দেশ বিদেশ
নানা বিপত্তির মাঝেও বাড়ছে পোশাক রপ্তানি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার
পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষে কারখানা বন্ধসহ নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা ও নানা বিপত্তির মাঝেও নতুন ও পুরাতন অর্থাৎ প্রচলিত ও অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপের বাজারেও পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়কালে ৯ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৮৪ শতাংশ বেড়ে ৩০.২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
এই শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পেছনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা মূল অবদান রেখেছে। এ সময়ে মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৪৯.৮২ শতাংশই হয়েছে ইইউতে। এ সময়ে ইইউ থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ১৫.০৭ বিলিয়ন ডলার, আগের গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৩১ শতাংশ বেশি। জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে এর চেয়েও বেশি ১৭.২৩ শতাংশ। এ সময় দেশটিতে বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানি ছিল ৫.৭৪ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য ও কানাডায় রপ্তানি হয়েছে যথাক্রমে ৩.৩৬ বিলিয়ন ও ৯৬৩.৮৫ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কানাডায় রপ্তানিতে ১৫.৬৬ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ৪.১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ও বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
সূত্র জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হয়। ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। এর মধ্যে গাজীপুর ও ঢাকার সাভারে শ্রমিক অসন্তোষের বেশ কয়েকদিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকে; উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এ খাতের কর্মকাণ্ড।
জানা গেছে, শ্রমিক আন্দোলন, কারখানা বন্ধ, অর্ডার বাতিল হওয়া, কারখানার মালিক পলাতক, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপসহ নানা সংকটেও পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। এর কারণ পুরনো বাজারগুলো পোশাক রপ্তানি বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। অপ্রচলিত বাজারেও পোশাক রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। রপ্তানি বাড়ায় খুশি এ খাতের রপ্তানিকারকরা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্যনীতি অর্থাৎ ট্রাম্প শুল্কের ধাক্কার শেষ পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে চিন্তিত সবাই।
২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই বাজার থেকে। ২০২৪ সালের ৯ মাস (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ২.০৬ শতাংশ নেতিবাচক (ঋণাত্মক) প্রবৃদ্ধি ছিল। বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রপ্তানি বাড়ায় শেষ পর্যন্ত ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়েছিল বছর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অফিসের (ইউরোস্ট্যাট) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা ৩৬৯ কোটি ৩৩ লাখ (৩.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই বাজারে ২৬৯ কোটি ৫৮ লাখ (২.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
প্রকাশিত ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ইইউ’র কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ১ হাজার ৬০৯ কোটি ৮২ লাখ (১৬.০৯ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭.৮১ শতাংশ বেশি। ইইউতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীন সবার শীর্ষে। তৃতীয় তুরস্ক।
এদিকে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশ থেকে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২২ সালে এই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। পরে নেতিবাচক ধারা চলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তবে বছরের শেষ দিকে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি দিয়ে শেষ হয়েছিল বছর। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যা ছিল ২০২৩ সালের তুলনায় ০.৭৫ শতাংশ বেশি।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল বাংলাদেশে; যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছ থেকে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিতের নির্দেশনা আসতে শুরু করে। পাল্টা শুল্ক তিন মাস স্থগিতের পর অবশ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি উল্লম্ফন দিয়ে শুরু হয়েছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে ১৫০ কোটি (১.৫০ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপরও রপ্তানি আয় বাড়ায় আমরা খুশি। ২০২৫ সালটা ভালোই শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে রীতিমতো বাণিজ্য যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ঝড় তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এটার পরিণতি কী হবে, তা আমরা পরিষ্কার কিছুই বুঝতে পারছি না।
এদিকে অপ্রচলিত বাজারগুলোতেও পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। অপ্রচলিত বাজারগুলোতেও ৬.৬৬ শতাংশ বেড়েছে। জুলাই-মার্চ এ ৯ মাস সময়কালে অপ্রচলিত বাজারে ৫.১২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা মোট রপ্তানির ১৬.৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত উল্লেখযোগ্য। জাপানে রপ্তানি হয়েছে ৯৬০.৪৫ মিলিয়ন ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় ৬৫৩.৬৪ মিলিয়ন ডলার ও ভারতে ৫৩৫.১৫ মিলিয়ন ডলারের পোশাক। এ সময়কালে রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), নিউজিল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি কমেছে।
ইভিটেক্স ড্রেস শাট লিমিটেড পরিচালক শাহ রাঈদ চৌধুরী বলেন, বড় ধরনের অস্থিরতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছি আমরা। এর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে রপ্তানি বাড়া আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে। এই বাজারগুলো আরও ভালোভাবে দখলের একটা সুযোগ এসেছে। এই সুযোগটাই এখন আমাদের সবাই মিলে কাজে লাগাতে হবে।