দেশ বিদেশ
ঈদ আনন্দ ২০২৫
রবীন্দ্রনাথের সাক্ষী শিলাইদহের কুঠিবাড়ি
এ.জে. সুজন
৫ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনালী স্মৃতিতে মিশে আছে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, রবীন্দ্রনাথ তার যৌবনকালের একটি উল্লেখযোগ্য সময় এখানে কাটিয়েছেন, তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য এবং প্রমত্তা পদ্মা নদী ও পদ্মার বুক থেকে বেরিয়ে আসা গড়াই নদীর প্রতি। ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লীর এই কুঠিবাড়ি এবং পদ্মা ও গড়াই নদীর বুকে রচিত হয়েছে কবির সাহিত্য কর্মের শ্রেষ্ঠাংশ। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি কবির সাহিত্য কীর্তি ও নানা রচনার সঙ্গী। কবিগুরুর পদস্পর্শে শিলাইদহ গ্রামটি বিশেষ মর্যাদা ও পরিচিতি লাভ করে।
শিলাইদহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত, শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে কুমারখালী উপজেলার একটি এলাকা। গ্রামটির পূর্ব নাম খোরশেদপুর, পদ্মা নদী ঘেঁষে এই ঐতিহাসিক স্থানটি স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। কুঠিবাড়িটি প্রায় ১১ একর বা ৩৩ বিঘা জায়গা জুড়ে রয়েছে। তবে আয়তনের সম্পূর্ণ জায়গাজুড়েই রয়েছে বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির ১৬টি কক্ষ। এখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে রবী ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের ছবি ও তার ব্যবহৃত আসবাবপত্র এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম।
এর মধ্যে রয়েছে- পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, খাট, সোফাসেট, হলরুম, আরাম চেয়ার, পালংক, আলনা, আলমারি, স্পিডবোট, পদ্মা বোট, চিত্রকর্ম, কবিতা, হাতে লেখা চিঠি, পানি পরিষ্কার যন্ত্র, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, মাটি মসৃণ করার যন্ত্র, ছিন্নপত্র ইত্যাদি।

এগুলো দেখলে আপনার মনে হবে আপনি যেন আজ হতে শত বছর আগে কবিগুরুর সময়ে চলে গেছেন। যেখানে কবি বাড়ির মেয়েরা পালকিতে করে নৌকা থেকে এই কুঠিবাড়িতে এসে নামছেন। সিন্দুকে রাখা আছে তাদের ব্যবহৃত তৈজসপত্রাদি। আর কবিগুরু খাটে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কখনো বা বজরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন পদ্মার বুকে। দোতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে রাখা আছে কবিগুরুর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র। ভ্রমণপিপাসু যে কারও নিকট শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এক আরাধ্য বস্তু। কুঠিবাড়ির দেয়াল থেকে শুরু করে সবকিছুই আপনার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে।
এই বাড়িটির দোতলায় রয়েছে একটি নজরকাড়া বারান্দা, দোতলার উপরে রয়েছে পিরামিড আকৃতির ছাদ, যা ভবনটিতে বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। আর এই কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে কবি সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং জ্যোৎস্না উপভোগ করতেন।
এর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দোতলার বারান্দায় বসলে একদিকে পদ্মা নদী অন্যদিকে গড়াই নদী দেখা যেতো। যেখানে বসে কবি লিখতেন তার কাব্য, গ্রন্থ, কবিতা। ধারণা করা হয়ে থাকে কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতা ‘ছোট নদী’-
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
কবিতাটি কুষ্টিয়ার গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে লেখা।
বিশাল আয়তন এই বাড়িটির মধ্যে দোতলা ভবনের পাশে আছে একটা বিশাল দীঘি। পুরো বাড়িটার আঙিনা জুড়ে আছে অনেক গাছপালা। এই গাছপালাগুলোর অবয়ব তাদের বয়সের সাক্ষী দিচ্ছে। এক একটা বৃক্ষ যেন দাঁড়িয়ে আছে এক একজন জাতিস্মরের ভূমিকায়। এই গাছগুলোর মধ্যে আম এবং পাইনের সংখ্যায় বেশি। পাশাপাশি আছে কাঁঠাল, নিম কাঠবাদামসহ আরও অনেক প্রজাতির গাছ। দীঘির দুই পাড়ে আছে দুটো শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে বসে আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন। অনেকেই এই শানের উপর শুয়ে তার শীতল পরশে শরীরের ক্লান্তি জুড়িয়ে নেন। আর দামাল ছেলেরা দলবেঁধে লাফিয়ে নেমে পড়ে গোসল করতে। আরও আছে অধুনালুপ্ত একটা পাতকুয়া।
কুঠিবাড়ির পুরো আয়তন অত্যন্ত সুন্দরভাবে গোছানো, পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি। এখানে রয়েছে- একটি বিশাল আম বাগান, দুটো পুকুর, রবীন্দ্র মঞ্চ, পাঠশালা, একটি ফুলের বাগান ও বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরাজি। বাড়ির একপাশে আছে ছোট্ট একটি গ্রন্থাগার, যেখানে রয়েছে কবির বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থের সংগ্রহ। পুরো কুঠিবাড়ির চারপাশ ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা।
গ্রামীণ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই পর্যটনস্থল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা হাজারো দর্শনার্থীর আগমনে দিনভর মুখর থাকে। ভ্রমণপিপাসুরা এখানে ঘোরাঘুরি করলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ১০০ বছর আগে ফিরে যাবেন। এখানে কবিগুরুর সময়কালীন পরিবেশের একটা আবহ তৈরি হতে বাধ্য। ১১ একরের প্রতিটি পরতে পরতে যেন কবির স্মৃতি জড়িয়ে আছে, বৃক্ষরাজির ছায়ায় চারপাশে শান বাঁধানো পুকুরপাড়ে বসে বিশ্রাম করলে এখানে বসে কবির কবিতা লেখার স্মৃতি মনে পড়ে যেতে পারে।
কবির জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিদিন এই কুঠিবাড়িতে প্রাণের টানে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। তবে এখানে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তাসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। পর্যটকদের বিশ্রাম ও থাকার জন্য সাদামাটা গোছের একটি ডাকবাংলোও রয়েছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জমিদারির দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করতেই এখানে এসেছিলেন, এরপর থেকেছেন বহুদিন। কুষ্টিয়ার মাটি এবং নদীর প্রতি কবির মমতার কথা ফুটে উঠেছে তার বহু সৃষ্টিতে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এখনো বহন করে চলেছে কবিগুরুর বহু স্মৃতি।
রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এই কুঠিবাড়ি থেকে তিনি পতিসর ও শাহজাদপুরের জমিদারিও দেখাশোনা করতেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলিসহ অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ। কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’-এর ইংরেজি অনুবাদ এখান থেকেই শুরু করেন এবং এই গ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। এ ছাড়া কবি শিলাইদহের এই বাড়িতে বসে বহু গান লিখেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ আরও অনেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনার জন্য শিলাইদহ গ্রামে থেকেছেন।
পদ্মা-গড়াইয়ের মধ্যবর্তী স্থান ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি এস্টেট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৯ সালে এই জমিদারি ক্রয় করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পদ্মা নদীর তীরে বড় বড় নীলকুঠি তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময় নীলের ব্যবসা ছেড়ে সাহেবরা চলে গেলে নীলকুঠির নিচতলা জমিদারির কাচারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীকালে নদীর ভাঙনে ওই নীলকুঠি বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে ১৮৯২ সালে পদ্মার তীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শিলাইদহ গ্রামে প্রায় ৩৩ বিঘা জায়গা নিয়ে বর্তমান কুঠিবাড়িটি নির্মাণ করা হয়।
কবিগুরু রীবন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রতি বছর ২৫, ২৬ ও ২৭শে বৈশাখ তিন দিনব্যাপী কবিতীর্থ শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয় এবং এখানে মেলা বসে। দেশ-বিদেশ থেকে বহু লোকের সমাবেশ ঘটে। তিনদিনের অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকে আলোচনা, সেমিনার, কবিতা আবৃতি, নাটক নৃত্য, গীতিনাট্য এবং সঙ্গীতানুষ্ঠান। ২৫ বৈশাখ ফিরে এলেই প্রতি বছর প্রকৃতির রুদ্রতার সঙ্গে মানবজীবনের সহজাত নৈকট্য প্রাপ্তির সঙ্গতি খুঁজতে গিয়ে একটি স্মরণীয় দিবস আমাদের মানস পটে ভেসে ওঠে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকীতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এখানকার জমিদারির হাত বদল হয়। জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর কুঠিবাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তি সরকারের মালিকানায় আসে। উল্লেখ্য, শিলাইদহ থেকে জমিদারি ছেড়ে যাওয়ার পরও কবি বেশ কয়েকবার শিলাইদহে এসেছেন। তবে অন্তিম শয়নকালে কবির শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার স্মৃতি ধন্য ভালোবাসার গ্রাম শিলাইদহে আর আসা হয়নি।
ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে অনেকভাবেই আসা যায়। বাসে আসতে হলে কুষ্টিয়া মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে, আর ট্রেনে আসতে হলে, কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে নামতে হবে, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশন দুটোই শহরে অবস্থিত, তারপর অটোতে করে শিলাইদহে নামতে হবে। দুই দিক দিয়ে কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহে আসা যায়। গড়াই সেতু পার হয়ে অথবা ঘোড়ার ঘাট পার হয়ে। কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহে আসার এ রাস্তাগুলোর পরিবেশও অতি মনোরম।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বর্তমানে সংরক্ষিত একটি জাতীয় ইমারত। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি সংরক্ষণ করছে। সরকারি উদ্যোগে এখানে ‘ঠাকুর স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভবনটি এখন জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। বর্তমানে কুঠিবাড়ির অনেক সংস্কার করা হয়েছে। কুঠিবাড়ির সামনে নির্মাণ করা হয়েছে একটা উঁচু মঞ্চ। আর ঢোকার মুখে মূল কুঠিবাড়ির বাইরে দেয়াল তুলে নির্মাণ করা হয়েছে একটা উঁচু প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে প্রবেশ করতে হয়। আর একবারে বাইরে মূল রাস্তার পাশে আছে বিভিন্ন সাজ সরঞ্জাম কেনার দোকান। তার পেছনে আছে অতিথিদের থাকার জন্য ছোট ছোট বাংলো। এই বাংলোগুলোর পাশে সবসময়ই চলে ছোটখাটো মেলা। সেখানে নাগরদোলা থেকে শুরু করে আছে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা। আর পাওয়া যায় অনেক রকমের মজার খাবার। তার মধ্যে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী কুলফি এবং তিলের খাজা অন্যতম।