রকমারি
‘পাঞ্জাবি উপহার দিলে মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়ে’
স্টাফ রিপোর্টার
৬ এপ্রিল ২০২৪, শনিবারছবি: জীবন আহমেদ
ঈদ আসন্ন। আনন্দের এই দিনটি উদ্যাপনে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। বিভিন্ন পর্যায়ের, পেশার মানুষের ঈদ আয়োজন যেমন-
ঈদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু স্ট্যাটাস ভেসে ওঠে। অনেকেই ফেসবুকে লেখেন- পাঞ্জাবি উপহার দিলে মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়ে। এমন স্ট্যাটাস এখন ট্রেন্ডিং। আবার নাজমুল হুদা নামে একজন লেখেন- কোনো ছোট ভাই সালামি চাইলে বুঝবেন সে আপনাকে ভালোবাসে। আবার রুবেল নামে একজন লেখেন- সিনিয়ররা সালামি না দেয়া পর্যন্ত কোনো জুনিয়ররে সালামি দেবো না। সালামির একটা চেইন অব কমান্ড থাকা উচিত। আবার রাব্বী হোসেন নামে একজন লেখেন- ঈদ সালামি হিসেবে বই উপহার দিন। আবার অনেকেই ঈদ সালামির পোস্টে মেনশনের জবাবে বলছেন- রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই। আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই। একটি পেজ থেকে দেয়া স্ট্যাটাস বেশ ভাইরাল হয়। তাতে লেখা ছিল- স্ত্রীকে বেশি বেশি ঈদ সেলামি দিলে স্বামীর রুজি রোজগারে বরকত বেড়ে যায়।
ঈদ মানেই দায়িত্ব
এখন আর ঈদের কোনো আনন্দ নাই। আগে যখন বাবার টাকায় চলতাম তখন ছিল ঈদ। এখন ঈদ মানেই দায়িত্ব। অনেক মানুষকেই ঈদ উপহার দেয়া উচিত। এরপর যতটুকু পেরেছি কিনেছি। বাচ্চাদের আবদার, কাছের কিছু মানুষের চাহিদা মেটাতে মেটাতেই ঈদ একটা পেরেশানিতে রূপ নিয়েছে। এভাবেই বলছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, আমি ৩২ হাজার টাকা বেতন পাই। বোনাস পেয়েছি ১৬ হাজার টাকা। এনিয়ে ঈদ শপিং বাজারঘাট সব।
তার দুই ছেলে। তিনি বলেন, সবার ঈদ শপিংয়ের জন্য ১০ হাজার টাকা বাজেট করেছিলাম। কিন্তু সাড়ে ১২ হাজার টাকা খরচ করার পরও বাকি রয়ে গেছে। নিজের জন্য কোনো বাজেট রাখেননি জানিয়ে বলেন, আমার ঈদ পরিবারের জন্যই। যবে থেকে আয় করা শুরু করেছি, তখন থেকে আমার ঈদ মানেই দায়িত্ব।
ঈদের দিন আরও বেশি কাজ করা লাগে
ঢাকার মিরপুরে থাকেন মর্জিনা বেগম। তার স্বামীর সঙ্গে হয়েছে ছাড়াছাড়ি। এক ছেলে থাকে চট্টগ্রামে। আর মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলে কোনো খরচ দেন না। কিন্তু তার জীবন চলে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। তিনি ৫টি বাড়িতে কাজ করেন। সব মিলিয়ে তার আয় ১২ হাজার টাকা। তিনি জানান, প্রত্যেক বাড়ি থেকেই ঈদ বোনাস দিয়েছে। নতুন কাপড়ও পেয়েছেন। তিনি বলেন, ঈদ মানে আমার কাছে কাজ। অনেক বাড়িতে এই সময়টা ডাবল কাজ করা লাগে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঈদের দিন ভোরে বের হই। সারাদিন কাজ করি। ভালোমন্দ খাওয়া যায়। আমার দুইটা নাতিন আছে। হেগো জন্য কয়টা টাকা পাঠাইছি। এটাই আমার ঈদ। আপন মানুষ আমার কোনো খোঁজ নেয় না। কাজের মধ্যে থাকি।
সবার স্বপ্ন বাড়ি যায় না
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থীর বাড়ি রংপুরে। মেস খালি করে সবাই ঈদ করতে গেলেও তার যাওয়া হয়নি। ছয় বছর আগে হারিয়েছেন মাকে। এরপর তার বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। তিনি বলেন, আমার ঈদ আসলে একটা বিষাদ কাজ করে। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। আমার সৎমা আমাকে খুব একটা ভালোভাবে নেন না। আমার সৎভাই-বোনরাও নিজের ভাবতে পারে না। আব্বু প্রতিমাসে টাকা দেয় এই অনেক। আমিও কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে ঢাকাতেই ঈদ করি দুই বছর থেকে। আব্বুও জোর করেন না। এটাই আমার ঈদ। তবে আব্বু ঈদের শপিং করার জন্য টাকা দিয়েছেন। এটা দিয়েই আমি সুখ, আনন্দ কিনি। ঈদে সবার স্বপ্ন বাড়ি যায় না।
ঈদ আইলে মানুষ ট্যাকা বেশি দেয়
রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে ফুল বিক্রি করে ছোট্ট পরী। বয়স তার আনুমানিক ৬ বছর। গতকাল দুপুরে কয়েকটি গোলাপ হাতে যানজটে বিক্রির চেষ্টা করছিল। নাম জানতে চাইলে বলে, আমার নাম পরী। এইহানেই বড় হইছি। আমার মা আমার লগেই থাকে। বাপরে কোনোদিন দেখি নাই। শুনছি রিকশা চালায়। ঈদের বিষয়ে জানতে চাইলে বলে, ঈদের সময় মানুষ বেশি ট্যাকা দেয়। ভালোমন্দ খাওয়ন যায় এটাই আমার ঈদ। এই কথা বলতেই ছেড়ে দেয় সিগন্যাল। ফের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপর ফের সিগন্যাল পড়বে ফুল হাতে ছুটে যাবে অন্যের কাছে। এটাই তাদের জীবন। যানজটে দাঁড়ানো গাড়িতে ফুল বিক্রি করেই কাটে পরীদের ঈদ।
এই ঈদে একটা বয়লার মুরগি কিনমু
ভ্যান চালাতেন সেন্টু মিয়া। এরপর সড়ক দুর্ঘটনায় এক পায়ের শক্তি হারান। এখন মিরপুর ৬০ ফিট রোডে শীতকালে পিঠা ও অন্যান্য সময়ে তেলে ভাজা বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেন। নিঃসন্তান তারা। সেন্টু বলেন, এখন যে অবস্থা। প্রতিদিন যে খেয়ে পড়ে বেছে আছি এটাই আল্লাহর রহমত। দুজনেই খাই। নানা রোগ শোক বাসা বাঁধছে শরীরে। ঈদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আর ঈদ! যাকাতের একটা লুঙ্গি পাইছি। আর হ্যারেও একটা শাড়ি দিছে। এতেই খুশি। আর ঈদের দিন একটা বড় দেইখা বয়লার মুরগি কিনমু। আল্লাহর রহমত এটাই আমাগো ঈদ। এতেই আমরা খুশি।
একজন শিক্ষিত বেকারের ঈদ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন মাহফুজ আলম মুন। ঢাকায় থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকারি চাকরির। তিনি বলেন, আমার বয়স এখন ২৮। টিউশনি একটা করলেও নিজের খরচটাও চালাতে পারি না। এই বয়সেও বাবার কাছে টাকা নিতে হয়। এখন আর টাকা চাইতে পারি না। বাবাই নিজে থেকে টাকা পাঠান। কিছু টাকা শপিংয়ের জন্যও দিয়েছেন। এটা নিতে আমার খুব খারাপ লাগে।
তিনি আরও বলেন, আমার একটা চাকরি হওয়া খুবই জরুরি। বাড়ি যাবো শেষের দিকে যত তাড়াতাড়ি পারি আবার চলে আসবো। যখন সবাই প্রশ্ন করে কী করি? এর উত্তর দিতে পারি না। সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি এটা বলতেও লজ্জা লাগে। আমার কাছে ঈদটা খুব কষ্টের। মুখ লুকিয়ে রাখতে হয় বাড়িতেও। আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভুগি।
প্রথম শ্বশুরবাড়িতে ঈদ- ভয়ও লাগছে, খারাপও লাগছে
গত ডিসেম্বর মাসে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছেন আদিব ও যুথি। বিয়ের পর এটাই তাদের প্রথম ঈদ। আদিব বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। যুথির আয় ফ্রিল্যান্সিংয়ে। যুথি বলেন, বাবা-মা ছাড়া কোনো সময় ঈদ করি নাই। এবারই প্রথম। কোনোদিন বাড়িতে কাজ করি নাই। আম্মুই সব কাজ করতো। আমি শুধু ঘুম থেকে উঠে খেতাম আর সাজগোজ করতাম। শ্বশুড়বাড়িতে ঈদ ভয় করছে। কী কী যে করতে হবে, আদবের সঙ্গে চলতে হবে। এসব ভেবে একটু ভয় করছে। আবার ভিন্ন পরিবেশে ঈদ করা নিয়ে চ্যালেঞ্জও লাগছে। আবার আব্বু-আম্মু ছাড়া ঈদ কাটাবো এটা ভেবে খারাপ লাগছে।
বউরে কইছি বাচ্চাগো কিছু কিনে দিতে
নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় বাড়ি মো. সাইদুলের। তিনি ঢাকায় রিকশা চালান। দুই তিন মাস পরপর বাড়িতে গিয়ে এক মাস করে থাকেন। সাইদুলের ৪ ছেলে মেয়ে। তিনি বলেন, আমার বাড়ির ভিটাটা ছাড়া আর কিছু নাই। বউ টুকটাক ক্ষ্যাতের কাম করে। বাচ্চাগুলা ছোট। আমি দুই-তিন মাস পর পর টাকা নিয়া বাড়ি যাই। আবার মাসখানেক পর চইলা আসি। এবার ঈদের জন্য বাড়িতে ১২শ’ টাকা পাঠাইছি। বউরে কইছি বাচ্চাগো কিছু কিনে দিতে। এটাই আমার ঈদ।