অর্থ-বাণিজ্য
অসহায় নারীদের ভাগ্য বদলেছে শম্পার ‘প্রেরণা’
আলতাফ হোসাইন, সাতক্ষীরা থেকে ফিরে
১২ জুন ২০২২, রবিবার
সমাজে নারীদের নানা বঞ্চনার কথা আমরা শুনে থাকি। তবে এই সমাজেই আবার কিছু নারী আছেন যারা সমাজের পিছিয়ে থাকা অন্য নারীদের জন্য হয়ে থাকেন প্রেরণার উৎস। তেমনই একটি প্রেরণার গল্প হয়ে উঠেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার শম্পা গোস্বামী। শম্পা গোস্বামী নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন একটি প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে শত শত নারী অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি পাচ্ছেন।
সমাজের জন্য যা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে যেসব অদম্য নারীরা কাজ করেন, তারা সমাজের অন্য নারীদের থেকে একটু আলাদা। জীবনচক্রে যাদের পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন কিছু সময়। কেউ স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘর ছাড়া, কেউ বা দারিদ্র্যের কষাঘাতে ভেঙে পড়া, কিংবা সমাজের অন্য কোনো নির্মম পরিহাসের শিকার তারা। বৈষম্যে ভরা সমাজের নানা বঞ্চনার শিকার হয়েও জীবিকার তাগিদে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। তবে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে তাদের আশ্রয় মিলেছে ‘প্রেরণা’ নামক এই সংগঠনের ছায়াতলে। ‘প্রেরণা’ তাদেরকে বেঁচে থাকার আশা জাগিয়েছে, দিয়েছে অর্থনৈতিকভাবেও মুক্তি। তাই এটি শুধু একটি সংগঠনই নয়, বরং অসহায় নারীদের ভাগ্য বদলের সিঁড়ি, একটি প্রতিষ্ঠান।
শম্পা গোস্বামী একজন স্কুল শিক্ষিকা। বিদ্যালয়ে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর পাশাপাশি অসহায় নারীদের ভাগ্য বদলের মাধ্যমে সমাজেও আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। এজন্য নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রেরণা’। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা সদরে অবস্থিত ‘প্রেরণা’র প্রধান কার্যালয়। ২০১৫ সালে কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে মাত্র সাত জন নারীকে নিয়ে কাগজের ব্যাগ তৈরির কাজ শুরু করেন। ছয় বছরের ব্যবধানে ‘প্রেরণা’র সদস্য সংখ্যা এখন ৩৫০ জনের বেশি। তাদের তৈরি কাপড়ের ব্যাগ বিক্রি হয় জেলার সব দোকানে। প্রতিটি ব্যাগ ৩ টাকা থেকে শুরু করে ১২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। প্রতি মাসে প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ পিস ব্যাগ তৈরি করে প্রেরণার নারীরা। কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয় ব্যাগ বিক্রির অর্থ থেকে। এ থেকে ‘প্রেরণা’র বার্ষিক আয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। যদিও এই অর্থ শম্পা গোস্বামী তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন না। সব অর্থ প্রেরণার উন্নয়ন কাজে দেয়া হয়। ফলে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি আরও বড় হচ্ছে।
প্রেরণার অফিসে যেয়ে দেখা যায়, কাপড় কাটা, লেবেল লাগানো, মেসিনে সেলাই কাজে ব্যস্ত নারীরা। শম্পা গোস্বামীর এই পথ চলাটা খুব সহজ ছিল না। ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। শম্পা বলেন, আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ১৬ বছরের কাছাকাছি। তখন আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টও আসেনি। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া নারীর জীবন কেমন হতে পারে তা আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি। যখন স্বল্প শিক্ষিত একটি মেয়ে যার আত্মসম্মান বোধ থাকবে তার প্রয়োজনে যদি কারও কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে হয় বা সবকিছু অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয় সেটা যে কত দুঃখজনক তা আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি।
এই জায়গা থেকে আমার মনে হতো আমার মতো যারা সুযোগ পায়নি, লেখাপড়ার সুযোগটা পাচ্ছে না তারা আসলে কি করবে? আমি বিশ্বাস করি সবারই কোনো না কোনো প্রতিভা থাকে, সেই প্রতিভাগুলোকে যদি কাজে লাগাতে পারি তাহলে নিশ্চয় একটা ভালো ফল বয়ে আনবে। ইচ্ছা থাকলেও সুযোগের অভাবে অনেক নারীরাই অনেক কিছু করতে পারে না। আমি ভেবেছিলাম সেই সুযোগটা যদি তৈরি করতে পারি, সেই জায়গাটা যদি তৈরি করে দিতে পারি তাহলে যাদের আগ্রহ আছে তারা নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে। ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। সেই স্বপ্নের জায়গা থেকে মনে হতো আমি নিজে যদি কখনো দাঁড়াতে পারি বা কিছু করতে পারি, তাহলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কিছু করবো। যখন আমি এসব ভাবতাম তখন আমার আইডিয়া কম ছিল, আমার সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু আমি যখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগদান করি সেখান থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজ শুরু করি। পরে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে একটি নারী সংগঠন গড়ে তুলি। এখন এই প্রতিষ্ঠানে অনেক নারী কাজ করছে। অনেকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতা পেয়েছে। আমার ছোট পরিসরে শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে আরও বড় হচ্ছে।
শম্পা গোস্বামী বলেন, সমাজে বেশির ভাগ গরিব নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়। আমি মূলত এইসব বৈষম্যের শিকার হওয়া নারীদের স্বনির্ভরশীল করতে চাই। কিন্তু একার পক্ষে তো সব সম্ভব না। যতটুকু পারি চেষ্টা করি। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসতে পারে। আমি স্বপ্ন দেখি; ‘প্রেরণা’ একদিন বড় দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো একটি প্রতিষ্ঠান হবে, সেখানে সমাজের যত গরিব, অসহায় ও বিধবা নারী আছেন তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। যাতে কোনো গরিব, অসহায় ও বিধবা নারীকে অন্যের উপর নির্ভর করতে না হয়।