ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

প্রস্তুত হচ্ছে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, মিলবে উন্নত চিকিৎসা

মোহাম্মদ রায়হান
২৭ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার
mzamin

চিকিৎসার জন্য বিদেশনির্ভরতা কমাতে প্রস্তুত করা হচ্ছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার-স্পেশালাইজড হাসপাতাল। নানা চড়াই-উৎরাই, অনিয়ম,  সেবার দীর্ঘসূত্রিতা মাড়িয়ে নতুন করে সেবা দেয়া শুরু করেছে হাসপাতালটি। তবে জনবল সংকটের কারণে পুরোদমে শুরু হয়নি হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। তিন মাসের মধ্যেই হাসপাতালটি পুরোদমে চালু হবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম মানবজমিনকে বলেন,  আমরা হাসপাতালের সার্বিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রস্তুত। তিন মাসের মধ্যে আশাকরি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়া সম্ভব। আমরা সেভাবে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছি, সব গোছানো হচ্ছে।  অন্তঃবিভাগগুলো চালুর জন্য আমরা সব পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমাদের লিভার বিভাগ, রেডিওলোজি বিভাগ,  আইসিউ- এসব ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। এ মাসে কার্ডিওলোজিও চালু করবো। বহির্বিভাগ পুরোদমে চালু হয়েছে। 

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরে ৩.৪ একর জমিতে হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণ ব্যয়ের মোট ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ঋণ হিসেবে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা দিয়েছে। হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ১৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হাস্পাতালে বর্তমানে জনবলের অভাবে পরিপূর্ণভাবে সেবা দেয়া যাচ্ছে না। পূর্বের প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় নতুন করে সব কিছু সচল করতে বেগ পেতে হচ্ছে। বিশেষ করে, নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আসা অভিযোগের আইনি জটিলতা শেষ করতে এবং নতুন করে জনবল নিয়োগের বিষয়ে কিছুটা সময় লাগছে। তাছাড়া কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক কিছুদিন প্রজেক্টের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।  কারণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করে এ বছর জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ পায় কর্তৃপক্ষ। জানা  গেছে, ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইনি জটিলতা কাটাতে পেরেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় পূর্বের রিক্রুটমেন্ট বাতিল করেছে। এখন নতুন রিক্রুটমেন্ট শুরু করার প্রক্রিয়া শুরু করছে প্রশাসন। হাসপাতাল সচল করার জন্য কী পরিমাণ পদে জনবল লাগবে সে সংখ্যাটা ঠিক করে এ মাসের শেষেই মন্ত্রণালয়ের কাছে জানাবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করে প্রাথমিকভাবে ৩০০ শয্যা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছেন ভিসি অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, হাসপাতাল পুরোদমে চালু করার জন্য আমাদের প্রথম কাজ হলো নিয়োগ। প্রথমে আমরা ৩ শ’র ওপরে শয্যা চালু করবো। যদিও ৭ শ’র ওপরে শয্যা এখানে। আমাদের জনবল প্রয়োজন। এরমধ্যে উল্লেখ হচ্ছে- ডাক্তার, কনসালটেন্ট, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও চিফ কনসালটেন্ট।   

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে বর্তমানে ১৯টি বিভাগে বহির্বিভাগের রোগীদের দেয়া হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। বিভাগগুলো হল- অর্থোপেডিক সার্জারি, নিউরোসার্জারি, ইউরোলোজি, নেফ্রোলজি, অবস ও গাইনী, শিশু, চক্ষুবিজ্ঞান, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রারোলোজি,  পেইন মেডিসিন, হেপাটোলজি, জেনারেল সার্জারি, সার্জিক্যাল অনকোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, এন্ডোক্রাইন সার্জারি, নিউরোলজি, হেপাটোবিলিয়ারি, কার্ডিওলোজি, কার্ডিয়াক সার্জারি, কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগগুলোতে সেবা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালসূত্রে জানা যায়, দুই শিফটে বহির্বিভাগে সেবা দিচ্ছে হাসপাতালটি। সকাল ৮টা থেকে সকাল ও দুপুর ১.৪৫ থেকে বিকালের শিফটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সকালে বহির্বিভাগে রোগী দেখাতে একজন রোগীকে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপকের ব্যবস্থাপনার  জন্য ৬০০, ৪০০ এবং ৩০০টাকা ফি দিতে হয়। অন্যদিকে, বিকাল বেলা দেখাতে খরচ পড়ে ১০০০, ৭০০ এবং ৫০০টাকা।     

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাসপাতালটিতে এখন সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়া সেবার মধ্যে লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক ডিজিজ, হেপাটোলজি অ্যান্ড লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সেন্টার, কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড স্ট্রোক সেন্টার, মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ কেয়ার সেন্টার, কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি সেন্টার এবং অ্যাক্সিডেন্ট অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সেন্টার রয়েছে। এসব সেন্টারে রোগীদের হার্ট, কিডনি, লিভার (হেপাটোলজি), নিউরোসহ  বেশ কিছু রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সার্জারির জন্য ইনডোরে রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে। পিত্তথলির পাথর অপারেশন থেকে শুরু করে সব ধরনের প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি করা  হচ্ছে। যেমন- ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি, হুয়িপলস প্রসিডিউর ইত্যাদি।      

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে,  হাসপাতালে লিভারের রোগীদের জন্য প্রতি সপ্তাহে সোম ও বুধবার বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেবা চালু রয়েছে। যেমন- এন্ডোস্কপি, এন্ডোস্কোপিক ভ্যারিসিয়াল লিগেশন, শর্ট কোলোনস্কপি, ফুল ক্লোনোস্কপি, গ্লু ইনজেকশন, এন্ডোস্কপিক পলিপেক্টমি, ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি  ফর্ম লিভার স্পেস অকুপাইং লিজন, লিভার এবসেস, পেয়ার থেরাপি, এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলানজিওপ্যানক্রিয়াটোগ্রাফি স্টেন্ট রিমুভাল, ইআরসিপি স্টেন্টিং, ক্লোনোস্কপি পলিপেক্টমি এবং ডিউডেনস্কোপি ইত্যাদি।  

সমপ্রতি বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের আইসিউ ইউনিট উদ্বোধন করার সময় বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে বর্তমান প্রশাসন নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সকল বাধা অতিক্রম করে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এই হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর কাজ সম্পন্ন করা হবে। এই হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। 

হাসপাতালে সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, নিচ তলার বহির্বিভাগে অপেক্ষা করছেন রোগী ও স্বজনদের অনেকে। চিকিৎসার জন্য সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘোষণার জন্য। সাধারণত রোগীদের নাম ধরে ডাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ডাক্তারের পরামর্শের জন্য যাচ্ছেন। অত্যাধুনিক ভবন, ফাস্ট ফুডের দোকান, একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা, চালু আছে চলন্ত সিঁড়ি, সুপরিসর লিফটসহ সবই আছে হাসপাতালে।  হাসপাতালের তিনটি ফ্লোরের বিভিন্ন কক্ষে চিকিৎসকরা বসছেন রোগী দেখতে। তবে নিচ তলায় ভিড়-ভাট্টা কিছুটা থাকলেও উপরের তলার কক্ষ ও ফ্লোরগুলো একদমই সুনশান। নির্দিষ্ট চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করছেন রোগী-স্বজনরা। এর বাইরে বাড়তি কোনোরকম ঝামেলা দেখা যায়নি। হাসপাতালের বিভিন্ন তলায়  ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম তলায় রয়েছে- বহির্বিভাগ রোগীদের জন্য বসার স্থান, দোকান,  হাসপাতালের রিসিপশন, রেডিওলোজি বিভাগ, হাসপাতালের ফার্মেসি, অভজারভেশন কক্ষ, ট্রমা চিকিৎসা বিভাগ।  দ্বিতীয় তলায় রয়েছে- কিডনি ডিজিস অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নার্স বিভাগ, এনআইসিউ, পিআইসিউ, ডেলিভারি রুম, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় রয়েছে- কার্ডিওভাস্কুলার অ্যান্ড স্ট্রোক সেন্টার, সিসিউ, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, প্যাথলজি ল্যাব, হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক ডিজিজ, হেপাটোলজি অ্যান্ড লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার ইত্যাদি।  চতুর্থ তলায় দেখা গেছে এমআইসিউ ইউনিট, এসআইসিউ, সিএসডি, এমআইসিউ ইত্যাদি। সচল আইসিউ সার্ভিস রয়েছে। এর ওপরের তলাগুলোতে রয়েছে কেবিন এবং ওয়ার্ডসমূহ। কিছু ওয়ার্ডে জরুরিবিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীও রয়েছেন।     

আন্তর্জাতিকমানের উন্নত চিকিৎসা মিলবে এখানে-    
বিশেষায়িত এ হাসপাতালটি নির্মাণের সময় বলা হয়েছিল এখানে চিকিৎসা খরচও থাকবে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। একই ছাদের নিচে সর্বাধুনিক বহুমুখী বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা চলবে।  ১৩ তলাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ভিভিআইপি, ভিআইপি কেবিন, ডিল্যাক্স শয্যা, এক্স-রে, এমআরআই, স্পেশালাইজড সেন্টার, সিটি-স্ক্যানসহ অত্যাধুনিক সব ডায়াগনস্টিক সুবিধাসহ সব মিলিয়ে বিশ্বমানের সেবা দেয়ার আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেন, দেশের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এখানে চিকিৎসা দেবেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি চিকিৎসকরা, প্রয়োজনে বিদেশি চিকিৎসকদের আনা যাবে।  হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গ চালু হলে বিদেশনির্ভরতা কমবে।  আমাদের এখানে সেবার মান নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি চিকিৎসকদের আমন্ত্রণ করেছি। প্রাথমিকভাবে সাড়া পেয়েছি। আমাদের দেশের ডাক্তাররাই বিদেশে আছেন। এ জন্য আমরা খুব আশাবাদী।  

২০২২ সালের  ১৪ই সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হওয়া এ হাসপাতালটি চালু হওয়ার আগেই একরকম বন্ধই থাকে। নানা রকম অনিয়ম আর লুটপাটের অভিযোগ আসে হাসপাতালের তৎকালীন ভিসি ও প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে।  উদ্বোধনের পর বছর দেড়েক ধরে যে প্রতিশ্রুতিতে হাসপাতালটি তৈরি করা হয়েছিল সে লক্ষ্য বা প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই রয়ে যায়। নামেমাত্র চিকিৎসক, নার্স, কর্মী দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিলো এটি। সমপ্রতি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।    

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status