ঢাকা, ১০ মে ২০২৪, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

একটি রায়ের বিশ্লেষণ

বিচারাধীন ব্যক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য!

সালেহ উদ্দিন, অস্ট্রেলিয়া থেকে
২৫ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার
mzamin

দণ্ডিতদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে একটি মারাত্মক ভ্রমাত্মক রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে বিচারাধীন দণ্ডিত ব্যক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচনে  অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য থেকে যাবেন। যা সংসদ সদস্য পদে যোগ্যতা সংক্রান্ত সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নিয়ে হাইকোর্টের একাধিক রায় থাকায় আইনগত জটিলতাও দেখা দিবে। 

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি’র  পাঁচ নেতার  দণ্ড স্থগিতের আবেদন নাকচ করে ২০১৮ সালের ২৭শে নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সংক্ষিপ্ত একটি রায় ঘোষণা করেছিলেন। বিগত পাঁচ বছর এই রায় আলোর মুখ দেখেনি। আর কয়েক সপ্তাহ পর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর আগ মুহূর্তে গত ২২শে অক্টোবর  রোববার বিচারপতিদের পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের  ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয় দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা পাওয়া আসামি সাংবিধানিকভাবেই সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। জামিন বা সাজা স্থগিত থাকলেও দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে  অংশ নিতে পারবেন না, যদি তার সাজা উপযুক্ত আদালতে বাতিল না হয়। আপিল বিচারাধীন থাকা মানে দণ্ডিত ব্যক্তি নির্দোষ নন।

বিজ্ঞাপন
একমাত্র উপযুক্ত আদালতে সাজা বাতিল হলে দণ্ডিত ব্যক্তি নির্দোষ হবেন।

এই রায় নিয়ে সংবিধানের কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত  হয়েছে। অতীতে সাজা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত দণ্ডিত ব্যক্তি আপিল করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারতেন। বাংলাদেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় সাজা চূড়ান্ত হয় সর্বোচ্চ আদালতে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এনিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ও  রয়েছে। একটি রায়ে বিচারপতি মোস্তাফা কামাল বলেছেন, বিচারের শেষে ধাপ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো রায়কে চূড়ান্ত রায় বলা যাবে না। বিচারের শেষ ধাপ সম্পন্ন  না হওয়ার সুবিধা পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত একাধিক মামলায় নিম্ন আদালতে এরশাদের জেল হয়। এরশাদ ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ অংশ নিয়েছিলেন। কুড়িগ্রাম আসনে বিএনপিদলীয় প্রার্থী একেএম মাইদুল ইসলাম-এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট তার রিট খারিজ করে দেয়। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল বিভাগে গিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। এরশাদের মনোনয়নপত্র বহাল থাকে। কিন্তু এরশাদ ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন নি। এর আগেই জনতা টাওয়ার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার শেষধাপে এসে তার সাজা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ফলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্যতা হারান। এরশাদের ক্ষেত্রেই আরেকটি নজির আছে। ২০০৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর জাপানি নৌযান ক্রয় দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টে এরশাদের দুই বছরের জেল হয়। সময়ের অভাবে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের আগে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করতে পারেন নি। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল না থাকায় রিটার্নিং অফিসার (২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচন) তার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। তবে দুই বছর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে এরশাদ কিন্তু অংশ নিতে পেরেছিলেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রথা বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলন ছিল। এমনকি দণ্ড স্থগিতেরও একাধিক নজির আমাদের বিচারব্যবস্থায় আছে। বিএনপি’র নাসের রহমানের দণ্ড স্থগিতের কারণে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৩ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে আপিল করে হাজী সেলিম ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। ২০১৮ সালে  আলোচ্য এই রিটের রায়ের পর হাজী সেলিমের সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এই ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের দু-তিনটি রায় আছে। আমার যতটুকু জানা  হাজী সেলিম আপিল বিভাগে আপিল করেছেন। আমি যত দূর জানি, সেটা হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংসদ সদস্যের পদ প্রভাবিত হবে না। এটাই রায়ে আছে।’ প্রসঙ্গত  সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচিত হওয়ার পরে সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকার ক্ষেত্রে এবং সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একই যোগ্যতার কথা বলা আছে।

আলোচ্য এই মামলার রায়ে বলা হয়েছে, আপিল বিচারাধীন থাকলেও দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে দণ্ডিত ব্যক্তিরা অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য থেকে যাবেন। এই  রায় সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে যে মেয়াদ নির্দিষ্ট আছে তার লঙ্ঘন বলে আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশের বিচারব্যবস্থায় নিম্ন আদালতে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ আদালতের পর হাইকোর্ট হয়ে চূড়ান্ত বিচার আপিল বিভাগে গিয়ে শেষ হয়। বিচারের এই প্রক্রিয়া শেষ হতে ১৫/২০ বছর সময় চলে যায়। আজ থেকে ১৫ বছর আগে নিম্ন আদালতে বিএনপি’র এই ৫ নেতার দণ্ড হয়েছিল। এখনো দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তাদের আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এই রায়ের ফলে যদি আগামী নির্বাচনেও অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হন তাহলে তারা টানা তিন মেয়াদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যদিও সংবিধানে নির্বাচনে ৬৬ অনুচ্ছেদে অযোগ্যতার মেয়াদকাল হচ্ছে ‘মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর’। অর্থাৎ সংবিধান প্রণেতারা সংবিধান প্রণয়নের সময় এই পাঁচবছর সময়কালকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ একটি সংসদের মেয়াদের সময়কাল এই অযোগ্যতা বলবৎ থাকবে। সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদের মেয়াদকালও নির্দিষ্ট আছে সংসদের প্রথম বৈঠক হতে পাঁচ বছর। সুতরাং অযোগ্যতার মেয়াদকালও মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর বলে বিবেচিত হবে। সংবিধানের ৬৬ (২২) (ঘ) অনুচ্ছেদে স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে, ‘(২) কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’। এই অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে ‘মুক্তিলাভের পর’ কথাটি লেখা আছে। আর মুক্তিলাভ ঘটে সাজাভোগের পর। সাজা চূড়ান্ত হয় বিচারের শেষ ধাপের পর। কারও যখন দণ্ড হয় তখন তিনি দণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হন কিন্তু যখন তিনি তার এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং তার আপিল শুনানির জন্য গৃহীত হয় তখন তার পরিচয় হয় আপিলকারী। আপিলকারী এবং দণ্ডিত ব্যক্তি এক নন। দণ্ডিত ব্যক্তি সাজা ভোগ করেন আর আপিলকারী যখন জামিনে মুক্ত হন তখন সাজা গণনা হয় না। আমাদের  বিচারব্যবস্থায় নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত শতকরা  ৬০ জনেরও বেশি আপিলে গিয়ে খালাস পান। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারের আগে কাউকে দোষী বলে গণ্য করা আইনের যে দর্শন তার বিরুদ্ধ।

কিন্তু এই রায় প্রচলিত সকল রীতিনীতিকে উল্টে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই উপমহাদেশের  সর্বোচ্চ আদালতের নজিরকেও অস্বীকার করেছে।

সাধারণত ভারতের উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা নজির হিসেবে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করে থাকে। আলোচ্য রিটের রায়ে হাইকোর্ট দণ্ড স্থগিত রাখা যায় না বলে অভিমত দিয়েছে। অথচ এ বছরের ২৩শে আগস্ট ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ২ বছরের সাজা স্থগিত করেছে। সাজা স্থগিতের নজির বাংলাদেশের হাইকোর্টেরও আছে। এই রিটের উদ্ভব হয়েছে বিএনপি’র পাঁচ নেতার দণ্ড স্থগিতের আবেদনকে কেন্দ্র করে। হাইকোর্ট তাদের দণ্ড স্থগিতের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের  রুলস অনুযায়ী একই বিষয়ে হাইকোর্টের কোনো যৌথ বেঞ্চ কোনো রায় বা আদেশ দিলে হাইকোর্টের অন্য বেঞ্চ তিন জন বিচারপতির সমন্বয়ে  বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির জন্য বিষয়টি সুপারিশ আকারে প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরণ করবেন। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি হাইকোর্টে নিষ্পত্তির জন্য তখন একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন। এই রিটের ক্ষেত্রে এই নিয়মেরও ব্যত্যয় ঘটেছে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status