ঢাকা, ৫ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

জনপ্রতিক্রিয়া

জীবন আর চলছে না

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবারmzamin

হাজেরা বেগম বলেন, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। তিন বছর আগে শ্বাসকষ্টে স্বামী মারা যায়। ছোট ছোট মোটা করে থানকুনি ও কচুশাক বিক্রি করি। নরসিংদীতে অন্যের চাষের জমিতে মালিকের ফসল উঠার পর এই শাকগুলো থেকে যায়। পরে এগুলো আমরা উঠিয়ে ঢাকা এনে পাইকারি দামে বিক্রি করি। গ্রামের এই শাকের চাহিদা কম। সকালে শাক উঠিয়ে সেগুলো বস্তা ভরে নরসিংন্দী থেকে রওনা দেই। বিকালে এসে এই বাজারে বসে এলোমেলো শাকগুলো ছোট ছোট মুঠা তৈরি করি। একমুঠা ৫ টাকা দামে বিক্রি হয়।  কিন্তু এই শাকগুলো সবসময় থাকে না।

বিজ্ঞাপন
এজন্য সপ্তাহে দুইদিন আসতে হয় শাক নিয়ে। আমার মেয়ে ও নাতনি নিয়ে আমার সংসার। একমাত্র ছেলে রিকশা চালিয়ে কোনোমতে তার সংসার চালায়। এই আয় দিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চলে। মাছ-মাংস খেতে পারি না। নিজেদের কোনো চাষের জমি নেই। এই ব্যবসায় আমার যাতায়াত ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। সবসময় শাক পাওয়া যায় না। তখন সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়।

হাসনা খাতুন
স্বামী অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। তাই আমারই মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালাতে হয়। চারজনের পরিবার। বাজারের যেই অবস্থা। পেট ভরে খেতে পারি না। বাচ্চা দুইটা ছোট। তাদের মুখে যে একটু ভালো-মন্দ তুলে দেবো তার উপায়ও নেই। মাছ, মাংস, দুধ, ডিমতো দূরের কথা- ভালো সবজিও এখন ১শ’ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। তাই  যেই কয়টা টাকা পাই তা দিয়ে কোনো রকম নাকে-মুখে গুঁজে দিয়ে দিন কাটাই। মোহম্মদপুর ঢাকা উদ্যান এলাকায় ওএমএস’র ট্রাক সেলের কম দামে চাল কিনতে এসে কথাগুলো বলছিলেন হাসনা খাতুন। তিনি বলেন, দেশে এত উন্নয়ন হয়। এতো মানুষ এতো কিছু করে। কিন্তু আমাদের কথা কেউ ভাবে না। ১০ বছর আগেও আমরা বস্তিতে ছিলাম। এখনো সেইখানেই পরে আছি। উল্টো দিনকে বস্তির ভাড়া বেড়েই চলেছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এই কষ্ট থেকে কবে মুক্তি পাবো তার ঠিক নেই।   

ইমদাদ হোসেন
ইমদাদ হোসেনও ঢাকা উদ্যান এলাকায় এসেছিলেন ওএমএস’র ট্রাকসেলের চাল কিনতে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও চাল না পাওয়ায় খালি হাতে ফিরতে হয় তাকে। ইমদাদ বলেন, বাজারের যেই অবস্থা আমাদের মতো লোকের কোনো কিছু কিনে খাওয়ার কায়দা নেই। মোটা চালও এখন ৬০ টাকা কেজি। তাই একটু কম দামে পাবো বলে ট্রাকে চাল কিনতে আসছিলাম। তাও পেলাম না। ঘরে চাল নেই। এখন বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে কেনা লাগবে। তিনি বলেন, গরুর মাংসতো দূরের কথা এখন বাজারে একটা মাছ ৫শ’ টাকার নিচে হয় না। ডিম ৫০টাকা হালি। সবজি ৬০ টাকার নিচে নেই। এমন বেশি দিন চললে আমাদের মতো লোকের টিকে থাকা দায় হয়ে যাবে।  

রহমত মিয়া
মোহম্মদপুর টু শ্যামলী রুটে লেগুনা চালান রহমত মিয়া। বাজারের কথা শুনতেই ক্ষোভ ঝাড়লেন তিনি। বলেন, আমাদের বাজারে কারোর নজর নেই। এমন কোনো জিনিস নেই যে তার দাম বাড়েনি। চাল, ডাল, তেল, মশলা, আলু, পিয়াজ, সবজি, মাছ, মাংস সবকিছুর দাম বাড়তি। কোনোটায় হাত দেয়া যায় না। এমন চলতে থাকলে কয়েকদিন পর কেজি’র বদলে কাটা মাছ কেনা লাগতে পারে। তিনি বলেন, জমা বাড়াইছে। গাড়ি চালিয়ে জমার টাকা আর গ্যারেজ ভাড়া দেয়ার পর যে কয়টা টাকা থাকে তাই দিয়ে কোনোরকম সংসার চালাই। তাই বড় ছেলেটা ক্লাস ফাইভ পাস করার পর টাকার অভাবে আর সিক্স-এ ভর্তি করাতে পারিনি। কয়দিন ঘরে বসে ছিল। এখন আমার সঙ্গে গাড়িতে থাকে। যাত্রীদের টাকা ওঠায়। ছোট থাকতে চাইছিলাম পড়ালেখা করে অনেক বড় চাকরি করবে। কিন্তু এখন ওই আমার মতো গাড়ি চালাবে। কয়দিন খারাপ লাগতো। এখন সব সয়ে গেছে। 

মিরাজ
লেগুনাচালক মিরাজ। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়তি, তেলের দাম বাড়তি। এখন জমাও বাড়িয়েছে মালিক। সঙ্গে একটা ছেলে থাকে। গাড়ির ভাড়া ওঠায়। তাকেও কিছু দেয়া লাগে। এরপর যা থাকে তা নিয়ে আর বাজারে ঢোকা যায় না। সবকিছুর দাম বাড়তি। আমাদের মতো গরিব মানুষের আর ঢাকায় থাকার উপায় নেই। যেই কয়দিন পারি এভাবে চালাবো। তা না হলে গ্রামে চলে যাবো। 

শাবানা বেগম
মোহম্মদপুর বছিলা এলাকায় নির্মাণ শ্রমিক শাবানা বেগম। শাবানা জানান, বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। তাই কাজে এসেছি। মেয়ে মানুষ বলে অনেকেই কাজে নিতে চায় না। অনেক কষ্ট করে এই কাজটি জুটিয়েছি। সারা রাতে রিকশা চালিয়ে স্বামী সকালে ঘরে এসে ঘুমায়। তখন ছেলেটাকে নিয়ে আমি কাজে আসি। ছেলেটা খেলাধুলা করে আর আমি কাজ করি। যা পাই তা তুলে দিই স্বামীর হাতে। আয় কম তাই ছেলেকে স্কুলে দিতে পারিনি। 

ফিরোজ হোসেন
ফিরোজ হোসেন মুদি দোকানি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় বিক্রি কম। এখন মানুষ প্রয়োজন ছাড়া তেমন কিছু কিনে না। যেটুকু প্রয়োজন শুধু সেটুকুই কিনে। তিনি বলেন, আমরা তো কিনে এনে বিক্রি করি। বেশি দাম দিয়ে কিনি তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। দাম কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করবো। এখানে আমাদের তো কিছু নেই। এরপর বিভিন্ন অজুহাতে দোকান মালিক ভাড়া বাড়ায়। এদিকে বাসা বাড়িতেও একই অবস্থা। কারেন্ট বিল, পানির বিল বিভিন্ন কথা বলে বাড়িয়ালাও ভাড়া বাড়ায়। এর উপর ছেলে- মেয়ের লেখাপড়া, টিউশন, স্কুল ফি’তো আছেই। মাস গেলে ওষুধের খরচও আগের চেয়ে বেড়েছে কয়েকগুণ। সবমিলে আমরা মধ্যবিত্তরা চিঁড়েচ্যাপ্টা অবস্থায় আছি। 

আজিম সরকার
সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের চুনারচর গ্রামের বাসিন্দা আজিম সরকার। আগে শুধু সবজি চাষ করতেন। এখন কৃষি কাজের ফাঁকে চায়ের দোকান করেন। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে না পেরে বাড়তি আয় করতেই চা দোকান খুলেছেন। তারপরেও ভালো সময় যাচ্ছে না। দোকান চলে না। মানুষের কাছে টাকা না থাকলে চা খাইবো কীভাবে? দোকান ও কৃষি কাজ করেও পরিবারের প্রতিদিনের খরচ যোগাতে পারছি না। আবার বাজারে সবজির দাম চড়া হলেও ক্ষেত থেকে বিক্রির সময় তিন ভাগের একভাগ দামও পাই না। সবজি বাদে অন্য সব জিনিসের দাম শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি। শহরে ধরার লোক আছে। গেরামে দোকানিরা ইচ্ছামতো দাম নেন। ধরার কেউ নাই। বছর খানেক আগেও কিছুটা ভালো চলছিল। এখন আর পারছি না। ৫ মাস আগে তো ৫০ টাকার নিচে সবজি পাওয়া যেত। এখন ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। আমি লাউ শাক চাষ করি। শাক দিয়ে প্রতিদিন ভাত খেতে ভাল লাগে? যে জিনিস কিনতাম এক কেজি এখন কিনি আধা কেজি করে। সবজির দামের সাথে পাল্লা দিয়ে মাছ মাংসের দামও বেড়েছে। ইচ্ছা থাকলেও কেনার সাধ্য নেই। যা অবস্থা হইছে, এখন জমি বিক্রি করে খাইতে অইবো। নাইলে মরতে হবে। আগে সকালে ডিম রুটি খাইতাম, এখন খাই না। রুটি খাওয়ার টাকা নাই, ডিম’তো দূরের কথা। 

গফুর মোল্লা
সংসার খরচ চালাতে চাষাবাদের পাশাপাশি গরু পালন করতেন মাদারীপুরের আব্দুল গফুর মোল্লা। কিন্তু গরুতে এখন দুধ দিচ্ছে না। এতে বাজার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। সংসারের খরচ চালাতে কিছুদিন আগে একমণ পাট ২৩০০ টাকা বিক্রি করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে ২০০ টাকা দিয়ে সার কিনেছিলেন। বাকি টাকা সংসার খরচ চালানোর জন্য ব্যয় করেছেন। গফুর মোল্লা বলেন, ছেলে-মেয়েরা ইলিশ মাছ খাইতে চাইছে। বাজারে বড় ইলিশ মাছ দাম জিজ্ঞেস করে কিনতে পারি নাই। পরে ছোট ছোট এক কেজি ইলিশ কিনছিলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। ৪ পিস পাইছি। আর তরিতরকারি কিনছিলাম। কয়দিন আগেই তা খাওয়া শেষ। এখন বাজার করার টাকা নাই। 

হাজেরা বেগম
হাজেরা বেগম। ৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধা থানকুনি ও কচুশাক বিক্রি করে সংসার চালান। নরসিংন্দী থেকে সপ্তাহে দুইদিন তিনি ঢাকার কাওরান বাজারে আসেন শাক নিয়ে। সারারাত কাওরান বাজারে থাকেন। সকাল হলে আবার ফিরে যান গ্রামে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। হাজেরা বেগম বলেন, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। তিন বছর আগে শ্বাসকষ্টে স্বামী মারা যায়। ছোট ছোট মোটা করে থানকুনি ও কচুশাক বিক্রি করি। নরসিংদীতে অন্যের চাষের জমিতে মালিকের ফসল উঠার পর এই শাকগুলো থেকে যায়। পরে এগুলো আমরা উঠিয়ে ঢাকা এনে পাইকারি দামে বিক্রি করি। গ্রামের এই শাকের চাহিদা কম। সকালে শাক উঠিয়ে সেগুলো বস্তা ভরে নরসিংন্দী থেকে রওনা দেই। বিকালে এসে এই বাজারে বসে এলোমেলো শাকগুলো ছোট ছোট মুঠা তৈরি করি। একমুঠা ৫ টাকা দামে বিক্রি হয়।  কিন্তু এই শাকগুলো সবসময় থাকে না। এজন্য সপ্তাহে দুইদিন আসতে হয় শাক নিয়ে। আমার মেয়ে ও নাতনি নিয়ে আমার সংসার। একমাত্র ছেলে রিকশা চালিয়ে কোনোমতে তার সংসার চালায়। এই আয় দিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চলে। মাছ-মাংস খেতে পারি না। নিজেদের কোনো চাষের জমি নেই। এই ব্যবসায় আমার যাতায়াত ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। সবসময় শাক পাওয়া যায় না। তখন সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে আর ভালো-মন্দ কপালে জোটে না।

মিনু বেগম 
কাওরান বাজারে সবজি বিক্রেতা মিনু বেগম। তিনি বলেন, ৪০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। ঝুড়িতে অল্প কিছু সবজি নিয়ে রাস্তায় বসি। মিষ্টি কুমড়া, কচুর লতি এসব বিক্রি করি। সব সময় বিক্রি হয় না। এসব বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই। মগবাজারে একটি ছোট রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। শাক-সবজি সবসময় খাওয়া যায় না। মাছ-মাংসও কিনতে পারি না। সবজি নিয়ে এলে অনেকদিন বিক্রি হয় না ওইদিন চালানও উঠাতে পারি না। আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে। দুই ছেলেমেয়ে আছে। তাদের খরচ চালাতে হয়। মাঝে মাঝে ওরাও সবজি বিক্রি করে। দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। এই আয় দিয়ে সংসার চলে না। বাজারে কোনোকিছু কিনতে গেলে কিনতে পারি না ফিরে যেতে হয়। এই কাজ ছাড়া আর কি করবো- এই বয়সে অন্য কোনো কাজ করতে পারি না।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status