দেশ বিদেশ
ভয়ে কাঁপছে ইসরাইল, আশ্রয় খুঁজছে বাংকারে
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৪ জুন ২০২৫, শনিবার
ভয়ে কাঁপছে ইসরাইল। সাপের লেজে পাড়া দেয়ার পর যেমন সাপ ফণা তোলে, ঠিক তেমনি ইরানও এখন ইসরাইলের সামরিক হামলার জবাব দিচ্ছে। এতে ইসরাইলের ভেতরে কম্পন শুরু হয়েছে। তারা পুরো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। শুক্রবার ভোরে স্থানীয় সময় আনুমানিক ৩টা (বাংলাদেশ সময় ১টা) থেকে সাইরেন ও মোবাইল ফোনে সতর্কবার্তার শব্দে ঘুম ভেঙেছে পুরো ইসরাইলের। গুরুতর হুমকির ইঙ্গিত দিয়ে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে অবস্থান নিতে বলা হয়। এমন আতঙ্কের মধ্যেই জেরুজালেমসহ দেশের প্রায় সব শহরে খাদ্য ও পানির জোরালো মজুত শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। সুপারমার্কেটের তাকগুলো দ্রুত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কিত জনগণ চাইছে ঘরে যথাসম্ভব বেশি সময় কাটাতে- কারণ ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইরান ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ ড্রোন ছুড়েছে ইসরাইলে। এদিকে জরুরি রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তদানের আহ্বান জানিয়েছে ইসরাইলি জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলো।
হাসপাতালে বাড়তি চাপ সামাল দিতে অনেক রোগীকে ছুটি দিয়ে ঘরে পাঠানো হচ্ছিল। পশ্চিম তীরের পরিস্থিতিও চরম উত্তেজনাপূর্ণ। ইসরাইলি সেনাবাহিনী সব ফিলিস্তিনি শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন জারি করেছে। সেখানে প্রবেশ বা বের হওয়ার সব রাস্তায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, তারা এখন ‘পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতি’তে রয়েছে। সারা দেশের সীমান্ত এলাকায় সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে এবং যেকোনো মুহূর্তে ইরান থেকে আসা পাল্টা হামলার জবাব দিতে তৈরি রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিভিন্ন শহরে মানুষ স্বজনদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছিল, কেউবা ঘরের নিচে বাংকারে অবস্থান করছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই আতঙ্কিত শিশুদের ছবি এবং জরুরি বাজার পরিস্থিতির ভিডিও প্রকাশ করছিলেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং ইঙ্গিত দেয় সংঘাত দীর্ঘায়িত হতে পারে।
ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব জানে ইসরাইলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে মধ্যপ্রাচ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটিই দেশ- ইরান। বিভিন্ন সময়ে তারা ইসরাইলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের যত মাথাব্যথা। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আইএইএ’র নির্দেশনার অধীনে পারমাণবিক কর্মসূচি চালানো এবং যদি তারা মনে করে, তবে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার অধিকার রাখে। অবশ্য ইরান বার বার বলে আসছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যবহারের জন্য। তারা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। এক্ষেত্রে ইরানের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। তাদেরকে প্রতি মুহূর্তে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। রেভ্যুলুশনারি গার্ডের সাবেক প্রধান কাশেম সোলাইমানি হত্যা সহ এবারের হামলায় ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি, দু’জন পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি ও ফারেইনদুন আব্বাসি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মোহাম্মদ মাহদি ছিলেন ইসলামী আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট।
আব্বাসি ছিলেন ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান। ইসরাইল দাবি করেছে, নিহত হয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি। তারা হামলা চালিয়েছে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা সহ বেশির ভাগ পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক স্থাপনায়। যেসব স্থানে এবং যাদের বিরুদ্ধে হামলা করলে একটি জাতি, একটি দেশ ধ্বংস হয়ে যায়- ইসরাইল সেটাই করেছে। এর ফলে ইরানের সামনে এখন কোনো বিকল্প খোলা নেই। তাদেরকে এখন প্রকাশ্যে হামলার পাল্টা হামলা চালাতে হচ্ছে। উপরন্তু ইসরাইলের ‘যুদ্ধাপরাধী’ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানে হামলা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন- ইসরাইলকে এর জন্য কঠোর মূল্য দিতে হবে। শয়তানের চক্রের বিরুদ্ধে তারা মাথা নত করবেন না। যখন এই লেখা লিখছি, তখন খবর আসে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে ইরান কমপক্ষে ১০০ ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালাচ্ছে। এসব ড্রোনকে আকাশেই নিষ্ক্রিয় করার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেসের (আইডিএফ) সেনা প্রধান মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন। এটা হতে পারে ইরানের যুদ্ধ কৌশল। আকাশপথে ড্রোন হামলা চালিয়ে তারা ইসরাইলকে ব্যস্ত রাখতে পারে। এ ঘটনার অন্য পাশে তখন তারা হরমুজ প্রণালীতে নিয়ন্ত্রণ জোরালো করতে পারে। এই প্রণালী দিয়ে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করা হয় এবং সেই তেল মধ্যপ্রাচ্যের। যদি ইরান এই প্রণালীকে বন্ধ করে দিতে পারে তাহলেই অনেকটা সফল হবে তারা। ইরানে হামলার খবরে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে।
ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই হামলা একদিনের প্রস্তুতিতে হয়নি। টাইমস অব ইসরাইল বলছে, বছরের পর বছর এই প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরাইল। এ সময়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমদের ঐক্যের বিষয়ের দিকে নজর রেখেছে। তারা দেখেছে সেখানে মুসলিমদের মধ্যে একতা নেই। তারা দেশে দেশে বিভক্ত। একদেশ আক্রান্ত হলে অন্য দেশ শুধুই দর্শক হয়ে বসে থেকেছে। তারা ভেবেছে, আমাদের তো কিছু হয়নি। এমনি করে মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণেই চারদিকে মুসলিমবেষ্টিত ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, জাতিসংঘকে হেয় করে, মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর চোখের ভেতর ধুলো ঢুকিয়ে দিয়ে গাজার মাটিকে তামা বানিয়ে ফেলার সাহস দেখাচ্ছে।
গাজার নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’য় মেতে ওঠার সাহস দেখাচ্ছে। যখন তারা দেখেছে চারপাশের মুসলিমরা নীরব। তারা শুধু অত্যাধুনিক হোটেল বা রিসোর্টে আলো ঝলমল এসি কক্ষে বসে কথিত আলোচনায় ব্যস্ত। তারা এটা করছে শুধু গা বাঁচানোর জন্য। এসব দেখে দেখে ইসরাইল সাহস পেয়েছে। তাদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট- কোনো ভেদাভেদ নেই। তারা ইহুদি স্বার্থে এক। তারা উভয় পক্ষই ইসরাইলকে আশকারা দিয়েছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র দিয়েছে। যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে ভূমধ্যসাগরে। আর মুসলিমরা? তারা তখন হয়তো বুঁদ আরাম আয়েশে। তাদের এই ব্যর্থতা গাজা, লেবানন, ইয়েমেন বা ইরানের অস্তিত্বকে হুমকি ফেলেছে। শুধু তাই নয়, এখন বিশ্বনেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন- ইরান-ইসরাইল যদি এই যুদ্ধ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য রক্ষা পাবে না। তখন ওই অঞ্চলের প্রতিটি দেশ আক্রান্ত হবে। বিষয়টি দাঁড়াবে এমন যে- ধরুন একটি শিয়াল শীতের সময় মাটির চুলার পাশে আগুন পোহানোর জন্য শুয়ে আছে। উষ্ণতা পেয়ে এক সময় আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। কিন্তু তার লেজ সেই ঘুমের মধ্যেই নাড়া খেয়ে চুলার আগুনের কাছে চলে গেছে। অমনি ধপ করে তাতে আগুন লেগে গেছে। সেই আগুন ক্রমশ অগ্রসর হয়ে যখন শিয়ালের শরীরকে স্পর্শ করেছে, পুরো শরীরে ছেয়ে গেছে- তখন সে উপায় না পেয়ে পাগলের মতো দৌড়াতে শুরু করেছে। তার আরাম পরিণত হয়েছে দোজখের আজাবে।
মুসলিমদের যদি এরপরও হুঁশ না হয়, তাহলে তাদের দশাও একই রকম হতে পারে।