ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

টাকার মান

৩ মাসে ৯ বার পরিবর্তন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২ জুলাই ২০২২, শনিবার
mzamin

দাম নির্ধারণের এখতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়ার পর পরই বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। মার্কিন ডলারের বিপরীতে অব্যাহতভাবে মান হারাচ্ছে দেশীয় মুদ্রা টাকা। এরই ধারাবাহিকতায়   সর্বশেষ গত মঙ্গলবার আবারো ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে দাঁড়িয়ে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সায়। ফলে গত তিন মাসের ব্যবধানে ৯ দফা বাড়ানো হয়েছে ডলারের দাম। আলোচ্য সময়ে টাকার মান কমেছে ৭ টাকা। আর চলতি বছর ডলারের বিপরীতে টাকার ১৭তম অবমূল্যায়ন হয়েছে। এর আগে গত ২৯শে মে দেশে ডলারের এক রেট ৮৯ টাকা বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পরবর্তীতে এই রেট উঠিয়ে দিয়ে ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। মাঝে দুই বার শক্তিশালী হয়েছিল টাকা। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

বিজ্ঞাপন
এদিকে গত মাসে ডলারের দাম বেড়ে খোলা বাজারে ১০২ টাকা অতিক্রম করে রেকর্ড গড়েছিল। পরে কিছুটা কমে বর্তমানে খোলা বাজারে ৯৮ থেকে ৯৯ টাকায় ডলার বেচা-কেনা হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তবে রপ্তানি ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে চলতি অর্থবছরের আগস্ট থেকে ১৬ই জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। 

ডলারের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। ৩রা আগস্ট থেকে দু’এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২শে আগস্ট প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৮৫ টাকা ছাড়ায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান দফায় দফায় কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত করোনার পরে আমদানি ব্যয় অধিক হারে বেড়ে যায়। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা চরম আকার ধারণ করে। বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ক্রাইসিস মেটেনি। এরমধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় খরচ বেড়ে যায়। তাতে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। এতে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের মুদ্রা টাকাও ডলারের বিপরীতে দর হারাতে থাকে। জানা গেছে, চলতি বছরের ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনা-বেচা হয়েছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, যা ৯ই জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ টাকা। 

গত ২৩শে মার্চ তা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় বেচা-কেনা হয়। এর পর গত ২৭শে এপ্রিল ডলার প্রতি ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায় বেচা-কেনা হয়। গত ১০ই মে ডলার প্রতি আরও ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায় বেচা-কেনা হয়। গত ১৬ই মে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনা-বেচা ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২৩শে মে ফের ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এরপরও বাজার স্থিতিশীল হয়নি। পরে সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশের (এবিবি) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯শে মে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৯ টাকা বেঁধে দেয়। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির জন্য বিসি সেলিং রেট নির্ধারণ করা হয় ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। কিন্তু তাতেও বাজার স্থিতিশীল না হওয়ায় ডলারের এক রেট উঠিয়ে দিয়ে গত ২রা জুন আরও ৯০ পয়সা বাড়িয়ে দাম ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। 

গত ৬ই জুন প্রতি ডলার ৯১ টাকা ৫০ পয়সা। গত ৭ই জুন ডলার ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা, ৮ই জুন ৯২ টাকা এবং গত ১৩ই জুন ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৯২ টাকা ৫০ পয়সায়। গত ১৫ই জুন ডলার দাম ছিল ৯২.৮০ টাকা। গত ২১শে জুন ডলারের দাম বেড়ে ৯২.৯০ টাকা, পরদিন তা বেড়ে ৯২.৯৫ টাকা বিক্রি হয়। ২৮শে জুন ডলারের দাম বেড়ে ৯৩.৪৫ টাকা বিক্রি হয়েছে, যা ডলারের দামের সর্বোচ্চ রেকর্ড। মাঝে গত ৮ই জুন এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়ে ০.৫০ পয়সা। এর আগেও একদিন বেড়েছে ছিল। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে একদিকে ব্যাপক হারে আমদানির চাপ বেড়েছে। ফলে আমদানির দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। কিন্তু সেই তুলনায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। এতে ব্যাংক ব্যবস্থা ও খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডলারের দাম। 

 বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করছে না। ব্যাংকগুলো যে দামে লেনদেন করে, তার মধ্যে একটি দর বিবেচনায় নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।  ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব নিত্যপণ্যে: চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকদের নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব পড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে আমদানি খরচ। ডলারের দাম বাড়ায় বাড়ছে খাদ্যশস্যের দর। পণ্যের দাম বাড়ায় এবং টাকার মান কমায় চাপ বাড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর। যার যন্ত্রণায় ভুগছে নিম্ন, স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ। তবে ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে ডলারের দাম বাড়ায় বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের বিপরীতে দেশে আরও বেশি টাকা পাচ্ছে। ফলে তারা লাভবান হচ্ছেন। আমদানি করা পণ্যের মধ্যে দাম বেড়েছে সয়াবিন তেলের, আটা, মসুর ডাল, আমদানি করা পিয়াজ, আমদানি করা রসুন, আমদানি করা আদা, চিনি, গুঁড়া দুধ। এ ছাড়া নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মধ্যে সাবান, টুথপেস্ট, বিস্কুট, চানাচুর, পাওরুটি, ডিটারজেন্ট, নারিকেল তেল প্রভৃতির দামও বেড়েছে। 

 সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যারা আমদানিকারক তারা এখন বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি করছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সেটি ইতিমধ্যেই আমরা দেখছি।  গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের বাজারে চরম অস্থিরতা চলছে। এটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।  এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজারে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ বাড়াতে অগ্রাধিকার নির্ধারণে জোর এবং উচ্চ ব্যয়ের কিছু দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে অর্থ খরচে সংযত হতে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।  বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত ‘সংকোচনমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অর্থের জোগান আরও কমানো এবং রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার আরও এক দফা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। গভর্নর ফজলে কবির বলেন, টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা হবে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।

 বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যে হারে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে সেটা বাড়তে দিলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। এরইমধ্যে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। এর পরে যদি মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ে, তাহলে নিম্নবিত্তরা অনেক সমস্যায় পড়ে যাবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status