ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

সরজমিন

প্রসাধনের বাজারে ডলারের টান, দাম বেড়েছে, কমেছে সরবরাহ

ফাহিমা আক্তার সুমি ও নাজমুল হুদা
২৭ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

প্রসাধনের বাজারে সরবরাহ সংকট। গুলশান-১ ডিএনসিসি মার্কেট থেকে ছবিটি তুলেছেন জীবন আহমেদ

ডলার সংকটের বড় প্রভাব পড়েছে দেশের প্রসাধনী সামগ্রীর বাজারে। আমদানি করা প্রসাধনী পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কমেছে সরবরাহ। প্রসাধনীর কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্যেও। এলসি করতে না পারায়   অনেক ব্যবসায়ী প্রসাধনী পণ্য বা পণ্যের কাঁচামাল আনতে পারছেন না। এজন্য দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে পণ্যের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক মাস ধরেই সংকট যাচ্ছে। সম্প্রতি এই সংকট বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রসাধনী ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নতুন পণ্য না আসায় তাদের সরবরাহে টান পড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছেন না।

বিজ্ঞাপন
বিকল্প উপায়ে পণ্য আনা হলেও এর দাম পড়ছে বেশি। 

সরজমিন রাজধানীর চন্দ্রিমা, নিউ সুপার ও ডিএনসিসি মার্কেটসহ বিভিন্ন বিদেশি প্রসাধনী বিক্রি হয় এমন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে দাম বাড়ায় পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে। নতুন পণ্যও আসছে না খুব একটা। 
আমদানির লাগাম টানতে গত বছরের ১৭ই এপ্রিল প্রথম পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ১০ই মে ও ৫ই জুলাই আরও দুটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্কুলারের মাধ্যমে বিলাসপণ্য আমদানি কমাতে কড়াকড়ি আরোপ করে। ৫ই জুলাই জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, সব ধরনের মোটর কার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক সামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পানীয়সহ বেশকিছু পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকরা ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণ সুবিধা পাবেন না বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে বলা হয়।

মানহা গ্যালারির স্বত্বাধিকারী সোহেল শেখ। গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে এক যুগ ধরে বৈদেশিক প্রসাধনীর ব্যবসা করছেন। তবে কখনো এমন সংকট দেখেননি তিনি। সোহেল শেখ জানান, পণ্যের এমন সংকট এই প্রথম দেখছেন। করোনা মহামারি সময়েও পণ্যের সংকট ছিল না। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য ছিল তখন। করোনার পর এখন ডলার সংকট চলছে। দামও অনেক। এজন্য পণ্যের সংকটও হয়েছে। সোহেল বলেন, আগে যে সাবান ছিল ১০০ টাকা তা এখন ১৫০ টাকা হয়ে গেছে। যে শ্যাম্পু ছিল ৬০০ টাকা সেটা এখন ৯০০ টাকা। আমাদেরও বেচাকেনা এখন কম। একটা পণ্যে যখন ৩০০ টাকা পার্থক্য হয়ে যায় তখন ক্রেতারাও কেনার আগ্রহ পায় না। আগে ৬০০ টাকা বিক্রি করে যে লাভ করেছি এখন ৯০০ টাকা বিক্রি করেও সে লাভ হয় না। দাম বেশির জন্য বিক্রিও অনেক কমে গেছে। পণ্য না থাকার কারণে ক্রেতারা এসে ঘুরে যাচ্ছে। তাদের দিতে পারছি না। এজন্যও বিক্রি অনেক কমে গেছে। 
তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এলসি করতে পারছে না। যাও করে তাও ডলারের দাম বেশি। ট্যাক্স-ভ্যাট বেশি দেয়া লাগে। এখন পণ্যের দাম যাই হোক আমাদের তো বিক্রি করতে হবে। আগে যেমন ডজন ডজন পণ্য কিনতাম এখন সেভাবে কিনতে পারি না।

ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি নিচ্ছে না। এমন ক্রাইসিস চলতে থাকলে ব্যবসায়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে উল্লেখ করে রাহাদ এন্টারপ্রাইজের কাওসার বলেন, দোকানদাররা কতদিন লস দিবে। তখন ইনকাম সোর্স কমবে। এখন যদি ১০০ দোকান থাকে তখন তা ১০-২০ টাতে নেমে যাবে। কারণ ব্যবসায় লস করে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে পণ্য আসছে না তাই বিক্রি করতে পারছি না। যা আসছে তাও আগে ক্রেতাদের কাছে যে দামে বিক্রি করতাম এখন তার চেয়ে বেশি দামে আমাদের কিনতেই হচ্ছে। ক্রেতাদের কাছে দাম চাইলে বলে ডাকাতি করছি আমরা। ক্রেতারা আগে যারা দুইটা কিনতো এখন একটা কিনছে।
সাইকা ইন্টারন্যাশনালের নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাচ্ছি না। বিক্রিও করতে পারছি না। সরবরাহ না থাকায় প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। যে লিপিস্টিক ২০০ টাকায় বিক্রি করতাম এখন তা ৩০০ টাকায় বিক্রি করা লাগছে। তারপরও আমাদের লাভ আগের চেয়ে কম হচ্ছে। খরচ বেড়ে গেছে। দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন বেশি দেয়া লাগছে। তূর্য প্লাজার মাসুদ আলম বলেন, শিশুদের পণ্যেও সংকট তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাচ্ছেন না। যেসব পণ্য আছে তারও দাম অনেক বেশি। 

নিউ মার্কেট এলাকার গাউছিয়া কসমেটিকসের দোকানি শান্ত বলেন, আগের তুলনায় বাইরের যত প্রসাধনী আছে তার সবকিছুর ৯৯ শতাংশ দাম বাড়ছে। একটাই অজুহাত তাদের পণ্য আসে না। আবার যাদের পণ্য আসছে তারা বেশি দাম দিয়ে আনছে। বা যাদের আগের পণ্য রাখা আছে স্টকে সে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। ইমপোর্টাররা বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে এলসি বন্ধের। ৩০০ টাকার নিচে কোনো পারফিউম নেই এখন। আগে ২০০-২৫০ টাকায়ও পাওয়া গেছে। ক্রেতারা দাম বাড়ায় কিনতে চায় না। আগে ১০টি পণ্য বিক্রি করলে এখন চারটি পণ্য বিক্রি করছি। এলসি বন্ধ করার পর থেকে এই সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে। বাজার পরিস্থিতিটা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। কোনো পণ্যের দাম বাড়তি ছাড়া নেই। দাম বৃদ্ধির কোনো লিমিটও নেই। ইচ্ছামতো দাম বাড়ছে। আগে একটি লাক্স সাবানের দাম ৩২ টাকা ছিল সেটি এখন ৭০ টাকা। স্যান্ডেলিনা আগে ৫৫ টাকা ছিল সেটি এখন ৭০ টাকা। আগে ১০০ পিস আনলে এখন ১০ পিস আনতে হচ্ছে বাইরের পণ্য।

মিলন বেবী’স মার্টের বিক্রেতা বলেন, বাচ্চাদের সাইকেল, গাড়ি, দোলনাসহ বিভিন্ন আইটেম আগে অনেক বিক্রি হতো সেটিও কমেছে। পাইকারি বিক্রি করতে পারছি না। দাম বাড়ার কারণে এসব পণ্য কেউ ক্রয় করছে না। আমাদেরও বেশি দামে ক্রয় করতে হচ্ছে।
রিয়া ট্রেডিংয়ের মোশারফ বলেন, ডলারের দাম বাড়তি। এদিকে আমাদের দোকানে সব ইন্টারন্যাশনাল আইটেম। এই ডলারের প্রভাবটা আমাদের ব্যবসায় সম্পূর্ণভাবে আঘাত করছে। এলসি একদম বন্ধ রয়েছে। আমাদের ঘর সজ্জার আইটেম থেকে সব আছে। এটি এখন দামের দিক থেকে এমন পর্যায় এসেছে যে, সবাই কিনতে পারছে না। তবে একটু বেশি ধনী যারা তারা দাম বাড়লেও ক্রয় করছে। কিন্তু আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হারাচ্ছি। যারা বছরে কমবেশি কিনতে এসেছে এখন তাদের খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।

মিউজিয়াম কসমেটিকসের আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিটি পণ্যের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। সাবান, স্যাম্পু, বিদেশি ক্রিমসহ সব বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। আমদানিকারকরা বেশি দামে বিক্রি করছে। যে স্যাম্পু আগে ছিল ৪২০ টাকা এখন তারা বিক্রি করছে ৫৬০ টাকায়। ছোট থেকে বড় সব প্রডাক্টের দাম বাড়ছে। 

গাউসিয়া মার্কেটের বিক্রেতা বোরহান বলেন, পারফিউম ফগ আগে ছিল ২৫০ টাকা এখন সেটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। জনসন স্যাম্পু ২০০ মিলি আগে ২০০ টাকা ছিল এখন সেটি ৩১০ টাকা হয়েছে। ফেসওয়াশ, ক্রিম, হেয়ার কালার, স্যাম্পু, লোসনসহ যে পণ্য কিনবেন সবকিছুর দাম বাড়তি। এই পণ্যগুলো মানুষের প্রয়োজনীয়। দাম বেশির কারণে আমরাও কম আনতে পারছি। 

কসমেটিকস পণ্যের আমদানিকারক ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসাইন বাবলু বলেন, আমাদের বহুমুখী সংকট চলছে। এটা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপীই চলছে। চার মাস হলো কসমেটিকস পণ্যে আমরা কোনো এলসি পাচ্ছি না। সরকার আমাদের কোনো এলসি দিতে পারছে না। ব্যাংকগুলো থেকে একেবারেই এলসি খোলা যাচ্ছে না। গত বছর ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা আর এ বছর ১০৭ টাকা। এতে বোঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ দাম বেড়েছে এসব পণ্যের। আবার অবৈধ ব্যবসায়ীরা বর্ডার দিয়ে চোরাই পথে পণ্য আনছে। এতে সরকার তাদের রাজস্বও হারাচ্ছে। শিশুদের কিছু পণ্য রয়েছে এসব পণ্যও এলসি করতে পারছি না। 
এই সংকট চলতে থাকলে প্রসাধনী ব্যবাসায়ীরা বিপাকে পড়ে যাবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলসি করতে না পারলে ব্যবসাসীরা এই টাকা অন্যখাতে খরচ করে ফেলবে। ব্যবসার পরিসর ছোট হয়ে যাবে। আবার অনেকে কর্মী ছাঁটাই করবে। সব মিলে ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে।

 

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status