ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

বাংলারজমিন

জাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ

জাবি প্রতিনিধি
১৪ আগস্ট ২০২৪, বুধবার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গত ১৫ই জুলাই ছাত্রলীগ কর্তৃক দুই দফায় সশস্ত্র হামলার শিকার হয়। দ্বিতীয় দফায় ছাত্রলীগ বহিরাগতদের নিয়ে ভিসি’র বাসভবনে হামলা চালায়। এই হামলায় পেট্রোল বোমা, শটগান, রামদা, চাপাতি ও দেশীও অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্রলীগ। ওই হামলায় জাবি’র কতিপয় শিক্ষক, স্থানীয় এমপি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন ও মদত দেন।
গত ১৫ই জুলাই বিকাল ৪টা। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বটতলায় জড়ো হন। ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জান সিনিয়র নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন ‘সাদ্দাম-ইনামের নির্দেশনা রয়েছে হামলা করতে হবে।’ ৪৩ ব্যাচের এনামুল হক এনাম ও আ-রাফি চৌধুরী, ৪৪ ব্যাচের ফরহাদ হোসেন, চিন্ময় সরকার, লেলিন মাহবুব, সাব্বির হাসান নাহিদ, ৪৫ ব্যাচের তৌহিদুল ইসলাম তাকিদ, সাজ্জাদ শোয়াইব চৌধুরীসহ কয়েকজন উগ্রতা দেখায়। তারা বলে, ‘আমাদের দেরি করা যাবে না, এখনই মারতেই হবে।’
বিকাল ৫টা। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার থেকে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি মেয়েদের হল ঘুরে সিএসই ভবন হয়ে বটতলায় সমাবেশ করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো। তখন শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি হাবিবুর রহমান লিটন বঙ্গবন্ধু হল থেকে জোবায়ের, শান্ত মাহবুব ও আকাশকে হল থেকে কর্মীদের নিয়ে আসতে বলেন। পরে ছাত্রলীগের একটি মিছিল বটতলা থেকে বের হয়ে নতুন রেজিস্ট্রার ভবন পর্যন্ত যায়। 
ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতি বলেন, মিছিলটি নতুন রেজিস্ট্রারে কার্যালয়ে পৌঁছালে ৪৪ ব্যাচের লেলিন মাহবুব ও আবুল কালাম আজাদ এসে জানায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে সিএসই বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে বটতলায় যাচ্ছে। তখন আমরা মোড় নিয়ে বটতলায় আসলে জান্নাতুল হোটেলের সামনে থেকে কাঠের খড়ি হাতে নেই। শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু হলের সামনে আসলে আমাদের সবাই একসঙ্গে গিয়ে হামলা শুরু করি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। শিক্ষার্থীদের ওপর দেশীও অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের হামলা শুরু হয়। ৩০ জন গুরুতর আহত হন। পরে শিক্ষর্থীরা প্রতিহত শুরু করতেই ছাত্রলীগ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এতে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন আহত হন। ৪৪ ব্যাচের চিন্ময় সরকার, আল ফারুক ইমরান, ৪৭ ব্যাচের আওলাদ হোসেন, ৪৯ ব্যাচের পদার্থ বিভাগের জাহিদসহ কয়েকজন নেতাকর্মী সিএসই ভবনে আটকা পড়েন। এতে তারা গুরুতর আহত হন। রাত সাড়ে ১০টা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগ বৈঠক বসায়। বৈঠকে চিন্ময়, তাকিদ, লেলিন মাহবুব, আরাফাত ইসলাম বিজয় সভাপতি-সেক্রেটারিকে পাল্টা হামলা চালানোর জন্য জোর দিতে থাকেন। সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ ব্যাচের আল-রাজি সরকার বলেন ‘এখনই আক্রমণ করতে হবে আপনারা সিনিয়ররা ‘বাল ফ্যালান’। আমাদের ক্যাম্পাসে তো আর সম্মান রইলো না।’ তখন দ্বিতীয়বার হামলার সিদ্ধান্ত হয়। 
রাত ১১টা। আকতারুজ্জামান সোহেল ফোন দিয়ে ৪১ ব্যাচের তারেক, জোবায়ের এবং সেক্রেটারি হাবিবুর রহমান লিটন ফোন দিয়ে পাথালিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম ওরফে ইয়াবা তৌহিদ, ৩৯ ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী শামীম মোল্লা ও ৪১ ব্যাচের মিজানকে ফোন দিয়ে আনে। এ ছাড়াও ফোন দিয়ে কলমা, পান্ধোয়া বাজার, সাভার, বাইপাইল ও আশুলিয়া ছাত্রলীগের সেক্রেটারি তুহিনকে অস্ত্রসহ কর্মী নিয়ে আসতে বলেন। ক্যম্পাসের ছাত্রলীগ কর্মীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা নাও চালাতে পারে তাই সিন্ধান্ত হয় বহিরাগতরা সামনের দিকে থাকবে। 
এদিকে বৈঠকে ৪৪ ব্যাচের আবু ওয়ালিদ, অর্থনীতি বিভাগের ৪৬ ব্যাচের জাহিদ হাসান লিমন পেট্রোল বোমা বানাতে চায়। তখন ৪৪ ব্যাচের আবুল কালাম আজাদ ও লেলিন মাহবুব কাঁচের বোতল আনার সিদ্ধান্ত নেয়। মীর মশাররফ হোসেন হলের ৪৭ ব্যাচের তিতাস, মোস্তাকিম জুনিয়রদের নিয়ে ভ্যানে করে হলের সামনে থেকে কাঁচের বোতল নিয়ে যায়। সভাপতির নির্দেশে বঙ্গবন্ধু হলের নিচতলার একটি রুমে পেট্রোল বোমা বানানো হয়। হলের বাইক থেকে পেট্রোল সংগ্রহ করা হয়।
৪১ ব্যাচের মিজান, তারেক, জোবায়ের ইসলামনগর থেকে ১৫টি রামদা ও লোকজন নিয়ে হলের সামনে আসে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, সিনিয়রদের মধ্যে আজাদ, এনাম, লেলিন, তাকিদ, আল রাজি, মিজান, সাজ্জাদ, হাসান মাহমুদ ফরিদ, বিপ্লব ও আমিসহ সবাই একটা করে রামদা নিলাম। আর বাকিরা যে যার অস্ত্র ম্যানেজ করলো। এদিকে ৪৪ ব্যাচের আল ফারুক ইমরান ও দেলোয়ার হোসেনকে টিভি মিড়িয়ায় বক্তব্য দেয়ার জন্য সভাপতি পাঠায়। তারা একটি বেসরকারি মিড়িয়ায় বক্তব্য দেন।  
মাওলানা ভাসানী হল থেকে ৪৩ ব্যাচের রাকিবুল ইসলাম সজীব (কাটাপ্পা), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রাকীব, সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে রামদা হাতে  আদনান শাকিল, হারুন অর রশিদ (ম্যানেজমেন্ট ৪৭), বখতিয়ার (দর্শন ৪৭), বিকাশ (৪৫ ব্যাচ), নাহিদ হোক জয় (৪৫ ব্যাচ) বের হয়ে আসে।
আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল থেকে ৪৪ ব্যাচের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের মো. আবু ওয়ালিদ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মো. ফরহাদ হোসাইনের নেতৃত্বে ৪৫ ব্যাচের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রাশেদুল ইসলাম শিমুল, অ্যাকাউন্টিং তৌকির আহমেদ রোমান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের মুহিত হাসান জয়, ৪৬ ব্যাচের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের রাইহান, তৌহিদুল ইসলাম জিহাদ, ওয়াহিদ তাওসীফ অনিক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের রিফাত, আইন বিভাগের সায়েদুল মুরসালিন হৃদয়। ৪৭ ব্যাচের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের আরশাদ গালিব হিমেল, আরেফিন আলম সানি, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের  আবির হাসান, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের রিশাদ দেশীও অস্ত্র নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।

এদিকে সরকার ও রাজনীতির বিভাগের ফরহাদ হোসেন নিজ প্রভাব খাটিয়ে হল মসজিদে নিজের ভাইকে নিয়োগ দেন। ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালেও হল প্রভোস্ট ফিরোজ উল হাসান নিজ বিভাগেরও হওয়া প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগটা দখলে নেন। এদিকে জাহিদ হাসান লিমন তার ছোট ভাই স্থানীয় সন্ত্রাসী জাহিদুল হক সময়কে অস্ত্রসহ লোকজন নিয়ে আসতে বলে। এ ছাড়াও স্থানীয়রা পিকআপ ভ্যানে করে গেরুয়া বাজার হয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। শহীদ সালাম বরকত হল থেকে ৪৪ ব্যাচের আরাফাত ইসলাম বিজয়, ৪৬ ব্যাচের সেজান, ৪৭ ব্যাচের জোয়াদ, তানভীরকে অস্ত্র হাতে দেখা যায়।  
আল-বেরুনী হলের হলের ৪৩ ব্যাচের এনামুল হক এনাম, ৪৪ ব্যাচের চিন্ময় সরকার, এস কে নাহিদ, ৪৫ ব্যাচের রকির নেতৃত্বে অন্য বঙ্গবন্ধু হলের সামনে জড়ো হন। শহীদ রফিক-জব্বার হল থেকে ৪৪ ব্যাচের সাজ্জাদ হোসাইন, সাব্বির হোসেন নাহিদ, ৪৫ ব্যাচের সাজ্জাদ শোয়াইব চৌধুরীর নেতৃত্বে অন্য হল থেকে বের হয়ে আসে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল থেকে ৪৩ ব্যাচের আরাফি চৌধুরী, ৪৫ ব্যাচের তৌহিদুল ইসলাম তাকিদের নেতৃত্বে হল থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে আসেন। শেখ রাসেল হল থেকে ৪৬ ব্যাচের জোবায়েদ আশিক ও ৪৭ ব্যাচের অলক কুমার পালের নেতৃত্বে অন্য হলে থেকে আসে।
রাত সাড়ে ১২টায় ছাত্রলীগ দুই শতাধিক নেতাকর্মী ও বহিরাগতদের নিয়ে ভিসি বাসভবনে হামলা চালায়। এর আগে ৪১ ব্যাচের অভিষেক মণ্ডল ও ৪২ ব্যাচের রতন কুমার বিশ্বাস বাইকযোগে এসে ভিসি’র বাসভবনে ঘুরে যান। পরে হামলার সঙ্গে তাদের দেখা যায়। ছাত্রলীগ আসতে দেখে শিক্ষার্থীরা ভিসি’র বাসভবনে আশ্রয় নেয়। শিক্ষার্থীরা বারবার প্রার্থনা করলেও ভিসি তার বাসভবন খুলে দেননি। এ সময় বাসভবনের ভিতরে শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক বশির আহমেদ, অধ্যাপক আলমগীর কবির, অধ্যাপক তাজউদ্দিন শিকদার ও সহযোগী অধ্যাপক ফিরোজ-উল-হাসান উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ আছে, এই শিক্ষকরা ছাত্রলীগকে জানান শিক্ষার্থীরা ভিসির দুয়ার ভেঙ্গে ভিতরে হামলা শুরু করেছে। পরে ছাত্রলীগ পুলিশের উপস্থিতিতে পেট্রোলবোমা ভিসির বাসভবনে মারতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ভিসি’র বাসভবনের প্রধান ফটক ভেঙে ভিতরে ঢুকে হামলা চালায়। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারিকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

 

 

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status