ঢাকা, ৭ জুলাই ২০২৫, সোমবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

দেশ বিদেশ

বিজ্ঞান ডার্ক ম্যাটার খুঁজে পেলেও জ্বীনকে কেন খুঁজে পায়না ?

আরিফুল ইসলাম

(২০ ঘন্টা আগে) ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ২:০৬ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫৫ অপরাহ্ন

mzamin

মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা যতই এগোচ্ছে, ততই মানুষের সামনে খুলে যাচ্ছে এক অদ্ভুত ও রহস্যময় বাস্তবতার পর্দা। বিজ্ঞানীরা জানেন, আমরা যা দেখি বা মাপতে পারি, সেটাই পুরো বাস্তবতার সব কিছু নয়। বরং দৃশ্যমান জগৎ মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশের একটি বড় অংশ হলো ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি—যার অস্তিত্ব চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মহাবিশ্বের গঠন ও গতির পেছনে এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা এই অদৃশ্য বস্তু—ডার্ক ম্যাটার—এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, যদিও তারা কোনোদিন এটি সরাসরি দেখেননি। অথচ ধর্মীয় বিশ্বাসে বিদ্যমান ‘জ্বীন’ নামক সত্ত্বার অস্তিত্ব তারা অবলীলায় অস্বীকার করে থাকেন। এ দ্বৈত মানদণ্ড কীভাবে যুক্তিযুক্ত?

বিজ্ঞান মূলত অভিজ্ঞতা, পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাসের উপরে দাঁড়িয়ে। কোনো কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হলে তার এমন কিছু প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া থাকতে হবে যা পরিমাপযোগ্য বা পর্যবেক্ষণযোগ্য। ডার্ক ম্যাটার এই মানদণ্ডে কিছুটা হলেও উত্তীর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, গ্যালাক্সির ঘূর্ণনগতির প্যাটার্ন বা আকাশগঙ্গার মধ্যে থাকা নক্ষত্রগুলোর গতি শুধুমাত্র দৃশ্যমান পদার্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেখানে এমন কিছু আছে যা দৃষ্টিগোচর নয় কিন্তু মহাকর্ষের প্রভাবে উপস্থিতি বোঝা যায়। এমনকি মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন এবং গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং-এর মধ্যেও এই অদৃশ্য পদার্থের ছাপ পড়ে। তাই বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, যদিও ডার্ক ম্যাটার চোখে দেখা যায় না, তবুও তার প্রভাব মহাবিশ্বের গতিশীলতায় এতটাই সুস্পষ্ট যে এর অস্তিত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউরোপের মহাকাশ সংস্থা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) পরিচালিত ইউক্লিড মহাকাশ টেলিস্কোপ মহাশূন্য স্ক্যান করছে। এর উদ্দেশ্য হলো, নির্ভুলতার সাথে গত ১০ বিলিয়ন বছর ধরে ডার্ক ম্যাটারের বিস্তারের তালিকা তৈরি করা। তত্ত্ব অনুসারে, ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের গঠনকে রূপ দিয়েছে। ডার্ক ম্যাটার যেখানে ঘনীভূত হয়েছিল, সেখানে তার মাধ্যাকর্ষণ সাধারণ পদার্থকে আকর্ষণ করেছিলো। যার ফলে, সৃষ্টি হয়েছিলো ষ্টার, গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সি ক্লাস্টার এবং জায়ান্ট গ্যালাক্সি ক্লাস্টার। ইউক্লিড এই গঠনগুলোর থ্রীডি মানচিত্র তৈরি করছে, যাতে বোঝা যায়, মহাবিশ্বের কোথায় কীভাবে ডার্ক ম্যাটার ঘনীভূত হয়েছে এবং তার ফলে দৃশ্যমান জগত কীভাবে গঠিত হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের ইতিহাস, গতিশীলতা এবং অদৃশ্য শক্তির স্বরূপ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অন্যদিকে, জীন একটি ধর্মীয় ধারণা—বিশেষত ইসলাম ধর্মে। বলা হয়, এরা অদৃশ্য জীব যারা আগুন থেকে সৃষ্টি এবং মানুষের মতো স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী। তাদের মাঝে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী আছে, এমনকি তাদের জ্ঞান, সভ্যতা, প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়েও নানা ব্যাখ্যা ধর্মীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়। অনেকের বিশ্বাস, জীন মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে—ভয়, হিপনোসিস, আচ্ছন্নতা, মানসিক বিকার, এমনকি দৈহিক সমস্যাও ঘটাতে পারে। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় এসব বিশ্বাসের কোনো পরীক্ষিত বা পরিমাপযোগ্য ভিত্তি নেই। মানসিক রোগ, হ্যালুসিনেশন, স্নায়বিক গোলযোগ বা সংস্কৃতিগত বিশ্বাসগুলো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যায় বেশি উপযুক্ত বিবেচিত হয়।

ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, কিন্তু সেটি নিছক ধর্মীয় অনুভূতির কারণে নয়, বরং এমন সব প্রমাণ ও গাণিতিক পূর্বাভাসের কারণে যেগুলো ভৌত মহাবিশ্বে দেখা যায়। এটি একটি পরীক্ষানির্ভর অনুমান, যার অস্তিত্ব পরোক্ষভাবে ধরা পড়ে। অপরদিকে, জীনের অস্তিত্বে কোনো প্রভাব, পরিমাপ, পরিসংখ্যান বা পুনরাবৃত্ত পরীক্ষার ফলাফল নেই যা একে বিজ্ঞানের আওতায় আনার দাবি রাখতে পারে। বিজ্ঞান কখনো কোনো বিশ্বাস বা ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে না, কিন্তু বিশ্বাসকে বিজ্ঞান বলে প্রতিষ্ঠা করতেও সম্মত হয় না।

তবে এটাও ঠিক, বিজ্ঞান তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা জানে। অদৃশ্য, অজ্ঞাত বা এখনও অনাবিষ্কৃত কোনো বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা বিজ্ঞানের কাজ নয়। বিজ্ঞান বরং বলে, “এটা প্রমাণিত হয়নি”, কিন্তু “এটা নেই”—এই বক্তব্যে তারা সাধারণত যায় না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, জীনের মতো ধারণার অস্তিত্ব বিজ্ঞানের চোখে ‘অপ্রমাণিত’, কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব ‘পরোক্ষভাবে প্রমাণিত’। এ দুই অবস্থানের পার্থক্যটাই বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, তবে কি বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার খুঁজতে যে পরিমান রিসার্চ ও ইনভেস্ট করেছে, সে পরিমান রিসার্চ ও ইনভেস্ট জীনকে খুঁজতে ব্যবহার করেনি?

সত্যি বলতে কি—এ বিষয়টা আংশিক সত্য। ডার্ক ম্যাটার হলো পদার্থবিজ্ঞানের একটি গাণিতিক ও মহাবিশ্ব-ভিত্তিক সমস্যা, যার অস্তিত্ব গ্রাভিটেশনাল প্রভাবের মাধ্যমে আন্দাজ করা যায়। কিন্তু জীন বা অদৃশ্য সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য বা পুনরায়  পরীক্ষা করার মতো তথ্য-উপাত্ত থাকে না। আর বিজ্ঞান মূলত প্রমাণভিত্তিক বাস্তবতাকে অনুসরণ করে, যেখানে জীনধর্মী ধারণা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসে ভর করা। ফলে বিজ্ঞানীদের জন্য জীনকে গবেষণার আওতায় আনা তুলনামূলকভাবে কঠিন। তাই সঠিক ভাবে বলা যায়, না খোঁজার কারণে নয়—বরং খোঁজার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও মানদণ্ড না থাকায় জীন নিয়ে গবেষণা সীমিত।

তবে বিজ্ঞান যেকোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে যে মানদণ্ডগুলো ফলো করে সেগুলোর মধ্যে প্রথমত, বিষয়টি পর্যবেক্ষণযোগ্য হতে হবে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বা যন্ত্রের মাধ্যমে তা শনাক্ত করা সম্ভব হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই বিষয় বা ঘটনা বারবার পুনরাবৃত্তি হওয়া দরকার, যাতে পরীক্ষাগারে তা যাচাই করা যায়। তৃতীয়ত, গবেষণাটি নিরপেক্ষ হতে হবে—যাতে ব্যক্তিগত বিশ্বাস প্রভাব না ফেলে। চতুর্থত, এর ব্যাখ্যার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রয়োজন। পঞ্চমত, সিদ্ধান্ত হতে হবে পর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে, কল্পনা বা কুসংস্কারের ভিত্তিতে নয়। এবং সর্বশেষ, বিষয়টি প্রাক-পরীক্ষাযোগ্য হতে হবে—অর্থাৎ তাকে ভুল প্রমাণ করার সুযোগ থাকতে হবে। জীন এই সবগুলোর প্রায় কোনোটিই পূরণ করে না, তাই বিজ্ঞান তা নিয়ে গভীরভাবে এগোয়নি।

ভবিষতে এ বিষয়ে বিজ্ঞানের কাজ করার সম্ভাবনা কতটুকু এ প্রশ্নের জবাবে প্যারানরম্যাল সায়েন্সের পটভূমি বলছে, ভবিষ্যতে জীন বা অতিপ্রাকৃত সত্তা নিয়ে বিজ্ঞানের কাজ করার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে তা অনেকটাই নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। যদি এমন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয় যা অদৃশ্য শক্তিকে পরিমাপ বা সনাক্ত করতে পারে, কিংবা যদি কোনো পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতা বা ঘটনা পর্যবেক্ষণযোগ্যভাবে প্রমাণিত হয়—তাহলে বিজ্ঞান এ বিষয়ে আগ্রহী হতে পারে।

এ প্রেক্ষাপটে মনোবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, বা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অগ্রগতি ভবিষ্যতে নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে—যা হয়তো জীনধর্মী অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিতে পারবে। সুতরাং, সম্ভাবনা রয়েছে, তবে সেটা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন নতুন প্রমাণ, প্রযুক্তি ও পদ্ধতি।


লেখক:
প্রবাসি সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক 
মেম্বার সেক্রেটারি, বাংলা প্রেসক্লাব মালয়েশিয়া। 
ইমেইল: [email protected]

রেফারেন্স:
১) NASA. "What is Dark Matter?" https://science.nasa.gov/astrophysics/focus-areas/what-is-dark-matter/
২) Chandra X-ray Observatory. "Dark Matter and the Bullet Cluster." https://chandra.harvard.edu/xray_sources/bulletcluster/
৩) Symmetry Magazine. "Four things you might not know about dark matter." https://www.symmetrymagazine.org/article/december-2013/four-things-you-might-not-know-about-dark-matter
৪) National Geographic. "What is dark matter?" https://www.nationalgeographic.com/science/article/dark-matter
৫) ESA: "Euclid misión overview, dark-matter mapping out to 10 bn years" https://www.esa.int/Science_Exploration/Space_Science/Euclid#:~:text=The%20mission,dark%20energy%20and%20dark%20matter
৬) ESA: "Started scanning from L2 since Feb 2024" https://www.durham.ac.uk/research/current/research-news/2025/03/euclid-q1-data-release/?
৭) ESA: "First data release—26 million galaxies, 500 lensing events" https://www.space.com/the-universe/euclid-space-telescopes-1st-results-reveal-a-goldmine-of-data-in-search-for-dark-matter-and-dark-energy-images-video?
৮) The Guardian: "avalanche of discoveries, insights into dark matter structure" https://www.theguardian.com/science/2025/mar/19/scientists-hail-avalanche-discoveries-euclid-space-telescope?
৯) Reuters: "Mission covers 10 bn light-years, 1.5 bn galaxies over 6 years" https://www.ft.com/content/f53c0636-20ea-4ee9-9882-a2f2583c80f3?
১০) YouTube Video: “Why Scientists Believe in Dark Matter but Not Jinn” https://www.youtube.com/watch?v=6wZ_c6sZCi8
১১) YouTube Video: DW বাংলা: "মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব" https://www.youtube.com/watch?v=6wZ_c6sZCi8
১২) Karl Popper: "The Logic of Scientific Discovery (Cambridge PDF) " https://resolve.cambridge.org/core/books/abs/central-works-of-philosophy/karl-popper-the-logic-of-scientific-discovery/6A7529A68AF096425D51A486532CAA5B
১৩) Dean Radin – The Conscious Universe "The Conscious Universe: The Scientific Truth of Psychic Phenomen" https://www.researchgate.net/publication/243772480_The_conscious_universe_The_scientific_truth_of_psychic_phenomena
১৪) UFO/Paranormal Studies and Governmental Interest: "U.S. Office of the Director of National Intelligence: Preliminary Assessment: Unidentified Aerial Phenomena, June 25, 2021." https://www.dni.gov/index.php/newsroom/reports-publications/reports-publications-2021/3550-preliminary-assessment-unidentified-aerial-phenomena

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status