দেশ বিদেশ
সরজমিন দোয়ারাবাজার
ঘরে ঘরে খাবারের কষ্ট
শুভ্র দেব ও মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী, দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) থেকে
২৫ জুন ২০২২, শনিবারসুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের নৈনগাঁও গ্রামের আব্দুর রহিম। চোখে দেখেন না জন্ম থেকে। পাঁচ সন্তানকে রেখে স্ত্রী মারা গেছেন বছরখানেক আগে। দৃষ্টিশক্তি না থাকায় কাজ করতে পারেন না। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে মানুষের সহযোগিতায় সংসার চালান। এবারের বন্যায় রহিমের ভাঙা ঘরে ছিল হাঁটু সমান পানি। এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই ছিল না। তাই ৫ সন্তানকে নিয়ে ঘরের ভেতরেই ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা ৫ দিন ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে সেখানেই না খেয়ে ছিলেন। আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু শুকনা খাবার বিতরণ হলেও বাড়িতে থাকার কারণে তার পরিবারের ভাগ্যে জুটেনি কিছু। দুদিন হলো ঘর থেকে পানি নেমেছে। গতকাল এলাকার এক প্রবাসী ত্রাণ বিতরণ করেছেন। সেখান থেকে ১০ কেজি চাল, আলু, ডাল, পিয়াজ, তেল আর মুড়ি পেয়েছেন। ত্রাণ পাওয়ার পর আনন্দে কেঁদে ফেলেন রহিম। এ সময় তার সঙ্গে থাকা শিশুকন্যা মিমের মুখেও ছিল আনন্দের হাসি। বন্যার ছোবলের ৮ দিনের মাথায় হাসি ফুটেছে আব্দুর রহিমের। তার মতো ত্রাণ পেয়ে দোয়ারাবাজার ইউনিয়নের আরও কিছু মানুষের মুখেও হাসি ফুটেছে। আব্দুর রহিম বলেন, জন্ম থেকেই আমাদের খাবারের কষ্ট। দুনিয়াতে এটা আমাদের কঠিন পরীক্ষা। নিজে কয়েকদিন না খেয়ে থাকতে পারবো।
কিন্তু ছোট ছোট সন্তানদের জন্য সমস্যা। তারা তো অভাব অনটন বা বন্যা কিছুই বুঝে না। আব্দুরে রহিমের বাড়ি সড়কঘেঁষা। শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে ত্রাণ জুটলেও দোয়ারাবাজার উপজেলার হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধার্ত। কারণ নিম্নাঞ্চলের অনেক বাড়ি থেকে পানি নামলেও তারা ঘর থেকে নৌকার অভাবে বের হতে পারছেন না। তাদের কাছে কেউ ত্রাণ নিয়ে যায় না। নৌকা না থাকায় তারাও বাজার থেকে কিছু কিনতে পারেন না। এ ছাড়া বন্যায় এলাকার বাজারের দোকানপাট ভেঙে চুরমার হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা নতুন করে দোকান সাজাচ্ছেন। মুদির দোকানের সমস্ত মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। দোকানে খাবার সংকট চরমে। ব্যবসায়ীরা টাকার অভাবে পণ্য আনতে পারছেন না। অল্প পণ্য নিয়ে আসলে সেগুলো কাড়াকাড়ি করে কিনে নিয়ে যাচ্ছে ক্ষুধার্তরা। সরজমিন দোয়ারাবাজার উপজেলার দোয়ারাবাজার ইউনিয়নের তেগাঙ্গা, মাইজখলা, বড়বন, রায়নগর, বাগড়া, সুন্দরপই, বাজিতপুর, মাজেরগাঁও, মংলারগাঁও, নৈনগ্রাম, মুরাদপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বাড়ি ঘর থেকে পানি নামছে। কেউ কেউ বিধ্বস্ত বাড়িগুলো গুছাচ্ছেন। লেপ তোষক, বালিশসহ অন্য আসবাবপত্র শুকাচ্ছেন। ইউনিয়নের নৈনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুহিবুর রহমান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দোয়ারাবাজার মডেল স্কুল, নৈনগাঁও মহিলা মাদ্রাসা, দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজ, ব্র্যাক অফিসের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ চলে গেছেন বাড়িতে।
বেশি ক্ষতিগ্রস্তরাই এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দোয়ারাবাজার ইউনিয়ন ছাড়া সুরমা ইউনিয়ন, দোয়ালিয়া ইউনিয়ন, বাংলাবাজার ইউনিয়ন, নরসিংহপুর ইউনয়ন, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন, মান্নারগাঁও, পাণ্ডারগাঁও, বোগলাবাজার ইউনিয়ন ঘুরে দেখা বন্যার আগ্রাসী ছোবলে এসব এলাকার গ্রাম থেকে গ্রাম ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের ঘরের সবকিছু বানের জলে ভেসে গেছে। কারও কারও পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ আছেন। দুর্গম এলাকা হওয়াতে এসব ইউনিয়নের মানুষ বন্যার সময় নিরাপদে আসতে পারেননি। পানিবন্দি হয়ে না খেয়ে ছোট বড়রা নির্ঘুম কাটিয়েছেন। এখন পানি কমলে ক্ষুধার কষ্ট চলছে। সুরমা ইউনিয়নের শরীফপুর, কালিকাপুর, কদমতলী, আলীপুর, গিরিশনগর, ইসলামপুর, শিমুলতলা ও দোয়ালিয়া ইউনিয়নের বেরি, নেমতুর, গোরেশপুর, শিবপুর, নোয়াগাঁও, কান্দাগাঁও গ্রামের মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় জনদুর্ভোগ বাড়ছে। রাস্তাঘাট ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানি বাহিত রোগবালাইয়ের প্রকোপ বেড়েছে।
বন্যার পানি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও বসতভিটায় মাথাগোঁজার মতো পরিস্থিতি নেই। বানের তোড়ে বসতভিটা ভেসে যাওয়া অসংখ্য মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। কিছু কিছু গ্রামের হাজার হাজার মানুষ এখনো আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করছে। কোথাও ত্রাণের খবর পেলে অসহায় বানভাসি মানুষজন কোমর পানিতে সারি সারি লাইনবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। রাত পোহালেই ত্রাণের জন্য শত শত নারী পুরুষ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পিআইও অফিস, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছে। সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ বলেন, বন্যায় কাবু হয়ে পড়েছেন গ্রামের মানুষ। খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘরের বেহালবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই কোথাও। সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অন্তত তিন শতাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বানের তোড়ে ভেসে গেছে বেশকিছু বসতঘর। এ ইউনিয়নের ৯০ ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। যা বরাদ্দ হয় তার চেয়ে তিনগুণ বেশি চাহিদা রয়েছে। উপজেলা সদরের খেসরি মালা বলেন, বন্যায় বসতঘর তলিয়ে গেলে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছি।
দুইদিন দুই বেলা খিচুড়ি এবং এ পর্যন্ত চিঁড়া-মুড়ি ছাড়া আর কিছুই পাইনি। ত্রাণ নিতে গিয়ে হয় মারামারি, তাই কোথাও যেতেও পারছি না। বোগলাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মিলন খান বলেন, বোগলাবাজার ইউনিয়নের অন্তত তিনশ’ বাড়িঘর বিধ্বস্ত এবং অর্ধশত ঘর পানির স্রোতে ভেসে গেছে। খাদ্য সংকট চরমে। ইদুকোনা-রামনগর পর্যন্ত চিলাই নদীর বেড়িবাঁধের ১৮টি স্থানে ভেঙে ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে বসতঘর। সবক’টি সড়ক ভেঙে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। উপজেলা সদরের বাজিতপুর গ্রামের ব্রিজ পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ায় কয়েকটি গ্রামের মানুষ চরম বিপাকে রয়েছেন। দোহালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শামীমুল ইসলাম শামীম বলেন, বন্যায় আমার ইউনিয়নের অন্তত দুই শতাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, খাসিয়ারা নদীর বেড়িবাঁধ একাধিক স্থানে বড় বড় ভাঙনের ফলে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আম্বিয়া আহমদ বলেন, উপজেলায় এ পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয় চালসহ শুকনো খাবার। ৯ সহস্রাধিক বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে সরকারি বরাদ্দ বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানি কমতে থাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে।