ঢাকা, ৭ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

৩১ দফা, বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান/ ড. ফয়সাল কবীর শুভ
৬ এপ্রিল ২০২৫, রবিবারmzamin

বিএনপি’র রাজনীতিকে বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯ দফায়। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯ দফার প্রস্তাবনা দেন এবং তখন কার সময়ে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশের পথে এগিয়ে যেতে থাকে।
এরপর বেগম খালেদা জিয়া প্রণয়ন করেন ভিশন-২০৩০! উনি তার ভাষণে বলেছিলেন, যতটুকু কাজ ৫ অথবা ১০ বছরে সম্পন্ন করা যায় সেরকম প্রক্ষেপণ করেই ভিশন -২০৩০ প্রদান করা হয়েছে।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়। গুম, খুন অবিশ্বাস্যভাবে বাড়তে থাকে। একটি মিথ্যা মামলায় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করার পর দলের হাল ধরেন তারেক রহমান।

উনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর সারা দেশে ফ্যাসিস্টবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিত করার প্রয়াস নেন। ভঙ্গুর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে মেরামতের জন্য দলগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রণয়ন করেন একটি ইনক্লুসিভ জাতীয় দিকনির্দেশনা ৩১ দফা।
এই ৩১ দফার প্রত্যেকটি দফাই এমনভাবে করা হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, কৃষিবিদ সমাজের সকল সেক্টরের মানুষ অবদান রাখতে পারে।
আজকের বাংলাদেশে সংস্কার-সংস্কার বলে যে হাইপ তোলা হচ্ছে, বিএনপি এই সংস্কারের প্রস্তাবনা দিয়েছে ২০২৩ সালের ১৩ই এপ্রিল। 
১৫ নম্বর দফার ডিটেইলে বলা আছে, সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার 
কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, মিডিয়া কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশনের কথা।
প্রস্তাবনার ২নং দফায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিতে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

খুব জোরালোভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে ৩ নম্বর দফায়।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে ৪ নম্বর দফায়।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কয় টার্ম হবে এই নিয়ে জোর আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই এখন বলছে বিএনপি তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, ৫ নম্বর দফায় বিএনপি খুব স্পষ্টভাবে বলেছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ অনূর্ধ্ব পর পর দুই মেয়াদ।

বিএনপি’র এই ৩১ দফায় খুব অসাধারণভাবে স্বাস্থ্যখাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২৬ নম্বর দফায় স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু নয় এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যর ‘NHS’  এর আদলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি’র ৫ শতাংশ বরাদ্দ করার কথা বলা হয়েছে।
১৮, ২৮ ২৯, ৩০, ৩১ নম্বর দফায় প্রকৌশলীদের অবদান রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। পরিবেশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সড়ক, রেল, নৌপথ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা ও আণবিক শক্তির উন্নয়ন, পরিবেশ বান্ধব আবাসন, নগরায়ণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
১৩ নম্বর দফায় দুর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়পাল নিয়োগের ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। 

একটি জাতিকে ভবিষ্যতে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, নাগরিকদের সর্বোচ্চ সুযোগ- সুবিধা দেয়ার জন্য এবং সবল পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সমতাভিত্তিক নিগোসিয়েশন করার জন্য ৩১ দফাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের মূলভিত্তি। 
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রণীত এই ৩১ দফা বাংলাদেশকে একটি উন্নত, মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস! 

৩১ দফা বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. জনসম্পৃক্ততা:
বিএনপি’র প্রস্তাবিত রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা বাস্তবায়নে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও আগ্রহহীনতা দূর করে জনগণকে সম্পৃক্ত করা একটি কঠিন কাজ। যদিও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিশেষ পরামর্শক ড. মাহদি আমীন ৩১ দফার ওপর নিরন্তরভাবে বিএনপি’র বাবলের মধ্যে কর্মশালা পরিচালনা করে ৩১ দফার ব্যাপারে দলের অভ্যন্তরে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে চলেছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে ধারণা পরিষ্কারে আরও কাজ করা প্রয়োজন।
২. রাজনৈতিক প্রতিরোধ:
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বর্তমান ব্যবস্থায় উপকৃত কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই সংস্কার প্রস্তাবনার বিরোধিতা আসার সমূহ সম্ভাবনা আছে। ইতিমধ্যে তারা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপি এর প্রাথমিক জবাবকে নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা করে চলেছে। তাই ৩১ দফা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জন করাই হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বিএনপি’র পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে সবার সঙ্গে কথা বলেই এই ৩১ দফায় সংযোজন বা বিয়োজন করা হবে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতা:
৩১ দফার বাস্তবায়নে আরেকটা বড় বাধা হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যমান স্থবিরতা। দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক অভ্যাস ও পরিবর্তনের প্রতি প্রতিরোধমূলক মনোভাব সংস্কার বাস্তবায়নে বাধা হতে পারে। এ বাধা কাটিয়ে উঠতে কৌশলী উদ্যোগ নিতে হবে। 
৪. সম্পদের সীমাবদ্ধতা:
বিএনপি’র ৩১ দফার মতো বিস্তৃত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ও মানবসম্পদ প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বজায় রেখে সেই সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বিএনপি’র রাজনীতিতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সম্মিলন না হলে, এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। বিএনপি’তে মাঠের রাজনৈতিক কর্মীদের যেমন যোগ্যতাবলে বিভিন্ন রাজনৈতিক পদে পদায়ন করা হয়, তেমনি বিএনপি’র অরাজনৈতিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে, অনলাইন এক্টিভিস্ট, পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ সেল করা উচিত। যে সেলে ৩১ দফার বিভিন্ন দফার জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকবে। 
৫. লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, দলগুলোর রাজনীতি বিরোধী দলে থাকতে একরকম এবং আবার সরকারি দলে থাকলে একরকম। বিএনপি’র ৩১ দফা যেহেতু বিরোধী অবস্থানে থাকাকালীন সময়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, সরকারে গেলে এর বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকে চ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন সমস্যা জর্জরিত দেশে, একটি সরকারকে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হয়। বিএনপি’র জন্য সেই মোকাবিলা সাধারণত কঠিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে, রাষ্ট্রের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে বেশি শক্তি ও সময় ব্যয় করতে গিয়ে, ৩১ দফা বাস্তবায়নের বিস্তৃত লক্ষ্য থেকে বিএনপি’র ফোকাস কিছুটা সরে যেতে পারে। এরকম আশঙ্কা থেকে এজন্য বিএনপি’র উচিত হবে যেকোনো মূল্যে ৩১ দফা বাস্তবায়নের সেলকে অস্পৃশ্য রাখা।
সবশেষে বলা যায়, বিএনপি’র ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। এই কর্মসূচিতে যেমন ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি এর সফলতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক বিরোধিতা, প্রশাসনিক জড়তা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা, লক্ষ্য পূরণের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মপন্থা ঠিক করার মতো ব্যাপারগুলো কীভাবে সামলানো হবে। বস্তুত, টেকসই ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ, বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ, রাজনৈতিক চিন্তক

 

পাঠকের মতামত

৬২ দফা দিন।

মিলন আজাদ
৬ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ১:৪২ পূর্বাহ্ন

Stick to it Bro - জাতীয় সরকার চাই

জনতার আদালত
৬ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ১:১৩ পূর্বাহ্ন

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status