দেশ বিদেশ
মুসল্লিদের সুবিধার্থে বিশেষ ট্রেন, ইমামের পুনর্বহালে স্বস্তি, রেকর্ড মুসল্লির প্রত্যাশা
স্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জ থেকে
৩০ মার্চ ২০২৫, রবিবার
ফ্যাসিবাদী জামানায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে মুতাওয়াল্লি নিযুক্ত স্থায়ী ইমামকে বাদ দিয়ে ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে। বিতর্কিত এই ইমামকে নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ ছিল। প্রতি বছর এর প্রভাব পড়তো ঈদ জামাতে। গত বছরের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে বাদ দিয়ে মুতাওয়াল্লি নিযুক্ত স্থায়ী ইমাম মুফতি আবুল খায়ের মুহাম্মদ ছাইফুল্লাহকে পুনর্বহাল করেছে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটি। দীর্ঘ ১৫ বছর পর তার এই পুনর্বহাল স্থানীয় মুসল্লিদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। নানা বিধি-নিষেধের গ্যাঁড়াকল পেরিয়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে প্রথমবারের মতো এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব কারণে এবার মুসল্লির সংখ্যা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে এবারের ঈদ জামাতকে ঘিরে মুসল্লিবান্ধব নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে মাঠ পরিচালনা কমিটি। ফ্যাসিবাদী জামানায় মোবাইল ফোন নিয়ে ঈদগাহ মাঠে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এবার তা থাকছে না। তবে নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় রেখে ছাতা নিয়ে ঈদগাহ মাঠে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না।
এবারো দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবারো ‘শোলাকিয়া এক্সপ্রেস’ নামে দু’টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। ভৈরব বাজার-ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহ-ভৈরব বাজার রুটে বিশেষ ট্রেন দু’টি চলাচল করবে। বিশেষ ট্রেনের একটি ঈদের দিন সকাল ৬টায় ভৈরববাজার থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছাবে। জামাত শেষে ট্রেনটি দুপুর ১২টায় পুনরায় ভৈরববাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে এবং বেলা ২টায় ভৈরববাজার পৌঁছাবে। অপর ট্রেনটি ঈদের দিন সকাল পৌনে ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছাবে। এ ট্রেনটিও জামাত শেষে দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাবে এবং বেলা ৩টায় ময়মনসিংহ পৌঁছাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার বিগত সময়ের তুলনায় আরও সুচারু ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এজন্য দফায় দফায় পুলিশ ও সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও সদস্যরা ঈদগাহ ময়দান পরিদর্শন করছেন। পুরো মাঠকে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির জন্য ড্রোন উড়বে শোলাকিয়ার আকাশে। মাঠ ও মাঠের আশপাশ এলাকায় ড্রোনে পর্যবেক্ষণ ছাড়াও ঈদগাহ ময়দানের বাইরে, ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঈদগাহ ময়দান, আশেপাশের এলাকা এবং অলিগলিসহ মাঠ সংলগ্ন চারপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা নিয়ে আসা হচ্ছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায়। মাঠে স্থাপন করা হয়েছে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার।
এর চারটিতে পুলিশ বাহিনী ও দুইটিতে র্যাব বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে ঈদ জামাতের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা তদারকি করবেন। এরইমধ্যে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে পুলিশ। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহর এবং আশপাশের এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, আরআরএফসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় হাজারেরও বেশি সদস্য দিয়ে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হচ্ছে ঈদগাহ ময়দানকে। ঈদগাহ ময়দানের তিনটি প্রবেশপথে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হবে। এ ছাড়া ব্যবহার করা হবে মেটাল ডিটেক্টর। নিশ্ছিদ্র এই নিরাপত্তাব্যূহ ডিঙিয়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির ঈদগাহ ময়দানে প্রবেশ একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে শনিবার দুপুরে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে প্রেস ব্রিফিং করেছে জেলা প্রশাসন।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বিপিএম-সেবা বলেন, মাঠের বাইরে, মাঠের ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ ও সুচারু নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উড়ন্ত ড্রোন থেকে নজরদারি ছাড়াও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা জোরদারের জন্য মাঠের ভেতর-বাহিরে পোশাক ও সাদা পোশাকে অন্যান্য বারের থেকেও বেশিসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট থাকবে। সার্বিক প্রস্তুতির বিবেচনায় নির্বিঘ্নে শোলাকিয়ায় মুসল্লিগণ ঈদুল ফিতরের ১৯৮তম জামাত আদায় করতে পারবেন বলে পুলিশ সুপার আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে পুলিশের নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি পাঁচ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। ঈদগাহ ময়দানকে ঘিরে মোতায়েন করা হবে বিপুলসংখ্যক র্যাব সদস্য। র্যাব-১৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি নাইমুল হাসান বলেন, মুসল্লিদের নিরাপত্তায় সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও র্যাব সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। নাশকতাকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, পকেটমার, টিকিট কালোবাজারি ও মলমপার্টিসহ অন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কন্ট্রোল রুম স্থাপন করবো। ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে আমরা সার্ভিলেন্স করবো।
সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবো। ড্রোন এবং বায়নোকুলার থাকবে। ওয়াচ টাওয়ারে স্বয়ংক্রিয় স্নাইপার রাইফেল থাকবে যেন যেকোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধ করা যায়। বেশকিছু প্যাট্রোল কার থাকবে, যেগুলো শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল দিবে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সুষ্ঠুভাবে ঈদ জামাত আদায়ের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ ফোর্সকে আইনগত দিকনির্দেশনা দেয়াসহ ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য ঈদগাহ মাঠের বিভিন্ন পয়েন্ট ও এলাকায় ১৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গৃহীত প্রস্তুতির বিবেচনায় লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে এবারো উৎসবমুখর পরিবেশে সুন্দর ও সুচারুভাবে ঈদ জামাত অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান। তিনি জানান, এবারের ১৯৮তম ঈদুল ফিতরের জামাত শুরু হবে সকাল ১০টায়। উপমহাদেশের বৃহত্তম এই ঈদ জামাত আয়োজনের সকল প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সবমিলিয়ে বৃহত্তম ঈদ জামাতের জন্য ২৭৫ বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান পুরোপুরি প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইট চ্যানেল এনটিভি দেশের সর্ববৃহৎ এই ঈদ জামাত সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে। ২০০৭ সাল থেকে চ্যানেল আই নিয়মিত ঈদ জামাত সরাসরি সমপ্রচার করছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুরুত্বের সঙ্গে এ ঈদ জামাতের নিউজ কাভার করে থাকে।
প্রতি বছরই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিণত হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মহামিলন কেন্দ্রে। এবার ভয়মুক্ত নতুন পরিবেশে শোলাকিয়ায় ফিরে আসছে সেই চিরচেনা কোলাহল। লাখো মানুষের মুখরতা। তাই এবার শোলাকিয়ায় মুসল্লির সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে স্থানীয়রা আশা প্রকাশ করছেন। শত ব্যস্ততা, নানা সমস্যা আর প্রাকৃতিক বৈরিতাকে উপেক্ষা করে শোলাকিয়ায় সমবেত হন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ। এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন ধনী-গরিব নির্বিশেষে। সবার উদ্দেশ্য একটাই, যেন কোনো অবস্থাতেই হাতছাড়া হয়ে না যায় জামাতে অংশগ্রহণ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ।