দেশ বিদেশ
ইউএসএইড’র সহায়তার সুফল পাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর কিশোরীরা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবারমোছাম্মত জেসমিন খাতুন। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বয়ঃসন্ধিকাল পার করছেন এই কিশোরী। ভুগছেন স্বাস্থ্যগত জটিলতায়। কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারছেন না কিছু। বাব-মা’কেও বলতে সংকোচ হয়। এ ধরনের মানসিক সমস্যায় চিন্তিত কিশোর-কিশোরীদের বন্ধু-বান্ধবীর মতো স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দিচ্ছে ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের আওতাভুক্ত কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। পরামর্শ নেয়ার ফলে অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন। নিশ্চিত হচ্ছে কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য অধিকার। নিয়ন্ত্রণে এসেছে বাল্যবিবাহ। ফলে প্রতিদিনই সেবা গ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। ‘১০ থেকে ১৯শে আমরা তোমার পাশে’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে সরকার দেশের প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু করেছে। যেখান থেকে (স্বাস্থ্যকেন্দ্র) সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে নিয়মিত সচেতন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কাজ করছে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অন্যতম হলো বৈদেশিক সাহায্যকারী সংস্থা ইউএসএইড সুখী জীবন প্রকল্প, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ও বেসরকারি এনজিও লাইট হাউজের আয়োজনে যুবক ও কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনায় কাজ করছে। কর্ম এলাকার মধ্যে রয়েছে- ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত ওয়ার্ড এবং গাজীপুর জেলার ৫টি উপজেলা। এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সফল বাস্তবায়ন এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভূমিকা সরজমিন দেখার জন্য চলতি মাসে সাংবাদিক ও যুবসংগঠনের সদস্যদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল লাইট হাউজের আয়োজনে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের আওতাভুক্ত কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি পরিদর্শন করা হয়। এই কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নুসরাত জাহান বলেন, মহামারি করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশে ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে বাল্যবিবাহ। তবে করোনার পরে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর পর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বাল্যবিবাহ। এক্ষেত্রে কাজ করছে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা কিছু স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীরা স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতায় ভোগেন। মা-বাবার কাছেও লজ্জায় বলতে পারে না। অনেকেই মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এ ধরনের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দিচ্ছি। এর পাশাপাশি নারীদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীনসহ নানা চিকিৎসা দেয়া হয় এখানে। ঋতুস্রাবের সময় স্যানিটাইজার ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হয়। কিশোরদের স্বপ্নদোষ বা বীর্যপাতে শরীরে যে পরিবর্তন ঘটে সেই বিষয়ে ধারণা ও পরামর্শ দেয়া হয়। এ ছাড়া গ্রামে উঠোন পর্যায়ে বৈঠক করে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য সচেতন করা হয়। তিনি বলেন, এ কেন্দ্রটির পাশেই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। কিশোর-কিশোরীরা ক্লাস শুরুর আগে বা পরে এসে সেবা নিচ্ছে। এ ছাড়া আশেপাশের নারীরাও সেবা নিচ্ছেন। এতে অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন। ফলে প্রতিদিনই সেবা গ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানন, কিশোর-কিশোরীর প্রতি সহিংসতা এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ কৈশোরকালীন মানসিক বিকাশ একটি সুস্থ জাতি গঠনে সাহায্য করে। এজন্য কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত জরুরি। কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সমন্বিতভাবে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে নুসরাত জাহানের কথা বলার সময় কেন্দ্রটিতে সেবা নিচ্ছিলেন ১৫ থেকে ২০ জন নারী ও কিশোরী। এর মধ্যে কথা হয় মোছাম্মত জেসমিন খাতুনের সঙ্গে। এই কিশোরী বলেন, এখানে প্রথম এসেছেন তিনি। শরীরের কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিন্তিত ছিলাম। পরে আমার এক বান্ধবী এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসতে বলে। স্বাস্থ্য আপাদের বিভিন্ন পরামর্র্শ পেয়েছেন বলে জানান তিনি। এখন ভালো লাগছে। এই উপজেলার শুধু জেসমিন নয়, তার মতো আরও শত শত কিশোর-কিশোরী এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবা নিয়ে গড়ছেন আগামীর ভবিষ্যৎ। একই জেলা সদরের নীলের পাড়া নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র-২ এ দেখা গেছে, স্কুলপড়ুয়া পাঁচ থেকে ছয়জন কিশোরী এসেছেন স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়ে জানতে। কেন্দ্রটির স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক খাদিজা আক্তার বলেন, আগে কিশোরীরা আসতে চাইতো না। এখন আসার প্রবণতা বাড়ছে। কিশোরীদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের পরিবর্তনের বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়। অপুষ্টির শিকার কিশোরীরা গর্ভধারণ করলে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা কিশোর-কিশোরীদের বাবা-মাকেও সচেতন করি। ছেলে-মেয়েকে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। ফলে অভিভাবকেরাই সন্তানদের নিয়ে আসেন স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের কুফল এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে তারা। খাদিজা আক্তার জানান, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ১০ জন কিশোর-কিশোরী সেবা গ্রহণ করতে আসে এবং প্রতি মাসে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন কিশোর-কিশোরী সেবা গ্রহণ করছে। দরিদ্র কিশোরীদের জন্য স্যানেটারি ন্যাপকিন বিতরণ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করা। জানা গেছে, লাইট হাউজ যুবক ও কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া এইচআইভি, এইডস এবং এসটিআই প্রতিরোধ, দারিদ্র্যবিমোচন, আইন সহায়তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা নারী পাচার প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাক কৈশোর যাদের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর, মধ্য কৈশোর যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর এবং প্রান্ত কৈশোর যাদের বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছর। এই তিন শ্রেণির কৈশোরদের চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, মনো-সামাজিক সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।
ইউএসএইড’র আর্থিক সহায়তায় এবং পথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনায় কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে ‘সুখী জীবন’ নামক প্রকল্পের লক্ষ্য হলো- ‘এমন সামাজিক পরিবেশ তৈরি করা যেন কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতন হন এবং সেবা গ্রহণে আগ্রহী হয়’ এবং প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ হলো: স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, সামাজিক গণসচেতনতা তৈরি (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সেমিনার, অ্যাডভোকেসি, ধর্মীয় শিক্ষা, বিভিন্ন দিবস পালন ইত্যাদি)। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করা।