দেশ বিদেশ
মুনাফা বাড়লেও উল্টো কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩০ মার্চ ২০২৫, রবিবার
অন্তর্বর্তী সরকার মুনাফার হার বাড়ালেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়েনি, উল্টো কমেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। অর্থাৎ জানুয়ারিতে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার। এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। বিক্রি কমে যাওয়ায় জানুয়ারিতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ বা মুনাফার হার বাড়ানো হয়। মেয়াদ পূরণ সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুসারে এ হার বেড়ে হয়েছে সর্বোচ্চ ১২.৫৫ শতাংশ। সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১.৫২ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দেশের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখে ব্যাংকে। তারপর নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। তবে মুনাফার হার বাড়ানোর পরেও সঞ্চয়পত্র কিনছে না মানুষ। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত এক/দেড় মাস বাদ দিলে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি ছিল। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। পরিবারের খরচ মেটাতেই পারছে না। সঞ্চয়পত্র কিনবে কীভাবে। তিনি বলেন, মুনাফার হার হ্রাস, নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হচ্ছিল। মানুষ যতো টাকার সঞ্চয়পত্র কিনছিল, তার চেয়ে বেশি ভাঙাছিল। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। এখন মুনাফার হার বাড়ানোর পরও বিক্রি বাড়ছে না। এর কারণ, সঞ্চয়পত্র কেনার মতো যথেষ্ট সঞ্চয় নেই মানুষের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত মাস ফেব্রুয়ারিতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৩২ শতাংশ। আগের মাস জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)। অর্থাৎ এই ৭ মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে ৭ হাজার ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার। এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৩৫০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বা প্রকৃত বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।
এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ নিতে পারেনি। উল্টো ৭ হাজার ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ দিতে হয়েছে।
এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিল বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে ঘাটতি ধরা আছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ধরা আছে।
বিক্রি কমায় ২০২৩ সালের ১লা জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার। উল্টো ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি। ২০২১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় তখনকার সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষে ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের জানুয়ারি শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৫৬ কোটি টাকায়।
কোন সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কতো বেড়েছে: জানুয়ারিতে প্রচলিত সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হারই বেড়েছে। যেকোনো সঞ্চয়পত্রে মেয়াদের প্রথম বছরে মুনাফার হার কম থাকে, মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার বছরে মুনাফার হার সবচেয়ে বেশি। সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতায় যত ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র।
পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর এতদিন পরিবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল ১১.৫২ শতাংশ। এখন মুনাফা বৃদ্ধির ফলে এই সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ থাকলে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার হবে সাড়ে ১২ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে কিছুটা কম, ১২.৩৭ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ থাকলে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার হবে ১২.৫৫ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফার হার হবে ১২.৩৭ শতাংশ। এতদিন এই সঞ্চয়পত্র কিনলে পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর মুনাফার হার ছিল ১১.৭৬ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও বেড়েছে। এতদিন এই সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল সর্বোচ্চ ১১.২৮ শতাংশ। এখন থেকে এই সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ থাকলে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার দাঁড়াবে ১২.৪০ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১২.৩৭ শতাংশ। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলেও বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে।
এতদিন এই সঞ্চয়পত্র কিনে তিন বছর পর মেয়াদ পূর্তির বছরে মুনাফার হার দাঁড়াতো ১১.০৪ শতাংশ। নতুন নিয়মে এই সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার হবে ১২.৩০ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার হবে ১২.২৫ শতাংশ।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবেও মুনাফার হার বাড়ানো হয়েছে। তিন বছরে মেয়াদ পূর্তি শেষে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফার হার বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২.৩০ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার ১২.২৫ শতাংশ।