ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

পাঠ্যপুস্তক : এবার কন্টেন্ট চুরি ও গুগল ট্রান্সলেটরের ব্যবহারের অভিযোগ

মুনির হোসেন
১৭ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক অসঙ্গতি সামনে আসছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত নতুন বই নিয়ে। এবার অভিযোগ উঠেছে গুগল ট্রান্সলেটরের ব্যবহার ও কন্টেন্ট চুরির। নতুন কারিকুলামের সপ্তম শ্রেণির ‘বিজ্ঞান, অনুসন্ধানী পাঠ’ বই নিয়ে এমন অভিযোগ। বইটির সম্পাদনা করেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। রচনায়ও ছিলেন, তিনি সহ পাঁচজন। পাঠ্যবইয়ের এমন অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে বইটির বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন পর্যালোচনা করে মানবজমিন। যেখানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বইটি লিখেছেন, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. হাসিনা খান, ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান, ড. মুশতাক ইব্নে আয়ূব এবং রনি বসাক। আর ইংরেজি ভার্সনের ভাষান্তর করেন, একেএম আজিজুল হক, রমিজ আহমেদ, মুহাম্মদ আলী এবং মু. সাদেকুর রহমান।

বিজ্ঞাপন
সপ্তম শ্রেণির এ বইটি এবার পরীক্ষামূলক প্রকাশ করে এনসিটিবি। যেখানে বইটির প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পৃষ্ঠায় জীববৈচিত্র্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয় ‘জীববৈচিত্র্য বা Biodiversity শব্দ দ্বারা পৃথিবীতে জীবনের বিপুল বৈচিত্র্য বর্ণনা করা হয়। জীববৈচিত্র্য বলতে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীবসহ সকল জীবের মধ্যে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে বোঝায়। পৃথিবীতে ঠিক কত সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন জীব আছে, তা নিশ্চিত করে এখনো আমাদের জানা নেই। তবে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে, প্রায় ৮-১৪ মিলিয়ন (৮০ থেকে ১৪০ লক্ষ) বিভিন্ন প্রজাতির জীব এই পৃথিবীতে রয়েছে। কারও কারও ধারণা মতে, সংখ্যাটা আরও বেশি। তবে সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, এসব জীবের বেশির ভাগই আমাদের অজানা। এখন পর্যন্ত মাত্র ১.২ মিলিয়ন (১২ লক্ষ) প্রজাতি শনাক্ত এবং বর্ণনা করা হয়েছে, যার অধিকাংশই অবশ্য পোকামাকড়। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোটি কোটি অন্যান্য জীব এখনো আমাদের কাছে রহস্যময়, অজানা।’ যে লেখাটি হুবহু https://education. nationalgeographic.org/resource/biodiversity এর থেকে কপি করা অনুবাদ। একই বইয়ের ইংরেজি ভার্সনের জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের লেখাটিকে গুগল ট্রান্সলেটরের ব্যবহার করে ভাষান্তর করা হয়েছে। যদিও গুগল এখনো বাংলা থেকে ইংরেজি কিংবা ইংরেজি থেকে বাংলার সঠিক ভাষান্তর করতে পারে না। তৃতীয় পৃষ্ঠায় জীববৈচিত্র্যের উদ্ভবে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে জীবিত সকল প্রজাতির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হাজার হাজার বছরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিকশিত হয়েছে। একটি জীব তার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যেসব কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তাকে বলে অভিযোজন (Adaptation)......যেসব জীব একে-অপরের সঙ্গে প্রজনন করতে পারে, সেগুলোকে সাধারণত একই প্রজাতির ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’ এ অংশটিও nationalgeographic.org থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে। পঞ্চম পৃষ্ঠায়ও বলা হয়, ‘বিশ্বের কিছু অঞ্চল, যেমন মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, দক্ষিণ-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মাদাগাস্কারের অঞ্চলে অন্যদের চেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্য রয়েছে। 

বিশ্বের এসব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে স্থানীয় প্রজাতি রয়েছে.....স্থানীয় প্রজাতির উচ্চ সংখ্যার অঞ্চলগুলোকে জীববৈচিত্র্যের হটস্পট (Hotspot) বলা হয়।’ এ লেখাটিও একই ওয়েবসাইটের কয়েকটি বিছিন্ন বাক্যকে ভাষান্তর করে লেখা। একই পৃষ্ঠায় ‘জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক’র বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়, ‘পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতি বেঁচে থাকার জন্য এবং সেগুলোর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একসঙ্গে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, চারণভূমির ঘাস গবাদিপশু খায়। গবাদিপশু যে মল ত্যাগ করে, তা সার তৈরি করে যা মাটিতে পুষ্টি ফেরত দেয়, যা আরও ঘাস জন্মাতে সাহায্য করে। এই সার ফসলি জমিতে প্রয়োগ করার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক প্রজাতি খাদ্য, পোশাক এবং ওষুধসহ নানা উপকরণ প্রদান করে মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’ এটিও একই ওয়েবসাইট থেকে নেয়া। নবম পৃষ্ঠায় ‘জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি ও প্রতিকার’- শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পৃথিবীর বেশির ভাগ জীববৈচিত্র্য মানুষের ব্যবহার এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা বাস্তুতন্ত্রকে বিশৃঙ্খল করে, এমনকি কখনো কখনো বিনষ্টও করে ফেলে। দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি সবই জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। এই হুমকি প্রজাতি বিলুপ্তির পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে। কিছু বিজ্ঞানী অনুমান করেছেন যে, আগামী শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতির অর্ধেক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ যা nationalgeographic.org থেকে অনুবাদ করা। 

বিষয়টি নিয়ে গবেষক ড. নাদিম মাহমুদ এক প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, ‘অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকটি (সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান, অনুসন্ধানী পাঠ) পড়া শুরু করেছিলাম। দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, লেখকদের সম্পাদনায় প্রকাশিত বইটি হাতে পাওয়ার পর সত্যি একধরনের অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। শুরুতে যেভাবে লাইন টু লাইন অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে কপি করে বাংলা অনুবাদ করেছে, সেটি দেখার পর মনে হয়েছে, আমরা ঠিক কোন শিক্ষাব্যবস্থা কোমলমতি শিশুদের সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছি? আমার চোখ যতটি পৃষ্ঠা নজর দিয়েছে, তার অংশ এইভাবে গুগল ট্রান্সলেটরে ভাষান্তর করা হয়েছে। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, গুগল আমাদের বাংলা ভাষার ভাষান্তর এখনো সঠিকভাবে দিতে পারে না। ভুলভাল ইংরেজিতে বাংলার ভাষান্তর হয়, সেটি সম্ভবত লেখকেরা ভুলে গেছেন।’ তিনি বইটিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বিভিন্ন কন্টেন্ট হুবহু প্রকাশকে চৌর্যবৃত্তি বলে মন্তব্য করেন। 
বইটি সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা ও লেখকদের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানবজমিন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগটি আমার নজরে এসেছে। 

এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি জুনে। পূর্বাপর কী হয়েছে তা আমি জানি না। আবার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব এড়াতেও চাচ্ছি না। আগের কোনো বিষয় আমার জানার কথা ছিল না। আমরা এ বইটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ দিয়েছি। এনসিটিবি সব বই-ই প্রথম বছর পরীক্ষামূলক সংস্করণ দিয়ে থাকে। এরপর সারা বছর বইয়ের সঙ্গে যুক্ত সব স্টেক হোল্ডার ভুলগুলো পর্যালোচনা করে। সবাই যে ভুল পাবে সেগুলো সংশোধন করে পরবর্তী বছর প্রথম সংস্করণ বের করা হবে। আমরা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সব সংশোধনী গ্রহণ করে থাকি। পত্র-পত্রিকায়ও যেসব ভুল সামনে আনা হয় সেগুলোও আমলে নিয়ে থাকি। এরপর আমরা সব ভুল আমলে নিয়ে পরবর্তী বছর থেকে প্রথম সংস্করণ বের করে থাকি। কিন্তু একই সঙ্গে অনেকে ভুল তথ্যও ছড়ায় তাই আমরা ভালোভাবে পরীক্ষা করে যেসব ভুল পাবো সেগুলো সংস্কার করবো। আশা করি প্রথম সংস্করণে কোনো ভুল বা অসঙ্গতি থাকবে না।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

মৌলভীবাজারে জাতীয় পার্টির সম্মেলন সম্পন্ন / ‘আমরা আওয়ামী লীগে নেই, বিএনপিতেও নেই

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status