দেশ বিদেশ
নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলাম
বোমার চেয়েও শক্তিশালী কী?
মানবজমিন ডেস্ক
২৯ জুন ২০২৫, রবিবার
দুই দশক আগে ইরানে প্রথম সফরের সময় আমি গিয়ে দাঁড়াই সেই ‘গোয়েন্দাদের ঘাঁটি’র সামনে- যেটি একসময় আমেরিকান দূতাবাস ছিল। সেটা এখন ‘গ্রেট শয়তান’ আমেরিকার বিরুদ্ধে পোস্টারে মোড়ানো। সেখানে আমি দেখা করি এক তরুণ বিপ্লবী রক্ষীর সঙ্গে। আমেরিকা-বিরোধী প্রচারণার মাঝেও তিনি ছিলেন বন্ধুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বিস্ময়করভাবে, তার প্রিয় সিনেমা ছিল ‘টাইটানিক’! যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি কি আমেরিকার ‘নৈতিক অবক্ষয়’- নিয়ে সরকারের বক্তব্যে একমত? তিনি হেসে বললেন, আসলে আমি তো ওদিকেই যেতে চাই! ইরান পরিস্থিতি নিয়ে প্রভাবশালী নিউ ইয়র্ক টাইমসে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন কলামনিস্ট নিকোলাস ডি. ক্রিস্টোফ। এতে তিনি ওই সফরের অভিজ্ঞতা থেকেই জানিয়েছেন, ইরানের সরকারের এত অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তারা টিকে আছে কীভাবে? বারবার ইরানে সফরের সময় তিনি দেখেছেন- গোপনে অনেকেই সরকারের দুর্নীতি, অবিচার আর নারী-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিশেষ করে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’- আন্দোলন দমন করার পর এই ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
নিকোলাস ক্রিস্টোফ মনে করেন, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর লক্ষ্য- ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর হওয়া থেকে রুখে দেয়া ও ভালো শাসনব্যবস্থার আগমন। ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন উপায়ে এটা অর্জন করা সম্ভব?
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি, যদিও এতে বড় ক্ষতি হয়েছে। কিছু তথ্য অনুযায়ী, ইরান কয়েক মাস বা কয়েক বছর পিছিয়ে গেছে। কিন্তু এক বড় প্রশ্ন হলো- ইরানের কাছে থাকা উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম (প্রায় ৯-১০টি বোমা তৈরির উপযোগী) কোথায় গেল?
অনেকে মনে করছেন, হামলার আগেই সেগুলো সরিয়ে ফেলেছিল ইরান। এখন অনিশ্চয়তা হলো- ইরান কি দ্রুততার সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগোবে? তারা কি আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের দেশ থেকে বের করে দেবে? তারা কি পরমাণু অস্ত্র-বিরোধী চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে যাবে?
এই পরিস্থিতিতে একজন ইউরোপীয় মধ্যস্থতাকারী বলেছেন, ‘এই হামলাই হয়তো ছিল এক পারমাণবিক ইরানের জন্মদিন’।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে স্বাক্ষরিত) ছিল ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু কার্যকর। চুক্তির ফলে ইরান অনেক সেন্ট্রিফিউজ সরিয়ে নেয়, ইউরেনিয়াম মজুত কমায়, সমৃদ্ধকরণ মাত্রা ৪ ভাগের নিচে রাখে। এই কূটনৈতিক উদ্যোগ ইরানকে ১৫ বছর পিছিয়ে দেয়। তারপর ট্রাম্প ২০১৮ সালে চুক্তি বাতিল করেন। তাই আজকের সংকটের মূল সূত্র সেই সময় থেকেই।
নিকোলাস ক্রিস্টোফ লিখেছেন, বোমা ফাটানোকে যতটা সহজে গ্রহণ করা হয়, কূটনীতিকে ততটা বিশ্বাস করা হয় না। যে পরিস্থিতিতে ইরানের ইউরেনিয়াম মজুতের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটাই আজকের বাস্তবতা- যা ট্রাম্প উদ্যাপন করছেন। তবে তিনি মনে করেন, এখন একটি নতুন চুক্তির প্রয়োজন- বিশেষ করে ইউরেনিয়াম মজুতের বিষয়ে।
ট্রাম্পের এখন একটি কৌশলগত সুবিধাও রয়েছে- তিনি আবারো হামলার হুমকি দিয়ে কঠিন শর্তে চুক্তি করতে পারেন, যেখানে ওবামা সামরিক হস্তক্ষেপে অনিচ্ছুক ছিলেন বলে দুর্বল অবস্থানে ছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, বিচ্ছিন্নতা ও নিষেধাজ্ঞা সরকার বদলাতে পারে। কিন্তু কিউবা, উত্তর কোরিয়া প্রমাণ করেছে যে- এই পথ অনেক সময় কাজ করে না। অন্যদিকে, বাণিজ্য ও সম্পর্ক তৈরি করেও চীনকে গণতান্ত্রিক করা যায়নি।
নিকোলাস ক্রিস্টোফ মনে করেন, বিচ্ছিন্নতা প্রায়ই স্বৈরাচারী সরকারগুলোকে আরও শক্তি দেয়, কারণ তারা নিজেদের ব্যর্থতার দায় চাপাতে পারে বাইরের শক্তির উপর।
ইরানিরা শিক্ষিত, ঐতিহ্যবাহী, কিন্তু নেতৃত্ব নিয়ে হতাশ। গবেষণার অভাব থাকলেও অনুমান করা হয়, ৮০ ভাগ মানুষ নতুন সরকার চায়। কোনো একদিন এই সরকার ভেঙে পড়বে। কিন্তু সেই পরিবর্তন বোমা নয়, বরং শান্তির পরিবেশেই সম্ভব।
এই নিবন্ধের শেষ বাক্যে লেখক বলেন, বোমা হয়তো সরকারকে দুর্বল করে। কিন্তু টাইটানিক-ও পারে!
অর্থাৎ সংস্কৃতি, মানবতা, যোগাযোগ- এসব অনেক সময় অস্ত্রের চেয়েও বেশি কার্যকর।