বিশ্বজমিন
সিরিয়ায় নিহত কে এই কমান্ডার রেজা জাহেদি!
মানবজমিন ডেস্ক
(৯ মাস আগে) ৩ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ৫:২০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৮:০৭ অপরাহ্ন
দামেস্কে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদি। ২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের কুদস ফোর্সের ৬২ বছর বয়সী কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি। তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রেজা জাহেদি। তার জন্ম ১৯৬০ সালের ২রা নভেম্বর ইস্ফাহানে। ২২ বছর বয়সে ১৯৭৯ সালে নবগঠিত আর্মি গার্ডিয়ান অব দ্য ইসলামিক রেভ্যুলুশনে যোগ দেন সোলায়মানি। এই বাহিনীই আইআরজিসি নামে সুপরিচিত। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় পরের বছর এই বাহিনীতে ২০ বছর বয়সে যোগ দেন জাহেদি। ইরান-ইরাক যুদ্ধের আট বছরে কুদস ফোর্সের স্পেশাল অপারেশনের বড় পদে এই দুই নেতাই নিজেদের জায়গা করে নেন। ১৯৯৮ সালে কুদস ফোর্স লেবানন কোরের কমান্ডার হিসেবে রেজা জাহেদিকে নিয়োগ দেন সোলায়মানি। নিজে এই পদে ছিলেন ২০০২ সাল পর্যন্ত। পরে ২০০৮ সালে আবার তাকে একই পদে নিয়োগ করা হয়। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের শাসকগোষ্ঠীকে সহায়তা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। পাশাপাশি সিরিয়া হয়ে হিজবুল্লাহর কাছে ইরানের অস্ত্রের শিপমেন্ট দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে।
কাসেম সোলায়মানির মতো সোমবার রাতে রেজা জাহেদিও আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তার ওপর ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইসরাইল। পূর্বেই হামলার বিষয়ে কোনো সতর্কতা দেয়া হয়নি। মৃত্যুকালে রেজা জাহেদির বয়স ছিল ৬৩ বছর। আইআরজিসির মতে, ওই হামলায় নিহত হয়েছেন প্রায় ১২ জন। এর মধ্যে আছেন রেজা জাহেদি, তার সিনিয়র তিনজন কর্মকর্তা, ৬ জন সিরিয়ান। নিহত ইরানি অন্য তিন কর্মকর্তা হলেন সাঈদ ইজাদি, আবদোল রেজা শাহলাই এবং আবদুল রেজা মোসজেদজাদেহ। এর মধ্যে সাঈদ ইজাদি বৈরুতে কুদস ফোর্সের প্যালেস্টাইন ডিভিশনের প্রধান। আবদুল রেজা শাহলাই ইয়েমেনে আইআরজিসির অপারেশন কমান্ডার। আবদুল রেজা মোসজেদজাদেহ ইরাকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিষয় দেখাশোনা করতেন।
এই হামলা নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসরাইল। আর জড়িত থাকার কথা তো পরে। ইরান দূতাবাস বলেছে, ইসরাইলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ওই ভবনের ওপর ৬টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। পরে নিউ ইয়র্ক টাইমস ইসরাইলি একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করেছে। ওই কর্মকর্তা তাদের কাছে নিশ্চিত করেছেন যে, এই হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। হামলার পর ওই ভবন থেকে তোলা বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে বিশাল একটি পোস্টারে সোলায়মানির ছবি ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায়। এই অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু বাকি অংশ ধরে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এই হামলার পর পরই সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মেকদাদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বলেছেন, এই নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার কড়া নিন্দা জানাই আমরা।
হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন সিরিয়ায় ইরানের রাষ্ট্রদূত হোসেন আকবরি। তিনি ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিকে বলেছেন, হামলায় কূটনীতিক সহ অনেকে নিহত হয়েছেন। এর কঠোর জবাব দেবে তেহরান। ওদিকে লেবাননে যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহও ক্ষিপ্ত। তারাও এই হামলার বদলা নেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বলেছে, শত্রুদের উপযুক্ত শাস্তি ও প্রতিশোধ না নিয়ে এই অপরাধকে ছেড়ে দেয়া হবে না। ইরানের দূতাবাসে শত্রুদের হামলার পুরনো ইতিহাস আছে। কিন্তু এতদিন এসব হামলায় জড়িত থাকতো দাঙ্গাবাজ লোকজন বা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। ১৯৮৩ সালে বৈরুতে মার্কিন দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ৬৪ জন। এই হামলা চালায় ইরানপন্থি একটি গ্রুপ। ১৯৯৮ সালে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে আল কায়েদা ট্রাকবোমা হামলা চালায়। এতে কমপক্ষে ২২৩ জন নিহত হন। কিন্তু কোনো দেশের কূটনৈতিক মিশনে বা কূটনীতিকদের ওপর এমন হামলায় একটি রাষ্ট্র সরাসরি জড়িত, এমনটা শুধু বিস্ময়করই নয়, একই সঙ্গে এর নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, ওমান, পাকিস্তান, কাতার ও রাশিয়া। সরাসরি এই হামলার নিন্দা জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, এই অঞ্চলে যুদ্ধের উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করতে পারে এমন যেকোনো বিষয়ে উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন।
মঙ্গলবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি রিপোর্টে বলেছে, দেশের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ইসরাইলের এই হামলার জবাব দেয়া হবে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। উল্লেখ্য, রেজা জাহেদি হলেন আইআরজিসির তৃতীয় সিনিয়র কমান্ডার, যাকে গাজা যুদ্ধে হত্যা করা হলো। তার এই মৃত্যু কুদস ফোর্সেসের জন্য বড় এক ক্ষতি। কারণ, চার বছর আগে তার সিনিয়র কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে মারা গেছেন হোসেন হামেদানি। তাকে সিরিয়ার আলেপ্পোতে হত্যা করে দায়েশ। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হিসেবে প্রথম মারা যান হোসেন হামেদানি। সিরিয়ায় আইআরজিসির লজিস্ট্রিক্স প্রধান সাঈদ রাজি মুসাভিকে ডিসেম্বরে হত্যা করা হয়। তিনি সিরিয়া ও ইরানের মধ্যে সামরিক জোটের সমন্বয়ক ছিলেন। দামেস্কের বাইরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে তাকে হত্যা করা হয়। এর দায় দেয়া হয় ইসরাইলকে। দামেস্কের পশ্চিমে একটি এলাকায় সিরিয়ায় আইআরজিসির গোয়েন্দা অপারেটিভ হুজাতোল্লাহ আমিদভারকে হত্যা করা হয় জানুয়ারিতে।
ইরানের বার্তা সংস্থা মেহর-এর মতে, আইআরজিসিতে উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক কিছু ভূমিকায় ছিলেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ৪৪তম কমর বানি হাশিম ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। তারপর ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সময়ে ১৪তম ইমাম হোসেন ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন। ২০০৫ সাল নাগাদ তিনি আইআরজিসির স্থল বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এই পদে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি কুদস ফোর্সের সিরিয়া ও লেবানন শাখার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞায় পড়েন।