ঢাকা, ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

বিশ্বজমিন

হারেৎস পত্রিকার বিশ্লেষণ

নেতানিয়াহু কি ট্রাম্পের মুখে ‘চড় মারার’ সাহস রাখেন? গাজা যুদ্ধ থামাতে অস্বীকৃতি দিলে কী হবে

বেন স্যামুয়েলস, ওয়াশিংটন

(১ দিন আগে) ৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ৯:৩০ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৮:১৩ অপরাহ্ন

mzamin

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন গাজা যুদ্ধ শুরুর পর তৃতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা করছেন এই সফর তার কূটনৈতিক কৌশলের এক ঝলমলে বিজয় প্রদর্শনের সুযোগ করে দেবে। ওভাল অফিসে নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে হাজির হওয়া, ইরান ও গাজার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা— সব মিলিয়ে এটি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু উভয়ের জন্যই রাজনৈতিক সুবিধা আনার সুযোগ। নিজেদের নেতৃত্বগুণ ও বিশেষ মিত্রতাকে এভাবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারবেন তারা। তবে উভয় নেতার জন্যই ঝুঁকি ও চাপ কম নয়। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে গাজা যুদ্ধের আগামীর গতিপথের ওপর— ট্রাম্পের সঙ্গে তার সমঝোতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ইসরাইলি জনমতও তার জন্য বড় বিষয়। 

অন্যদিকে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নিজের পররাষ্ট্র নীতির ‘ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার’ গড়ে তোলার চেষ্টায় আছেন। তিনি সদ্য ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়েছেন, সেই সঙ্গে সেই হামলা ঘিরে গোয়েন্দা তথ্য নিয়েও রাজনৈতিক খেলা খেলেছেন, এবং তাৎক্ষণিকভাবে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করেছেন। গাজা যুদ্ধবিরতি তার এই ‘ডিপ্লোমেটিক ট্রফি’ তালিকায় আরেকটি পালক হবে। এটি শুধুই ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠবে না, বরং এর ফলে তিনি একটি বড় কূটনৈতিক পথও সুগম করতে পারবেন— যেমন ইসরাইল-সিরিয়ার মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তি, নতুন রাষ্ট্রগুলোর অ্যাব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগদান, কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ আলোচনার পুনর্জাগরণ। তবে এই সবকিছুই এখন গাজা যুদ্ধ থামানোর ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প জানিয়েছেন, গাজায় আটকদের মুক্তি তার প্রশাসনের শীর্ষ অগ্রাধিকার। যদিও বর্তমানে কোনো জীবিত মার্কিন নাগরিক সেখানে বন্দি নেই। তিনি হোয়াইট হাউসে হামাসের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া শেষ জীবিত আমেরিকান এডান আলেক্সান্ডারের সঙ্গে দেখা করবেন। 

বন্দিদের প্রসঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্পকে অনেক সময়ই আবেগতাড়িত দেখা যায়। বিশেষ করে যেসব বন্দি নিহত হয়েছেন— যেমন আমেরিকান-ইসরাইলি নাগরিক ওমর নিউট্রা ও ইতাই চেনের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের মরদেহ ফিরে পেতে এখনো লড়ছেন। ট্রাম্প মে মাসে বলেছেন, আমি অন্য বাবা-মায়েদের সঙ্গে কথা বলেছি। যতটা আপনি আপনার ছেলেকে ফিরে পেতে চান, ওরাও ততটাই চাইছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সে বেঁচে আছে? না, সে মারা গেছে। কিন্তু তারা তাকে ফিরে পেতে এমনভাবে চাইছিল, যেন সে এখনো বেঁচে আছে। এটা ছিল হৃদয়বিদারক ভালোবাসার একটি চিত্র। এই কারণে বহু বন্দির পরিবার বারবার বলেছে, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল আচরণ করেছে, ইসরাইলি সরকার ততটাও করেনি। হাদার গোল্ডিন নামের এক ইসরাইলি সেনার বোন আয়েলেত গোল্ডিন, যিনি ২০১৪ সাল থেকে গাজায় মৃত অবস্থায় আটক, বলেন, (মার্কিন দূত) স্টিভ উইটকফ কয়েক সপ্তাহ আগে হোস্টেজ স্কয়ারে আমাদের সঙ্গে দুই ঘণ্টা কাটিয়েছেন, কোনো ক্যামেরা বা প্রচারণা ছাড়াই। ইসরাইলি রাষ্ট্র গত দুই বছরে এটা কখনো করেনি। বুধবার ট্রাম্প ট্রুথ সোশাল-এ পোস্ট দিয়ে জানান, ইসরাইল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। 

এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন এবং নেতানিয়াহুকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে প্রস্তুত। পরে সাংবাদিকদের ট্রাম্প জানান, তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে খুব কঠোরভাবে কথা বলবেন ওয়াশিংটন সফরে। ট্রাম্প যেমন আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মতো নেতানিয়াহুকে অনেক ছাড় দিয়েছেন, তেমনি গাজায় মানবিক সংকট সত্ত্বেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অনুমতি দিয়েছেন। তবে জো বাইডেন যেখানে জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে ইসরাইলকে উৎসাহ দিয়েছেন, সেখানে ট্রাম্প ‘গাজা মানবিক তহবিল’ তৈরি করে ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় করেছেন। কিন্তু এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। মে মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণের সময় ৫০০-র বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। ট্রাম্পের নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ যে কেবল কথার হাওয়া নয়, তা গত সপ্তাহের তার বক্তব্যেই স্পষ্ট। হোয়াইট হাউস লনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আমি ইসরাইলের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা জানে না কী করছে। 

তিনি এমনকি নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার কারণে মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, ট্রাম্প কোনো অনেক কিছুই মানেন না— প্রয়োজনে সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন। তবে নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে খুশি রাখলেও প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে—  হামাস কি স্থায়ী শান্তিচুক্তি ছাড়া সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে? গাজা কে শাসন করবে? চলমান মানবিক সংকট কিভাবে মোকাবিলা হবে? ট্রাম্পের জন্য এখন প্রয়োজন এমন একটি কার্যকর কৌশল, যা ‘গাজা মানবিক তহবিল’-এর ব্যর্থতা পেরিয়ে বাস্তব স্বস্তি দিতে পারে। মানবিক দিক থেকে এ সংকট এক বিশাল কলঙ্ক, এবং এটি যে কোনো শান্তিচুক্তিকে অস্থির করে তুলতে পারে। আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইসরাইল যা করা দরকার তা করুক। এখন তিনি স্পষ্টভাবে যুদ্ধের অবসান চান। যদি নেতানিয়াহু এতে সাড়া না দেন, সেটি ট্রাম্পের চোখে ‘চড় মারা’র সমান। এবং তিনি তার মতো করেই প্রতিক্রিয়া জানাবেন। বর্তমানে যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আলোচনায় আছে, তা নেতানিয়াহুকে স্থায়ী যুদ্ধসমাপ্তিতে বাধ্য করবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। 

এটি ইসরাইল-হামাস আলোচনা জটিল করে তুলছে। মার্কিন কর্মকর্তারা আশা করছেন, অন্তত ৬০ দিনের এই বিরতিতে স্থায়ী চুক্তির পথে অগ্রগতি সম্ভব হবে; তা না হলে বিরতি আরও বাড়িয়ে আলোচনার সময়সীমা বাড়ানো হবে। এখনো পর্যন্ত ট্রাম্প নেতানিয়াহুর দ্বারা এমনভাবে প্রতারিত হননি, যেভাবে বাইডেন হয়েছিলেন। নেতানিয়াহু বিশেষ করে গাজায় মানবিক সহায়তা ও নির্বিচার হামলার সীমা বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পালন করেননি— এটি বাইডেনের অভিজ্ঞতা। তবে এখন নেতানিয়াহুর সামনে নিজ রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষার চাপ। কারণ তার কট্টর ডানপন্থী জোটসঙ্গীরা যেমন ইতামার বেন-গভির ও বেজালেল স্মোটরিচ তার সরকার ভাঙার হুমকি দিচ্ছে। ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি নেতানিয়াহুকে সাময়িক স্বস্তি দিলেও, শেষ পর্যন্ত তাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে— তিনি ট্রাম্পকে বেছে নেবেন, না তার কট্টরপন্থী মিত্রদের। তার অহংকার হয়তো অন্য কিছু বলছে, কিন্তু বাস্তবতা বলছে সময় কম।

 

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান/ একাধিক দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র দিতে প্রস্তুত

নেতানিয়াহুর ভূয়সী প্রশংসা করলেন ট্রাম্প/ ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status