দেশ বিদেশ
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা
শোক-ভালোবাসায় নিহতদের স্মরণ
স্টাফ রিপোর্টার
২ জুলাই ২০২২, শনিবারগুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলার ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে শুক্রবার। ২০১৬ সালের ১লা জুলাই ঘটে যায় দেশের ইতিহাসের সব থেকে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা। ওইদিন রাত ৮টা ৫০ মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস এক জঙ্গি হামলার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিল গোটা জাতি। হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন। পরেরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার। নিহত হয় হামলাকারী ৫ জঙ্গি। হামলায় সরাসরি অংশ নেয় মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র নিবরাস ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার সাবেক ছাত্র মীর সামিহ মোবাশ্বের, বগুড়ার বিগিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র খায়রুল ইসলাম পায়েল, বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজের ছাত্র শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
ভয়াবহ এই ঘটনায় নিহতদের গতকাল শোক আর ভালোবাসায় স্মরণ ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন স্বজন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কূটনীতিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ সময় নিহতদের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল গুলশান পুরনো থানার সামনে জঙ্গি হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’-এ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হারকাতুল জিহাদ ও জেএমবির মাধ্যমে। পরে ইরাকে যখন আইএসের উৎপাত শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কিছু মানুষ তামিমের নেতৃত্বে হলি আর্টিজানে হামলা করে।
শ্রদ্ধা জানিয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না, সব সময় সতর্ক আছি। সমন্বিতভাবে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ও আস্তানা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছি। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা জঙ্গিবাদ দমনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছি। সাইবার জগতে আমরা জঙ্গি কার্যক্রমের বিষয়ে নজরদারি রাখছি। জঙ্গিবাদ দমনে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে র্যাব। যে কারণে জঙ্গিবাদ এখন সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছে না।
জঙ্গিদের ডি-রেডিক্যালাইজেশনের কাজ করছে উল্লেখ করে র্যাব ডিজি বলেন, আমরা এরইমধ্যে ১৬ জঙ্গিকে ডি-রেডিক্যালাইজেশন করেছি। ১৬ জঙ্গিকে আত্মসমর্পণ করিয়েছি। তাদের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি, যেন তারা নতুন করে জঙ্গিবাদে না জড়ায়। আমরা এ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। আমরা তাদের ভালো পথে শান্তির পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করছি। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত র্যাব প্রায় ৩ হাজার জঙ্গি গ্রেপ্তার করেছে। হলি আর্টিজানের হামলার পর আমরা ১ হাজার ৬০০’র বেশি জঙ্গি গ্রেপ্তার করেছি।
এদিকে হলি আর্টিজানে নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের দূতরা। প্রথমে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তারপর ইতালির রাষ্ট্রদূত এনরিকো নুনজিয়াতা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী গণমাধ্যমকে বলেন, এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। বাংলাদেশ, ভারতসহ এ ঘটনায় যারা ভুক্তভোগী হয়েছেন তাদের সবাইকে স্মরণ করছি। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আমরা খুবই ব্যথিত। এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে। একসঙ্গে কাজ করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ছয় বছর আগের হামলায় সাতজন জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছেন, যারা মেট্রোরেল লাইন ওয়ান প্রকল্পের গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। আমরা কখনোই তাদের ভুলবো না। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
জঙ্গি হামলায় নিহত বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিম খান দীপ্ত শপথ ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন কন্যা সামান্তা খান ও পুত্র এস এম রায়ান। শ্রদ্ধা জানানোর পর সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিম খান বলেন, শুধু এই দিনে আমরা তাকে বেশি মিস করি, বিষয়টি এমন নয়। যেদিন থেকে আমরা ওকে হারিয়েছি, সেদিন থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তাকে মিস করি। দুই সন্তানের প্রসঙ্গ টেনে রেমকিম খান বলেন, বাচ্চারা বাবাকে মিস করেনি এমন কোনো দিন আমি দেখিনি। বাবার জায়গাটা আমি মা হয়ে শত চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারিনি। সালাউদ্দিন যখন মারা যায় তখন মেয়েটা সপ্তম শ্রেণিতে আর ছেলেটা কেজি টুতে পড়তো। এখন মেয়েটা দেশের বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর ছেলে ঢাকার একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনার পর দায়ের করা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। সিটিটিসি হামলার দুই বছরেরও বেশি সময় পর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ২০১৮ সালের ৩রা জুলাই। পরে ২০১৯ সালের ২৭শে নভেম্বর গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার মামলায় ৭ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং এক আসামিকে খালাস দেন বিচারিক আদালত। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এ রায় দেন। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। একই বছরের ৩০শে নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭ আসামির ডেথরেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে আসে। এর পরেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। এরপর আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আর রায়ে খালাস পাওয়া একজনের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এখনো মামলাটি বিচারাধীন হলেও উচ্চ আদালতে বিচারিক কার্যক্রমের আর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।