ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

চাঁনখারপুল ‘গণহত্যা’

৮ জনকে অভিযুক্ত করে প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন

স্টাফ রিপোর্টার
২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর চাঁনখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের গুলিতে শিক্ষার্থী আনাস হত্যার ঘটনার মামলায় আটজনকে অভিযুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা। এতে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা জানান। এটি জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় করা অভিযোগের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে অভিযুক্ত অন্যরা হলেন- ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী, রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম মো. আকতারুল ইসলাম ও এসি মো. ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল সুজন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন-ইন্সপেক্টর আরশাদ, কনস্টেবল মো. সুজন, ইমাজ হোসেন ইমন ও নাসিরুল ইসলাম। এদের মধ্যে চারজন গ্রেপ্তার হলেও বাকি চারজন পলাতক। ঘটনার সময়কাল ছিল ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট।
ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, ১৯৫ দিনের তদন্ত শেষে ৯০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে মোট ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সংযুক্ত আছে ১৯টি ভিডিও, ১১টি পত্রিকার প্রতিবেদন, ২টি অডিও, ১১টি বই ও রিপোর্ট এবং ৬টি মৃত্যু সনদ। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ব্যাপ্তি ছিল ৫৬ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সর্বত্র। এ হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। আগ্নেয়াস্ত্র, এপিসি কার, লাখ লাখ বুলেট, হেলিকপ্টার, ড্রোন ব্যবহার করে এই আন্দোলন দমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই অপরাধের যারা মাস্টারমাইন্ড ছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য সহ সবার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। আমরা আলাদাভাবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবো।

তাজুল ইসলাম বলেন, ৫ই আগস্ট ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। এতে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক এবং মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন। তদন্তে উঠে এসেছে, পলাতক আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্যান্য আসামিরা ঘটনাস্থলে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন অথবা তা তত্ত্বাবধান করেছেন। তারা অধীনস্থদের নির্দেশ প্রদান, সহযোগিতা ও সহায়তার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনে ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া তারা এসব অপরাধ সংঘটন থেকে অধীনস্থদের বিরত রাখেননি বা পরবর্তী সময়ে কোনো ব্যবস্থাও নেননি। এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তাজুল বলেন, কম্প্লেইন রেজিস্টার নম্বর-১৪৯। ৭ই অক্টোবর থেকে তদন্ত শুরু হয়ে ২০শে এপ্রিল তদন্ত শেষ করে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অর্থাৎ ১৯৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। এই প্রতিবেদনের মধ্যদিয়ে এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলার তদন্ত কাজ সম্পন্ন হলো। তদন্তে পাওয়া সংক্ষেপ বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে ছয়জনকে হত্যা করেন আসামিরা। ৯০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে দালিলিক তথ্য-প্রমাণও সংযুক্ত করা হয়েছে, ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দিও নেয়া হয়েছে। এ ঘটনার ১৯টি ভিডিও ক্লিপ রয়েছে। ১১টি পত্রিকার রিপোর্ট রয়েছে। এ ছাড়াও ২টি অডিও কল রয়েছে। এর মধ্যে একটি অডিওকলে শেখ হাসিনা সরাসরি নির্দেশ দেয়ার রেকর্ড রয়েছে। এতে হাসিনা পুলিশকে গুলি করে মানুষ হত্যার নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়াও সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশনাও রয়েছে। হাসিনা যে মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল সেটি হাবিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অন্য কর্মকর্তাদের জানাচ্ছিলেন। অর্থাৎ পুলিশ কমান্ড সেন্টার থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় হাবিবুর রহমান। 

চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, এই নির্দেশের পরই মরণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছেন পুলিশ সদস্যরা। তদন্ত সংস্থা ১১টি বই দাখিল করেছেন। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনও রয়েছে। আছে ছয়জন শহীদের ছয়টি ডেথ সার্টিফিকেট।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা ব্যাখ্যা করে ব্রিফিংয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আজ থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ দাখিলের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই ফরমাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমে বিচারের যে আনুষ্ঠানিক যাত্রা সেটি শুরু হয়ে যাবে। আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর ৩ ধারার ২ উপধারা এবং ২ উপধারার (এ)(এফ)(জি)(এইচ) এবং ৪ (১) ও ৪ (২) (৩) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সে কারণে তদন্ত সংস্থা র্চাজশিট দাখিল করেছেন। এ ছাড়াও এই মামলায় যারা পলাতক আসামি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিচারের সময় পলাতক থাকলে তাদের বিষয়ে পত্রিকায় ট্রাইব্যুনাল থেকে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। যদি হাজির না হয় তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে। তখন তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই গণহত্যায় সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনার। চাঁনখানপুলে প্রাণহানির ঘটনায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও দাবি করেন তাজুল। তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ তদন্ত চলছে। সেজন্য তাদের এই মামলায় আসামি করা হয়নি। তবে নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনার যে ভূমিকা রয়েছে তার বর্ণনা তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে।

চাঁনখারপুল এলাকায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আরও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে বলে মন্তব্য করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সেসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত রয়েছেন। সেসব অপরাধের তদন্ত চলছে। তদন্ত সম্পন্ন হলেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা। যেহেতু ছয়জনকে হত্যার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রথমেই সম্পন্ন হয়েছে, সেজন্য এটিই প্রথমে দাখিল করা হয়েছে।
এ ছাড়াও, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সাভারের আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে যাবো। 
তদন্ত শেষ হয়েছে। ফাইনাল কাজ চলছে। এটির প্রতিবেদন পেয়ে গেলে চাঁনখারপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার বিচার একই সময়ে করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম।

 

 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status