানে প্রতিশোধমূলক হামলা না চালাতে ইসরাইলকে রাজি করানোর জন্য কাজ করছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। একদিকে গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো মুসলিম জাহানে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তার মধ্যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ইসরাইল। ফলে যদি ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ।
এতদিন ইরান সমর্থিত হামাসের হামলার আতঙ্কে সাইরেন বাজানো হতো ইসরাইলে। কিন্তু শনিবার দিবাগত রাতে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তাল যুদ্ধের নতুন এক দামামা যোগ হয়েছে। ১লা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কন্স্যুলেটে ভয়াবহ হামলা চালায় ইসরাইল। এতে অভিজাত রেভ্যুলুশনারি গার্ডের কমান্ডারসহ কমপক্ষে সাতজন নিহত হন। ওই কন্স্যুলেট ভবন বিধ্বস্ত হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তখনই এর বদলা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয় ইরান। তারই অংশ হিসেবে ‘ট্রু প্রমিজ’ অভিযানে শনিবার রাতে তারা ইসরাইলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। একই সঙ্গে ইসরাইল যেন এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরানে হামলা না চালায় এমন অনুরোধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন সহ আরও কিছু দেশ। এর কারণ, ইসরাইল প্রতিশোধ নিতে গেলেই পূর্ণাঙ্গ একটি যুদ্ধে রূপ নেবে পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সুনির্দিষ্ট বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বায়েরবক। তিনি আঞ্চলিক উত্তেজনা এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। উত্তেজনা প্রশমনে সম্ভাব্য সবকিছু করতে রাজি তার দেশ এমন নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। একই আহ্বান জানিয়েছেন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ডেভিড ক্যামেরন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁও সাবধান করেছেন। বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি প্রান্তঃসীমায়। এখনই বন্ধ করতে হবে যুদ্ধপরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে, ইসরাইল ইরানে হামলা চালালে তাতে তারা অংশ নেবে না। পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত না করতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বৃটেন। হামলার জবাবে কি প্রতিক্রিয়া হবে তা নির্ধারণে ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে বিতর্ক হয় রোববার। এই  বৈঠক সোমবারও বসে। তাতে ইরানের ওপর ভয়াবহ হামলা চালানোর জন্য নেতানিয়াহুর প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হয়। 

শনিবার রাতে ইসরাইলে কমপক্ষে ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এটাই ইসরাইলে তাদের সরাসরি প্রথম হামলা। ইসরাইল বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মিত্রদের সহায়তায় এসব আকাশেই নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। তবে ইরান তা অস্বীকার করে। তারা বলছে, ইসরাইল মুখরক্ষার জন্য মিথ্যা কথা বলছে। ইরান বলছে, ইসরাইলে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ আশপাশের দেশগুলোকে সতর্ক করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইরানের এই দাবি সত্য নয়। তারা ইসরাইলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিই করতে চেয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে- তুরস্ক, জর্ডান এবং ইরাকের কর্মকর্তারা রোববার বলেছেন, ইসরাইলে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েকদিন আগে তাদেরকে বিস্তৃত নোটিশ দিয়েছে ইরান। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, তেহরান ওয়াশিংটনকে সতর্ক করেনি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, ইরান প্রতিবেশী দেশ এবং ইসরাইলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে ৭২ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে জানিয়েছিল- তারা হামলা চালাবে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা হামলার আগে ওয়াশিংটন এবং তেহরান উভয়ের সঙ্গেই কথা বলেছিল এবং হামলার পর প্রতিক্রিয়া যেন আনুপাতিক থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য আঙ্কারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একে অপরের বার্তা উভয়পক্ষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

তুরস্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, ইরান জানিয়েছিল- দামেস্কে তার দূতাবাসে ইসরাইলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই হামলা চালানো হবে এবং তারা এর বাইরে আর কিছুই করবে না। আমরা এই হামলার সম্ভাবনার বিষয়ে অবগত ছিলাম। আর তাই ইসরাইলে ইরানের এই হামলা আমাদের কাছে অবাক করার মতো কিছু ছিল না। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির-আবদুল্লাহিয়ানের বিবৃতি অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ওয়াশিংটন সুইস মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু ৭২ ঘণ্টা আগে তারা কোনো নোটিশ পায়নি। অন্যদিকে ইরাকি, তুর্কি এবং জর্ডানের কর্মকর্তাদের প্রত্যেকে বলেছেন, ইরান গত সপ্তাহে কিছু বিশদ বিবরণসহ হামলার বিষয়ে প্রাথমিক সতর্কতা দিয়েছে। ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলায় বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটতে পারে এবং সংঘর্ষ বাড়তে পারে।

মার্কিন কর্মকর্তারা শুক্রবার এবং শনিবার বলেন, তারা ইরানের কাছ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে আক্রমণের আশঙ্কা করছেন এবং সে সময় তেহরানের কাছে কঠোরভাবে বাইডেনের একমাত্র বার্তা ছিল: ‘(ইসরাইলে হামলা) করবেন না।’ ইরাকের একজন সরকারি নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ দুটি ইরাকি সূত্র জানিয়েছে, ইরান হামলার অন্তত তিন দিন আগে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে বাগদাদকে এ বিষয়ে জানিয়েছিল। 

ওদিকে  হোয়াইট হাউস ইসরাইলকে সতর্ক করেছে। বলেছে, ইরানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক হামলায় অংশ নেবে না যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা এই সতর্কতার কথা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে ইসরাইলকে যে কোনো পাল্টা জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন জো বাইডেন- এমনটাই জানিয়েছেন তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা।  রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়, প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন বাইডেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘খুব সাবধানে এবং কৌশলীভাবে চিন্তা করতে’ বলেছেন। কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন বিশ্বাস করে যে ইসরাইল এর বিনিময়ে ‘সেরাটাই পেয়েছে’, যার শুরু হয়েছিল সিরিয়ায় ইরানের কন্স্যুলেট ভবনে হামলায় সিনিয়র ইরানি সামরিক কমান্ডারদের হত্যার মাধ্যমে। ইরান প্রতিশোধমূলক হামলা চালানোর সময়, তাদের প্রায় ৯৯ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত হয়েছিল বা বাধা দেয়া হয়েছিল- যা মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের উপর ইসরাইলি সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের চিহ্ন হিসেবে দেখছে। ৮০টিরও বেশি ড্রোন এবং কমপক্ষে ছয়টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরাকের উপর দিয়ে ভূপাতিত করে মার্কিন বিমান ও জাহাজ বা বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী। এর মধ্যে সাতটি ড্রোন এবং একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছিল যেগুলো তারা ইয়েমেন থেকে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করেছিল, ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) রোববার এক আপডেটে এ তথ্য জানিয়েছে।

এই হামলাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য তোলপাড়। বিশ্ব জুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ সহ বিশ্বনেতারা আশঙ্কা করছেন এই হামলার জবাব যদি দেয় ইসরাইল, তাহলে তা আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেবে। এ জন্য পরিস্থিতিকে প্রান্তঃসীমায় বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। অন্যদিকে ইরানের এই হামলায় সুবিধা পেয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি মনে করছেন, এই যুদ্ধের কারণে গাজায় তিনি যা করছেন তা ধামাচাপা পড়ে থাকবে। 
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status