ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

শিল্পপতি আব্দুল মোনেম শূন্য থেকে শীর্ষে

এ এস এম মাইনউদ্দিন মোনেম
৫ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

আমরা জীবনে সবাই সফল হতে চাই, সেরা হতে চাই, বিখ্যাত হতে চাই। পৃথিবী জুড়ে  শত কোটি মানুষের মাঝে সবাই কী সফল হতে পারে? এদের মধ্যে শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকজন সফলকাম হন। এর কারণ কী? নশ্বর এ পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিগণ প্রতিদিন  জন্মগ্রহণ করেন না। তারা আসেন হয়তো শতবর্ষের ব্যবধানে। তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে পৃথিবীতে রেখে যান অনেক কীর্তিগাঁথা যা মানুষ মনে রাখে সুদীর্ঘ সময়কাল। ভোগ করে এর সুফল। এমনই এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।  একক প্রচেষ্টায় শূন্য থেকে শীর্ষ সারিতে আরোহণ করা হাতেগোনা যে ক’জন সুপ্রতিষ্ঠিত সফল ব্যক্তির নাম ওঠে, এর মধ্যে একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও  মোনেম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আলহাজ আবদুল মোনেম। লক্ষ্যে পৌঁছার অদম্য মনোবল, চেষ্টা আর অধ্যবসায় যে একজন মানুষকে তার লালিত স্বপ্নের শিখরে নিয়ে  যায়, তার এক অনন্য উদাহরণ তিনি। ‘জিরো থেকে হিরো’ হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর চিন্তা চেতনায়।

বিজ্ঞাপন
পাথেয় না থাকলেও অনিশ্চিত স্বপ্নের পথে রওনা দেন তিনি। 

 

 

শুধুমাত্র ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা, স্মার্টনেস কিংবা অর্থসম্পদ ইত্যাদির উপর সফলতা নির্ভর করে না, বরং ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিবিষ্ট মনে কর্মে লেগে থাকা গুণের উপর সফলতা নির্ভর করে। সুদীর্ঘকাল নানা টানাপড়েন, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেন  বিরল সফলতা। শিল্পপতি আব্দুল মোনেম ১৯৩৭ সালের ৫ই জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজেশ্বর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী আব্দুল মোনেমের জীবন শুরুতে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বিজেশ্বর তখন একটি  অনগ্রসর গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা বলতে গেলে একেবারেই ছিল না। মাত্র তিন মাস বয়সে বাবাকে হারান আবদুল মোনেম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিভৃত এক গ্রামে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বড় হয়েছেন।  পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে এসএসসি পাস করে মোনেম যখন ঢাকায় আসেন, তখন তার হাতে ছিল গুটিকয়েক টাকা, যা দিয়ে চলাই ছিল দায়। এ সময় সরকারের সার্ভে পদে পরীক্ষা দেন আবদুল মোনেম। পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু চাকরিতে তার মন টেকেনি। স্বপ্ন ছিল আরও বড় কিছু করার, বড় কিছু হওয়ার। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্যবসা। 

মাত্র ৭০ টাকা পুঁজি করে কীভাবে ব্যবসা করতে হয়, সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। দক্ষতা ও সততা দিয়ে গড়ে তুলেছেন সুবিশাল সাম্রাজ্য। আবদুল মোনেম বিশ্বাস করতেন, সবচেয়ে ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সকল কাজে এক নম্বর হওয়া সম্ভব। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঠিকাদার হিসেবে কাজ শুরু করা মোনেম পরে ১৯৫৬ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) গড়ে তোলেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৭ সালে এএমএল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিভৃত কনন্ট্রাকশন দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। নির্মাণ আর অবকাঠামো বিনির্মাণ  দিয়ে মূল ব্যবসা শুরু করে আবদুল মোনেম গ্রুপ। পরবর্তীতে আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এতে কাজের সুযোগ হয় ১০ হাজারের বেশি মানুষের। এই কর্মসংস্থানের পরিধি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।  শুধু নির্মাণ কাজের মধ্যে কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ না থেকে পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে আইসক্রিম ইউনিট ও বেভারেজ ইউনিট, ২০০০ সালে ম্যাংগো পাল্প প্রসেসিং, ২০০৪ সালে ইগলু ফুডস, ড্যানিশ বাংলা ইমালশন, সিকিউরিটি ও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, ইগলু ডেইরি প্রোডাক্টস লিমিটেড, ২০০৭ সালে সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ও এম এনার্জি  লিমিটেড, ২০০৮ সালে নোভাস ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ২০১০ সালে এএম এ্যাসফল্ট অ্যান্ড রেডিমিক্স লিমিটেড, ২০১২ সালে এএম অটো ব্রিকস্‌ লিমিটেড, ২০১৪ সালে এএম ব্র্যান অয়েল কোম্পানি এবং ২০১৫ সালে আব্দুল মোনেম ইকোনমিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপে পরিণত  হয়েছে।

 

 

 এএম বেভারেজ ইউনিটের অধীনে এএমএল কোকাকোলা ব্র্যান্ডের কোকাকোলা, ফান্টা  ও স্প্রাইট ও কিনলে ড্রিঙ্কিং ওয়াটার বোতলজাত করে আসছে আব্দুল মোনেম লিমিটেড।  ইগলু আইসক্রিম বাংলাদেশে একটি অতি পরিচিত নাম। পার্শ্ববর্তী দেশেসহ অন্যান্য দেশেও এর পরিচিতি সবার মুখে মুখে। শিল্পপতি আব্দুল মোনেম পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি  ২ ছেলে ও ৩ কন্যার জনক। তার বড় ছেলে মঈন উদ্দিন মোনেম এবং ছোট ছেলে মহিউদ্দিন মোনেম যথাক্রমে আবদুল মোনেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং  উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। পদ্মা সেতু থেকে কর্ণফুলী টানেল, যমুনা সংযোগ সড়ক অথবা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোর বড় একটা অংশকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন আবদুল মোনেম। এসব কাজে এই গ্রুপ নিজস্ব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের সংযোগ সড়ক, ব্রিজ ফেসিলিটিজ ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের দায়িত্ব পায়  আবদুল মোনেম গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মতো নির্মাণ এলাকার অত্যন্ত নরম (লুজ) মাটিতে কাজ করার জন্য জার্মানি থেকে হেভি স্যান্ড পাইলিং মেশিন আমদানি করে ও নিজস্ব কনস্ট্রাকশন যন্ত্রপাতির বহর ব্যবহার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে সকল মহলের প্রশংসা অর্জন করে।

 পদ্মা সেতু নির্মাণে একমাত্র দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আবদুল মোনেম লিমিটেড সরকারসহ সকল মহলের তরফ থেকে বিশেষ সম্মান অর্জন করে। আবদুল মোনেম ছিলেন ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ। মহান আল্লাহুর উপর নির্ভরশীলতা এবং সততাকে সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। কাজের বিষয়ে তিনি খুবই দক্ষ ও দূরদর্শী ছিলেন।  শুধু ফিল্ড সার্ভে করলেই তিনি বুঝতে পারতেন এই প্রকল্পে কী কী প্রয়োজন হবে এবং কীভাবে প্রকল্পটি সুন্দরভাবে শেষ করা যাবে। এটি তার অন্যতম ব্যতিক্রমী গুণ ছিল। আবদুল মোনেমের শেষ স্বপ্ন ছিল প্রাইভেট ইকোনমিক জোন তৈরি। ওই জোনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ আসবে। এক কোটি লোকের কাজের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল আবদুল মোনেমের। ২০১৫ সালে বেজা’র কাছ থেকে আবদুল  মোনেম ইকোনমিক জোন লাইসেন্স পায়, যা প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারিতে উদ্বোধন করেন। ইকোনমিক জোনের কাজ দ্রুত অগ্রসরমান। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন আবদুল মোনেম। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন তাদেরকে। একইসঙ্গে পরিবার ও ব্যবসা তিনি সফলভাবে সামলেছেন। 

রাষ্ট্রপতির শিল্প উনয়ন পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার এসেছে আবদুল মোনেমের হাতে। খেলাধুলায় দারুণ আগ্রহী ছিলেন আবদুল মোনেম। বাংলাদেশে ফুটবলের সুবর্ণ সময়ে ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুম পর্যন্ত ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।  তার সময়ে ফুটবল লিগে ১৯৮৬, ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। ব্যবসায়ের পাশাপাশি আবদুল মোনেম সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে সমাজের বিপদগ্রস্ত ও অসহায় মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন আবদুল মোনেম ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়  আবদুল মোনেমের নিজ গ্রাম বিজেশ্বরে প্রায় ৫২ একর জমি দান করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া এই  ফাউন্ডেশন একটি এতিমখানা পরিচালনাসহ সমস্ত খরচ বহন করে। এখানে প্রায় ৩ হাজার এতিম পড়াশোনা করে। দেশে বন্যা বা অন্য কোনো ধরনের বিপর্যয়ের সময় এই  ফাউন্ডেশন ত্রাণ বিতরণ ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। সুদীর্ঘ বর্ণিল কর্মজীবন শেষে ২০২০ সালের ৩১শে মে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের দক্ষিণ দিকে মায়ের কবরের পাশে  শায়িত আছেন আবদুল মোনেম। মোনেমকে ‘আপাদমস্তক একজন সফল ব্যবসায়ী’ অভিহিত করে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, ‘তিনি কোনো রাজনীতি বা রাজনৈতিক দর্শনের সমর্থক ছিলেন না। সব সময় একটা কথা বলতেন, কীভাবে মানুষের কর্মসংস্থান করা যায়।’ একজন ব্যবসায়ী নেতা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘তিনি শুধু বয়সের কারণে মুরুব্বি ছিলেন না, সত্যিকার অর্থেই মুরুব্বি ছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের এবং একইসঙ্গে  দেশের একজন প্রকৃত অবিভাবক। সত্যিকার অর্থেই একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রকৃত সৎ মানুষ বলতে যা বুঝায়, তিনি তাই ছিলেন’। লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আবদুল মোনেম লিমিটেড।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

মৌলভীবাজারে জাতীয় পার্টির সম্মেলন সম্পন্ন / ‘আমরা আওয়ামী লীগে নেই, বিএনপিতেও নেই

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status