ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রকমারি

জাপান যেসব কারণে শিশু শিক্ষায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে

আশির আহমেদ
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার
mzamin

জাপানি শিশুশিক্ষা বিশ্বের শীর্ষস্থানে। চাইনিজ এক পত্রিকা জাপান শিশুশিক্ষায় শীর্ষস্থানে থাকার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। কারণগুলো বিশ্লেষণ করার আগে কিন্ডার গার্টেন নিয়ে কিছু কথা বলি-  Kinder Garten  শব্দটি এসেছে জার্মান ভাষা থেকে। কারণ শিশুশিক্ষার এই কনসেপ্টটি তাদের আবিষ্কার। সেই ১৭৭৯ সালে। জার্মান ভাষায় Kinder মানে শিশু আর Garten মানে হলো বাগান। অনেকে সাইনবোর্ডে বানানটি ভুল করে Kinder Garden লেখা হয়। পৃথিবীর সব দেশেই একই নাম,  একই ধরনের কারিকুলাম। শুধু ফ্রান্স আর ইতালিতে বলে মেটারনাল স্কুল। এই তফাৎ।

বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে সংক্ষেপে বলে কেজি। কিলোগ্রাম এর কেজি না, Kinder Garten এর প্রথম অক্ষর নিয়ে কএ। অনেকে নার্সারির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুদের জন্য প্রি-স্কুল শিক্ষা বলতে পারেন। ৬ বছর বয়সে  প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ান। জাপানিজ ভাষায় কিন্ডার গার্টেনকে বলে য়চিএন। ‘য়চি’ মানে কচি-বাচ্চা, ‘এন’ মানে বাগান বা পার্ক। কচি বাচ্চাদের বাগান। আমি বলি মানুষ তৈরির বাগান। কিন্ডার গার্টেন ডিজাইন করার জন্য স্পেশাল আর্কিটেক্ট আছেন।

 জাপানে আমার প্রথম কিন্ডার গার্টেন দেখার সুযোগ হয় ১৯৯০ সালে। আমাদের কয়েকজন বিদেশিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। বাচ্চাদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমরা প্রায়ই অতিথি হয়ে যেতাম।  আমাদের কাজ ছিল রিলে রেইস এর প্রতিযোগিতায় ওদের টিমে ঢুকে গিয়ে লড়াই করা। প্রত্যেক টিমে একজন করে বিদেশি। তারপর একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। মাঝে মাঝে গান নাচ এ অংশ নেয়া। নিজের দেশ কেমন সে নিয়ে বক্তৃতা দেয়া। এই কাজের জন্য আমাদের ৫০ ডলারের মতো টাকাও দিতো। প্রথম প্রথম অতিথি ভাব নিয়ে যেতাম। জায়গায় জায়গায় ভুল ধরা যেন আমার দায়িত্ব। তখন জাপানে বিদেশি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রস্তুতি চলছিল। স্কুলে বিভিন্ন দেশের পতাকা (কাগজে প্রিন্ট করা) রশি দিয়ে বেঁধে একটা আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক ভাব আনার চেষ্টা করতো। 

বাংলাদেশের পতাকা কেন নেই, ওনারা কি বাংলাদেশকে দেশ মনে করে না- এই ধরনের চিকন টাইপের কমেন্ট করে বেচারাদের বিপদে ফেলে দিতাম। নিজের জ্ঞান বুদ্ধি কতটা অপরিপক্ব ছিল তা যখন বুঝতে পেরেছি- তখন আফসোস করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার এক জাপানি শিক্ষক বলেছিলেন- অতীতের কাজ নিয়ে কখনো আফসোস করবে না। ধরে নেবে ওই অভিজ্ঞতা টুকু না থাকলে আজ নিজের ভুল বুঝতে পারতে না। জিজ্ঞাস করলাম এই যে আমাদের বিদেশিদের পয়সা দিয়ে ওদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাচ্ছে এতে তাদের লাভ কি? উনি বিশাল বক্তৃতা দিলেন- জাপান একটা দ্বীপ। অন্যান্য দেশের সঙ্গে কোনো বাউন্ডারি নেই। বিদেশি বলতে কি বোঝায় আমরা জানি না। এখন থেকে জাপানে জনসংখ্যা কমবে। বিদেশ থেকে লোকজন আনতে হবে। একই কমিউনিটিতে বসবাস করতে হবে। এখনকার বাচ্চারা ২০ বছর পর সমাজে ঢুকে চাকরি করবে, ব্যবসা করবে। বিদেশিদের সঙ্গে মিশবে। ভিন মানুষের সঙ্গে মিশতে পারাটা ও একটা স্কিল। একসঙ্গে খেলাধুলা করলে খাওয়া দাওয়া করলে কে কি ভাবছে তা বোঝা যায়। এখন থেকেই সেই প্র্যাকটিসটা হয়ে যাক। এই কথা ১৯৯০ সালের। এই বয়সের শিশুরা এগুলোর কী বুঝবে? স্যার আবার দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। জন্ম এবং ৫ বছর বয়সের মধ্যবর্তী সময়কাল মস্তিষ্ক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় এবং এই সময়ে মস্তিষ্কে যে পথগুলো নির্ধারিত হয়, বাকি জীবনে তা প্রভাব ফেলে। বিদেশি বলতে রঙ ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, আচরণ ভিন্ন। কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ সেটা সে লজিক দিয়ে ১৮ বছর বয়স এর পর সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু ভিন্নতা আছে, ভিন্নতার মধ্যে সুন্দরতা আছে- এটা টের পাওয়ার মোক্ষম সময় এটাই। এতো বিশাল বক্তৃতা আমার মাথায় কিছু ঢুকেনি। 

এই কিন্ডার গার্টেনেই দেখা হওয়া একজন ছাত্রীর কথা বলি। মেয়েটির নাম রিএ। সে একটা ভোকেশনাল কলেজে পড়তো। তার পড়াশুনার বিষয়বস্তু ছিল বাচ্চাদের জন্য খেলাধুলার সামগ্রী বানানো। সে এক খেলনা নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিল। অনেকটা আমাদের দেশের পুতুল নাচের মতো। এতোগুলো মুভমেন্ট মাত্র তিনটি আঙ্গুল দিয়ে করে। তার প্রতি ইমেপ্রসড হওয়ার দ্বিতীয় কারণটি ছিল তার এই আঙ্গুলের মুভমেন্ট। আমি সুযোগ পেয়ে তাকে একটা যাদু দেখিয়েছিলাম। সে দেখালো কাগজের খেলাধুলা।  কাগজ ভাঁজ করে অরিগামি বানানো, কাগজ কেটে কেটে বিভিন্ন পশু পাখির আকৃতি বানানো। এসব নাকি তার পড়াশুনার বিষয় বস্তু। বলে রাখি অরিগামি, কিরিগামি এগুলো জাপানি আবিষ্কার। জ্যামিতি কে কি সুন্দর ভাবে কাজে লাগিয়েছে। কাগজ ভাঁজ করা, কাগজ কাটা একটা সায়েন্স। এখন বিশাল ব্যবসা। এইবার শুনুন কেন জাপানি কিন্ডার গার্টেন পৃথিবীর শীর্ষে। 

 (১) অতি সাধারণ পরিবেশ- শ্রেণিকক্ষগুলো একেবারেই সিম্পল। বিলাসিতা নেই। যা দরকার যতটুকু দরকার ততটুকুই আছে। খেলনাগুলি কেমন জানেন? কার্ডবোর্ড, কাগজ, সংবাদপত্র  দিয়ে তৈরি। আর আছে হরেক রকম বই। জাপানি ভাষায় লেখা। ছবিতে ভর্তি। খেলাধুলার বিষয়বস্তু, বইয়ে ছবির রঙের ব্যবহার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রমাগত গবেষণা চলে। 

(২) নিজের কাজ নিজে করো পলিসি- বাচ্চাদের নিজস্ব ব্যাগ থাকে। নীতিটি হলো শিশুবেলা থেকেই নিজের ব্যাগ নিজেকে গোছাতে হবে। এতে দায়বদ্ধতাবোধ এবং কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা বিকাশ হয়। নিজের পোশাক নিজেই পরিবর্তন করতে শিখে এবং করে। চিন্তা করুন মাত্র ৩-৫ বছর বয়স। 

(৩) পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো- অনেক বাবা-মা যদিও কমপ্লেন করেন। শীতকালে ও এদেরকে  শর্টস পরায়। শীতে নাকমুখ পা লাল হয়ে যায়- তারপর ও মাঝে মাঝে শীতকে উপভোগ করা শিখায়- এইভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠলে এদের শরীর নাকি এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি হয়ে ওঠে এবং ঠাণ্ডা ধরার সম্ভাবনা কম থাকে। 

(৪)  কল্পনা শক্তির বিকাশ-  কিন্ডার গার্টেনে সমাজ, ইংরেজি, গণিতের মতো কোনো পাঠ্যপুস্তক নেই। আছে শুধু গল্পের বই। যা শুনে মগজে কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে।

 (৫) কননিচিওয়া, আরিগাতো আর গোমেননাসাই-  শিশুকাল থেকেই প্রথম এই তিনটি শব্দ শেখাবে এবং প্রয়োগ করাবে। মানুষ মাত্রই দিনের প্রথম সাক্ষাতে শুভেচ্ছা জানাবে (কননিচিওয়া)। মানুষ মাত্রই কেউ কাউকে বিপদে সাহায্য করবে। সাহায্য পেলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে (আরিগাতো) আর মানুষ মাত্রই ভুল করবে, সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে (গোমেননাসাই)। এই তিনটি শব্দ যে কত বড়।

 (৬) জীবনের উৎস বোঝানো-প্রত্যেক শিশুর জন্মদিন পালন করা হয়। মাসে একবার। সেই মাসে জন্মগ্রহণকারী সবশিশুর।  বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানীর জন্মদিনে ছবি এঁকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করানো শেখাবে। 

(৭) গ্রুপ ওয়ার্ক- খেলাধুলা, রুম গোছানো, রুম পরিষ্কার করা, খাবার বিতরণ করা, সব গ্রুপে গ্রুপে করে। সব কাজ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কাজই ছোট নয়।

 (৮) ট্যুর- প্রত্যেক মাসেই ট্যুর এর আয়োজন করে। হেঁটে ট্যুর, গাড়িতে ট্যুর। নিজের মহল্লাতেই। যেমন গাড়ি চেনাবে। কোন গাড়ি সমাজের কি উপকারে লাগে- পুলিশের গাড়ি, ফায়ার সার্ভিস এর গাড়ি, এম্বুলেন্স। বিভিন্ন পেশা শেখাবে- শিক্ষক, ছাত্র, শেফ, ড্রাইভার, নাপিত। যাদের অবদানে এই সমাজ টিকে আছে। 

(৯) দিবস উদযাপন- জাপানি কিছু উৎসব আছে। হিনামাতসুরি, শিচিগোসান, অবোন। এসব উৎসব আনন্দ সহকারে পালন করা হয়। বাচ্চাদের দিয়ে গান গাওয়ানো, নাটক করানো- কত সুন্দরভাবে যে ওরা শেখে আর পালন করে। শিক্ষকদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।

 (১০) শিক্ষক- সবচেয়ে বড় অবদান আমি বলবো শিক্ষকদের। এই শিক্ষকরা সাধারণত কম বয়সী মেয়েরা হয়ে থাকে। বাচ্চারা তাদের কি যে ভালো বাসে। বাসায় এসে কথায় কথায় শিক্ষকদের উদ্ধৃতি দিবে। অমুক সেন্সেই এই বলেছে। এটা করা যাবে না, এমন ভাবে করা যাবে না। কিন্ডার গার্টেন এর শিক্ষকদের কথা বললেই সেই জাপানি মেয়েটির কথা মনে পড়ে। এমন গুণসম্পন্ন মেয়েগুলোই শিক্ষক হয়। শিক্ষকরা যেমন বাচ্চা পছন্দ করে। শিশুরাও তেমন শিক্ষকদের সম্মান করে। উইন উইন সিচুয়েশন। জি শিশুরা কি পছন্দ করে কী অপছন্দ করে। কী দেখলে আকৃষ্ট হয়। কী ভঙ্গি তাদের পছন্দ। শিশুদের কোন ভঙ্গি কী অর্থ বহন করে এগুলো গবেষণার বিষয়। শিশু শিক্ষার শিক্ষক বানানোর জন্য আলাদা ভোকেশনাল কলেজ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ডিপার্টমেন্ট আছে। শিশুশিক্ষা নিয়ে পড়াশুনা হয়, গবেষণা হয়। জাপানি কার্টুনগুলো কেন এতো জনপ্রিয় তার কারণ কেবলমাত্র কার্টুনের কাহিনীগুলো নয়। রঙ, আকৃতি, কণ্ঠ, চুলের ডিজাইন, চোখ-মুখ-নাক এর গঠন সব মিলিয়ে এই শিশুপ্রিয়তা। গবেষণার ফসলগুলোর ব্যবহার এই কিন্ডার গার্টেনে হয়। কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষকরা এইসব বিষয় নিয়ে ডিগ্রি পেয়ে বের হওয়া লাইসেন্সধারী প্রফেশনাল।

 লেখক: এসোসিয়েট প্রফেসর কিউশু ইউনিভার্সিটি, জাপান।

পাঠকের মতামত

ধন্যবাদ, খুব সুন্দর লিখার জন্য।

Shahid Babul
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ৩:৩৫ অপরাহ্ন

লেখাটা পড়ে খুবই ভালো লাগলো

MD SHAKIR HOSSEN
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ৩:১১ অপরাহ্ন

আমার একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল আছে। অনুপ্রাণিত হলাম। সম্মানিত লেখককে ধন্যবাদ।

মোঃ মোশারফ হোসেন
১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন

রকমারি থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

রকমারি সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status