দেশ বিদেশ
শিল্পকারখানার কাঁচামালের সংকট রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহ ব্যাহতের শঙ্কা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলো। কিছু ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। এতে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ভ্যাটের বাড়তি চাপ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহে ঘাটতি। সবমিলিয়ে বন্ধের পথে শিল্প কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া। আর এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় বৃদ্ধির মধ্যে আগামী রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে দেশে বিনিয়োগ না করে আত্মসাৎ ও বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকগুলোও রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। তাই ঋণখেলাপি শিল্প কারখানাগুলোকে সহায়তা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা কঠিন সময় পার করছেন। শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না কিছু ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে। এরমধ্যে শরিয়াভিত্তিক কয়েকটি ইসলামিক ব্যাংক অন্যতম। এর ফলে দেশের তেল-চিনিসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন, নির্মাণশিল্পের তৈরি উপকরণ, ওষুধ ও বস্ত্র খাতের মতো বৃহৎ শিল্পগুলোতে উৎপাদন ব্যাপক হারে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, দেশের বেশ কয়েকটি বড় বড় শিল্পগ্রুপ ইতিমধ্যে এলসি খুলতে না পেরে তাদের উৎপাদন কমিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ কাঁচামাল নেই। এ কারণে চট্টগ্রামভিত্তিক ও ঢাকার কয়েকটি শিল্পগ্রুপ ইতিমধ্যেই কারখানা বন্ধ করেছেন। এদের অনেকেই শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেয়া সত্ত্বেও এলসি করতে অপারগতা প্রকাশ করছে কিছু ব্যাংক। এরমধ্যে এলসি না করে শুধু পূর্ববর্তী ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। সামনে রমজান মাস, দেশের ভোগ্যপণ্য চাহিদা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু সেই অনুযায়ী এলসি খোলা এবং তার বিপরীতে মাল শিপমেন্টের অবস্থা সন্তোষজনক নয়।
বাজার দর: দাম বাড়ানো হলেও বাজারে কৃত্রিম সংকট কাটেনি বোতলজাত সয়াবিন তেলের। বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৮৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা ও খোলা চিনি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ও পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, কাঁচামালের অভাবে প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপের সুগার রিফাইনারি মিল। ব্যাংকের সহযোগিতা ও সরকারের সহায়তা পেলে আসন্ন রোজার আগে সুগার মিল চালু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। দেশবন্ধু গ্রুপের দাবি, ব্যাংকিং জটিলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে অপরিশোধিত, পরিশোধিত চিনি আমদানি করতে পারছে না। যে কারণে সুগার রিফাইনারি বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছে। তাদের দাবি, দেশবন্ধু গ্রুপের সুগার মিলে প্রতি বছর ৩ লাখ টনের মতো চিনি প্রক্রিয়াজাত করে। আসন্ন রোজায় চিনি সরবরাহ ও দাম ঠিক রাখতে কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকের এলসি (ঋণপত্র) জটিলতা নিরসন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাকির হোসেন অভিযোগ করে বলেন, এই গ্রুপটির অধীনে ২৮টি কোম্পানির প্রায় ১৭ ধরনের শিল্প-কারখানা রয়েছে। অথচ ইসলামী ব্যাংকগুলো কিছুদিন থেকে শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেয়ার পরেও এলসি দিচ্ছে না। এমনকি সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট কন্ট্রাক্টের আওতায় কাঁচামাল আমদানি করতেও সহায়তা করছে না। এসব বিষয় তুলে ধরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে দেশবন্ধু গ্রুপ। রিশিডিউল না করে বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে ক্লাসিফাইড হিসেবে প্রদর্শন করেছে। বর্তমানে ৮টি ব্যাংকে গ্রুপটির কোনো ঋণ নেই। দেশবন্ধু গ্রুপ লোনের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করেছে। এলসি না দেয়ার কারণে, কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিএফও বশির আহমেদ জানান, দেশবন্ধু গ্রুপই পড়েনি, বরং দেশের সব ধরনের কোম্পানি সাফার করছে।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে হত্যা করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে খেলাপি করার শর্ত দেয়া হয়েছে। আবার আগামী মার্চ থেকে একটি কিস্তি (তিন মাস) পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেই খেলাপি করা হবে। তিনি বলেন, এখন নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ী সমাজ। যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতে পারেন। তাই ঋণখেলাপি আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই শঙ্কা হচ্ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে, ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সবকিছু মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না। উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকিন আহমেদ বলেন, ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ব্যবসায়িক খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা সরাসরি পণ্যের দামে প্রভাব ফেলে।