দেশ বিদেশ
ফুটপাথে বসে পড়া শেখা ছেলেটি
ইমরান আলী
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার
কাওরান বাজার থেকে ফুটপাথ দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটিকে দেখে এক পথচারী বললো- এ যেন বিদ্যাসাগর। কাছে গিয়ে দেখা গেল ছেলেটি ফুটপাথে বসেই পড়াশোনা করছে। পেছনে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। রাতের বেলা সেসব বিল্ডিং থেকে আসা আলোতেই চলে তার পড়াশোনা।
পাশে বসে থাকেন এক নারী। ওজন মাপার মেশিন নিয়ে। যখন কাজ থাকে না তখন ছেলেকে অক্ষর শিখিয়ে দেন। তিনি ছেলেটির মা। মা ও ছেলের এমন দৃশ্যটি কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে কাওরান বাজারে। গত সপ্তাহে কথা হয় তাদের সঙ্গে।
কী নাম জিজ্ঞাসা করতেই ছেলেটির উত্তর- দীপ। তার পাল্টা প্রশ্ন- আপনার নাম কী? বেশ চঞ্চল, দুরন্ত। তার মা পাশ থেকে হেসে বলেন, আমার ছেলেটা বেশ চঞ্চল। কয়েকদিন আগেই অসুখ থেকে উঠেছে। কাবু হয়ে গেছে। তা আপনাদের তো অনেকদিন ধরেই এখানে বসতে দেখা যায় রাতের বেলা।
বললেন, আমি ওজন মাপি। আমার এই ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলেটারে মানুষ করতে চাই।
ছেলেটির মা মিতালি বেগমের জন্মস্থান নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার বড়চাপা ইউনিয়নের বীরমাইজদিয়া।
১৯৯৯ সালে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন মিতালি। তার মেজ বোন তখন ঢাকায় এক গার্মেন্টে চাকরি করতো। মিতালিও কাজ নেন গার্মেন্টে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে কাজ ছেড়ে দিতে হয়।
ঢাকায় থাকা অবস্থাতেই মিতালির বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ি চাঁদপুর জেলায়। স্বামী ওজন মাপার কাজ করতো। ঢাকায় তাদের নতুন সংসার শুরু হয়। কিন্তু সে সংসার টেকে মাত্র দু’ বছর। দীপ যখন পাঁচ মাসের পেটে তখন স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়।
কিন্তু কেন? বললেন, জানি না, কেন চলে গেল। আজও খোঁজ নেয় না আমাদের। দীপ তার বাবাকে দেখেনি জন্মের পর থেকেই।
দীপের বয়স এখন ছয় বছর। ফার্মগেটের পাশে পশ্চিম তেজতুরি বাজারে টিনের ছাউনি আর ত্রিপল ঘেরা একটি ঘরে এই মা-ছেলে থাকে।
প্রতি বৃহস্পতিবার ফার্মগেটের এক বাড়িতে কাজ করেন মিতালি। সেখান থেকে তাকে দেয়া হয় আড়াইশ’ টাকা ও ঐ দিনের খাবার দাবার। জামা কাপড়ও দেন তারা মাঝে মধ্যে।
বললেন, অনেকেই এর আগে আমাকে সহযোগিতার কথা বলেছে। কিন্তু কতোদিন আর করবে। দীপকে নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছি রাতদিন।
বললেন, ওজন মাপার পাশাপাশি যে যা দেয় তাই দিয়ে চললেও সবদিন ভালো যায় না। জিনিসপত্রের যেই দাম তাতে মাঝে মধ্যে খুব কষ্টে কাটাতে হয়। অসুখ- বিসুখে চিকিৎসা করা হয় না। ওজন মেপে যে টাকা আসে তা দিয়ে সব প্রয়োজন তো মেটে না।
ফুটপাথে বসে অক্ষর চেনা দীপ এখন ফার্মগেটের এক স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
মিতালি বললেন, পড়াশোনার খরচ লাগে না। তবে এর বাইরেও অনেক কিছুই তো লাগে আমাদের।
মিতালি বেগমের গ্রামে কোনো জায়গা-জমি নেই। বললেন, আমি ভূমিহীন। ঢাকার ফুটপাথই আমার ঠিকানা। গ্রামে গেলে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতে হয়। আমার ইউনিয়ন পরিষদে ঘর চেয়ে আবেদন করেছি। বছর পেরিয়ে গেছে। ঘরটা পেলে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতাম। কিন্তু পাচ্ছি না। এই শহরে টিকে থাকা যাচ্ছে না এভাবে।
মিতালি বেগম পথচারীর ওজন মাপতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওদিকে আশপাশের বিল্ডিং থেকে আসা আলোতে দীপ পড়তে শুরু করে দিলো। চমৎকার কিছু বাংলা, ইংরেজি ছড়া শিখেছে সে। সেগুলোই লিখছে খাতায়। বলা হলো তোমার নামের অর্থ জানো? মাথা নেড়ে বললো- আলো। আমার নামের মানে আলো।