ঢাকা, ১২ মে ২০২৪, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

বেঁচে ফেরাদের মুখে ভয়াবহ বর্ণনা

মরিয়ম চম্পা
৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার
mzamin

ঢাকার একটি কলেজ থেকে সম্প্রতি এইচএসসি পাস করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন কাজী নওশেদ আনাম। লিপ ইয়ার ২৯শে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি ধরে রাখতে বন্ধুদের সঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে।  সেখানে অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫ম তলায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কাজী নওশেদ আনামের এক আত্মীয় সজল চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মানবজমিনকে বলেন, এবার ওর আর পরীক্ষা দেয়া হলো না। জীবন নিয়ে যেখানে আশঙ্কা সেখানে পরীক্ষা তো অনেক দূরের বিষয়। ওরা চার বন্ধু মিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে ভবনের দ্বিতীয় তলায় খেতে ওঠেন। এরপর রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে হঠাৎ দেখেন আগুন। একের পর এক বিস্ফোরণ হতে থাকে। 

বাঁচার জন্য নওশেদ আনাম ভবনের উপরের দিকে উঠতে থাকেন। নওশেদ ভেতরে আটকা পড়লেও তার বাকি তিন বন্ধু জীবন বাঁচাতে লাফ দিয়ে বাইরে বের হয়ে যান। কোনো উপায় না দেখে ভবনের উপরের দিকে উঠতে থাকে নওশেদ।

বিজ্ঞাপন
এভাবে ছয় তলার উপর উঠে যায়। ছাদে অনেক মানুষের ভিড় দেখে ছয় তলায় চলে আসে। ওখানে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে। গোটা ভবন তখন ধোঁয়ায় অন্ধকার ছিল। বিদ্যুৎ নেই। মোবাইলের আলো জ্বালিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ছয় তলার ওই রেস্টুরেন্টের কিচেন-বারান্দার রেলিংয়ের মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখান থেকে বের হয়ে জানালার কাছে ডিশ লাইনের কিছু তার ঝুলছিল। ওই তার বেয়ে দুই তলা পর্যন্ত নেমে আসেন। এ সময় দেখেন ডিশের তার শেষ। এদিকে ওর দুই হাত কেটে রক্ত পড়ছিল। কোনো উপায় না দেখে পরে দুই তলা থেকে নিচে লাফ দেন। এ সময় নিচে পড়ে গিয়ে কোমরে এবং হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এ ছাড়া ওর শ্বাসনালী পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। নিচে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নওশেদ ফোন দিয়ে ওর বাবা এবং পরিবারের সদস্যদের জানায়। 
রাকিবুল ইসলাম। বয়স ২৬ বছর। বেইলি রোডের ওই ভবনে অবস্থিত একটি কাপড়ের দোকানে সেলস ম্যানের কাজ করতেন। বর্তমানে হাসপাতালের ৫ তলায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় রাকিবুলের বাবা মো. নজরুল ইসলামের। তিনি বলেন, দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর সূত্রাপুরে থাকি। যখন ভবনটিতে আগুন লাগে তখন রাকিবুল বাথরুমে ছিলেন। চারদিকে যখন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছোট ভাইকে ফোন দিলে বন্ধুদের নিয়ে ভাইকে উদ্ধার করতে ভবনের কাছে চলে যায়। এ সময় রাকিবুল সবাইকে বারবার ফোন দিয়ে বলছিলেন আমি ভবনে আটকা পড়েছি। আমাকে বাঁচাও। উদ্ধার করো। তখন বন্ধুদের সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ভাই ভবনে প্রবেশ করে। পরে বাথরুমের গ্লাস ভেঙে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। ভবনে প্রচণ্ড ধোঁয়ায় শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এ ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। 
বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে যান ব্যবসায়ী ফিরোজ আল মামুন ফয়সাল। দুটি পাঞ্জাবি পছন্দ করে টাকা পরিশোধ করছিলেন। ঠিক তখনই শুনতে পান ভবনটিতে আগুন লেগেছে। তাড়াহুড়ো করে ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে যান ফিরোজ আল মামুন। কিন্তু বের হতে পারেননি। মামুন অভিযোগ করে বলেন, আগুন লাগার পর ভবনের গেট তালা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় কেউ বাইরে বের হতে পারছিল না। আবার সিঁড়ি বেয়ে তিন তলার পাঞ্জাবির ওই দোকানে ঢুকে পড়েন ফিরোজ আল মামুন। ততক্ষণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে পুরো কক্ষ। বিদ্যুৎও ততক্ষণে চলে গেছে। পুরো ভবনেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ওই কক্ষে অনেকের সঙ্গে আটকে ছিলেন ফিরোজ আল মামুন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর তাকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। 
শনিবার দুপুরে হাসপাতালে বিছানায় বসে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তখন মেঝেতে  শুয়ে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। পাঞ্জাবি ও রুমাল ভিজিয়ে মুখে পানি দিচ্ছিলেন। বেঁচে ফেরার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফিরোজ আল মামুন বলেন, তখন একেক সেকেন্ডকে ১ ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছিল। আমার ১০ মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। শুধু বাবা বলে ডাকতে পারে। ওই ভয়াল সময়টাতে শুধু মেয়ের ছবিটা চোখের সামনে ভাসছিল। ওর জন্য কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। আগুন লাগার খবর পেয়ে বাবা বারবার ফোন করছিলেন। কয়েকবার বাবার ফোন কেটে দিলেও বেঁচে ফিরবেন কিনা আর দেখা হবে কিনা সেটা ভেবে পরে বাবার ফোন ধরে দোয়া করতে বলেন। ফিরোজের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলায়। পরিবার নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন। সেখানে স্টার প্যাকেজিং নামে তার একটি কারখানা রয়েছে। দগ্ধদের বিষয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে মোট ১৪ জন আহত হয়ে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে চিকিৎসা শেষে অবস্থার উন্নতি হলে ৩ জনকে ঘটনার দিন ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর শনিবার বাকি ৬ জনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়। বর্তমানে ৫ জন ভর্তি আছেন। তারা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন। তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। খুব দ্রুতই তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা করছি।  
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status