অর্থ-বাণিজ্য
কৃষি ও কৃষকের পাশে বেসরকারি খাত, সংকট হ্রাসের আশা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
(৩ দিন আগে) ২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৭:১৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:১৫ অপরাহ্ন
দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১১.৬৬ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, এ খাতে কাজ করছে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫.৩ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ এ খাত ও খাতসংশ্লিষ্ট বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত দুর্বল বাজার ব্যবস্থা, প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সাথে লড়াই করতে হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের নানা পদক্ষেপ আছে। তবে আশার কথা, কৃষি ও কৃষকদের সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসছে বেসরকারি উদ্যোগ।
এদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙনে হারিয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, এতে গৃহহীন হয় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে, ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে চাল উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং গম উৎপাদন ৩২ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নানা উদ্যোগ নিয়ে কৃষি ও কৃষকদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কৃষি খাতের উন্নয়ন ও কৃষকদের জীবনমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা এরই মধ্যে অসংখ্য কৃষকের জীবনে এনেছে পরিবর্তনের হাওয়া।
চরাঞ্চলের মতা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কৃষি চাষ সবসময়ই ছিল চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের চরের কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ও বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ যৌথভাবে পরিচালনা করে থাকে বিশেষ কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচি। চলতি বছরই কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যার আওতায় দেশের ৩৬টি চর এলাকায় প্রায় ১০ হাজার কৃষকের জীবনে এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন।
কুড়িগ্রামের ঘুঘুমারি চরের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বন্যার সময় সমস্যায় পড়তে হয়। এখন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিখেছি কীভাবে বন্যার পরেও ফসল ফলানো যায়। নতুন প্রযুক্তির কারণে খরচ কমেছে, আয় বেড়েছে।‘ এই কর্মসূচিতে ‘ফার্ম-টু-মার্কেট’ সহায়তার মাধ্যমে কৃষকদের টেকসই কৃষি প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং বাজারে সরাসরি প্রবেশাধিকারের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে বিকল্প আয়ের উৎসকে সম্ভাবনাময় মনে করে বিএটি বাংলাদেশ। শ্রম সংকট ও উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি মোকাবিলায় ২০২১ সালে চালু হয় প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম উদ্যোগ ‘লোকাল-ফিট ফার্ম মেকানাইজেশন’। এ উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষেতের সারি তৈরির যন্ত্র, সার প্রয়োগকারী ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্র। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ২০২৪ সালে ৩৭,৭০০ জন কৃষককে এই কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষ ও রোপণের মতো শ্রমনির্ভর কাজ সহজ করায় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৫৩,৫২৪ জনেরও বেশি কৃষক এই উদ্যোগের সুফল পেয়েছেন।
কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নেও জোর দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সাল থেকে কৃষকদের অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ দিতে তাদের উদ্যোগে শুরু হয় মাশরুম চাষ কর্মসূচি। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, খাগড়াছড়ি সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদের মৌসুমে ব্যবহৃত ঘরগুলো সাধারণত বছরে ১-২ মাস ব্যবহার করা হয় এবং বাকি সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে অন্য মৌসুমে অব্যবহৃত এই ঘরগুলো মাশরুম চাষের উপযোগী করে এর ব্যবহার ৭৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার নারী কৃষক হাসিনা খাতুন বলেন, ‘আগে এই ঘরটা পুরো বছরই পড়ে থাকতো। এহন মাশরুম বানিয়ে চলি। নিজের এই টাকা সংসারের কাজে লাগাতে।‘ এখন পর্যন্ত ১২৫ জন নারী এ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ফলে নারীদের ক্ষমতায়ন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কৃষকের সোনালী স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে এসিআই লিমিটেড। কোম্পানিটির অন্যতম শাখা এসিআই ক্রপ কেয়ার ও এসিআই ফর্মুলেশনস লিমিটেড দেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ফসলের সুরক্ষা, বালাইনাশকের নিরাপদ ব্যবহার ও সামগ্রিক বালাইব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুন্দর ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এদিকে স্থানীয় কৃষি পণ্যের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশজুড়ে এক লাখেরও বেশি চুক্তিভিত্তিক কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে, যা কৃষকদের নিশ্চিত বাজার সুবিধা দেয়।
নাটরের কৃষক রিপন হোসেন বলেন, ‘আগে ফসল উঠিয়ে পাইকারের অপেক্ষায় থাকতাম। এখন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি আছে। দামও ভালো, সময়ও বাঁচে। দাম ভালো পাওয়ায় ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনায় খরচ দিতে সাহায্য হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ গবেষণা ও পরিকল্পনা করেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের জন্য মাঠে নামছে। এই ইতিবাচক দিকটি ধরে রাখা প্রয়োজন। এতে সরকার ও দেশের অর্থনীতিই লাভবান হবে। সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে আরো বেশি করে বেসরকারি উদ্যোগকে আমন্ত্রণ জানানো।