ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২ রজব ১৪৪৬ হিঃ

অর্থ-বাণিজ্য

গার্মেন্টস শিল্পের বড় হাব হতে যাচ্ছে উত্তরা ইপিজেড

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

(১ মাস আগে) ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৫:০৬ অপরাহ্ন

mzamin

ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাড়ে সাতটা। ঘন কুয়াশায় ২০ গজ দূরের কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। একইসঙ্গে কনকনে শীত। প্রচুর ঠাণ্ডা বাতাশ। ঠাণ্ডা, শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে হাজার হাজার কর্মী ঢুকছেন নিজেদের কর্মস্থলে কাজের জন্য। কেউ পায়ে হেঁটে আবার কেউ মোটরবাইকে করে। সত্যিই অসাধারণ এই দৃশ্য দেশের সবচেয়ে অবহেলিত উত্তারাঞ্চলের নীলফামারী জেলায় অবস্থিত উত্তরা ইপিজেডের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, দিনে প্রায় ২২ হাজারের বেশি মোটরবাইক ইপিজেডের গেট দিয়ে প্রবেশ করে। সারিবদ্ধভাবে যাওয়ার দৃশ্য সত্যি যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। কর্মীদের পায়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যটিও খুবই মনোমুগ্ধকর। মূল ফটক থেকে একটু আগালেই হাতের বাম পাশে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের কারখানা। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে কারখানার সামনে গিয়ে দেখা যায় আরো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। কারখানায় সেন্টারলি মাইকে উচ্চস্বরে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের তেলওয়াত হচ্ছে। গেট দিয়ে সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করছেন নারী-পুরুষ কর্মীরা। প্রবেশ করেই যার যার কাজের জায়গাতে যুক্ত হচ্ছেন। সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার নারী-পুরুষ কর্মী প্রবেশ করেন। ঘড়িতে ৭টা ৫৫ মিনিট বাজার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেলো কোরআন তেলওয়াত। বাজতে থাকে জাতীয় সংঙ্গীত। উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা। এ সময় কারখানা ভেতর-বাইরে যে যেখানে, যেভাবে ছিলেন, সবই স্টাচু হয়ে যায়। কর্মীদের মধ্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংঙ্গীতের সম্মানবোধ এতোটা হতে পারে তা যে নিজের চোখে দেখবে না তারপক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, এ দৃশ নতুন নয়, এটা প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্কের মতো। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় মূলকাজ। চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এরপর দেয়া হয় নামাজ ও খাবারের বিরতি। এখানেও পরিপালন হয় স্বাস্থ্যবিধি। কারখানার নিজস্ব ক্যান্টিনে একসঙ্গে ৫০০ থেকে ৬০০ কর্মী লাইন করে বসে সবাই দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন। ২০ মিনিট পর আসে আরেক গ্রুপ। এভাবে ২ হাজার ৫০০ জন কর্মী দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষ করেন। আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ও সারিবদ্ধ ভাবে চলাচল করে শ্রমিক-কর্মচারীরা।

কারখানায় কর্মরত কর্মীর ৯৫ শতাংশ স্থানীয় বাসিন্দা। তাদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সবাই নিজেদের কর্মে ও প্রাপ্য বেতন-ভাতায় ব্যাপক সন্তুষ্টি। ১২ হাজার ৮০০ টাকার কমে কারো বেতন নেই, দক্ষতা অনুসারে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন কর্মীরা। তবে ২৫ হাজার টাকার বেশি বেতনের কর্মী সংখ্যা অনেক কম। প্রতিষ্ঠানকে ভালোবেসে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করেন কর্মীরা।

আঁখি নামে এক সুয়িংয়ের কর্মী বলেন, আগে ঢাকার সাভারে কাজ করতেন। সেখানে অভার টাইমসহ মোট ১৮ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পেতেন, তা দিয়ে ঘরভাড়া ও খাওয়া-দাওয়ার পর হাতে বেশি টাকা থাকতো না। কিন্তু এখানে অভার টাইম ছাড়াই ১৪ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। পাশেই বাড়ি হওয়ায় বাড়তি কোনো খরচ নেই বললেই চলে। ফলে পুরো টাকাই হাতে থাকে। তার চেয়ে বড় কথা নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারছেন তিনি। এর চেয়ে বড় কথা আর কি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন আঁখি। 
সাইফুল নামে ফিনিসিংয়ের কর্মী বলেন, তিন বছর ধরে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসে কাজ করছেন। কাজের পরিবেশ ও কর্মকর্তাদের ব্যবহার এককথায় অমায়িক। তিনি এর আগে গাজীপুরের একটি কারখানায় কাজ করতেন। এ ধরনের পরিবেশ তিনি সেখানে পাননি। তাছাড়া করোনার সময় কারখানা বন্ধ হওয়াতে এলাকায় চলে যান তিনি। বাড়িতে গিয়েই দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের খবর পান, যথাযথ নিয়ম মেনেই চাকরিতে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে তার বেতন ১৯ হাজারের একটু বেশি। নিজের এলাকায় নিজের পেশার কাজে ভালো বেতনে কাজ পাওয়ায় মহাখুশি সাইফুল। মা-বাবা, ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তান সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

সম্প্রতি ইপিজেড কারখানা প্রাঙ্গণে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের জেনারেল ম্যানেজার (প্রডাকশন) ইসুরু উমেশ সাংবাদিকদের জানান, উত্তরবঙ্গে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালে। এটিই বর্তমানে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় পোশাক কারখানা। এখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চায়না-বাংলা যৌথ ব্যবস্থাপনায় কারখানার উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। তবে এখানকার উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা শতভাগ বিদেশি। উত্তরা ইপিজেডের ২৩টি কোম্পানি বিনিয়োগ করে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এক কথায় আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলতে যা বুঝায় দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস তার বাস্তব উদাহরণ।

দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) মো. ইব্রাহিম আকন জানান, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের উৎপাদিত পণ্য শতভাগ রপ্তানি হয়। বর্তমানে উইরোপের বড় দুটি দেশ এখানকার উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা। এর একটি হচ্ছে ইউএসএর জি-থ্রি, কসকো ও ডিকনি। অন্যটি হলো স্পেনের ম্যাঙ্গো কোম্পানি। নতুন করে আরও কয়েকটি দেশ ও কোম্পানিকে যুক্ত করার জোর চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ইউকের প্রাইমার্ক কোম্পানিটি মোটামুটি আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে যে কয়টি কোম্পানির অর্ডার রয়েছে তা ডেলিভারি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কারখানায় বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। অটো সেটআপ মেশিন স্থান পেয়েছে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলে; যা দেশের হাতে গোনা কয়েকটি কারখানায় ব্যবহৃত হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের হেড অব এইচ আর, এডমিন অ্যান্ড কমপ্লাইন্স মো. আশরাফ উল্লাহ বলেন, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কর্মসংস্থান ব্যাপকহারে সৃষ্টি হয়েছে। উত্তবঙ্গের দরিদ্র দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উত্তরা ইপিজেড। বর্তমানে ২৬০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে ইপিজেডটি। এই ইপিজেডের ব্যাপক চাহিদার কারণে এর আকার আরও বেড়ে প্রায় ৩০০ একর হচ্ছে। বর্তমানে ২৩টি কারখানায় প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছে। সমগ্র উত্তরা ইপিজেডের কাজ তরানিত্ব করতে ও রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে উত্তরবঙ্গের অবকাঠামো আরো সংস্কার ও উন্নয়ন দরকার। এখানে আরও কয়েকটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তরবঙ্গের চেহারা পাল্টে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ ছাড়া আরও কয়েকটি কারখানা চালু হলে গার্মেন্টস হাব হবে উত্তরা ইপিজেড।

দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলের মার্সেনডাইজিং ম্যানেজার এফ এম শফিউল আজম জানান, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস বর্তমানে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় পোশাক কারখানা। এখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে বর্তমানে আড়াই হাজার কর্মী কাজ করছেন। তিনি বলেন, দেশবন্ধু টেক্সটাইল কারখানায় দুই ভবনে মোট ৫৬টি লাইনের মধ্যে বর্তমানে ২৪টি লাইনে পুরোদমে উৎপাদন চলছে।

কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস শতভাগ রপ্তানিবান্ধব প্রতিষ্ঠান। যাতে এমব্রয়ডারি, ডেনিম গার্মেন্টস, ওয়াশিং ইউনিট এবং প্রিন্ট সুবিধা রয়েছে। প্রতিবছর এখান থেকে এক কোটি ৭৪ লাখ ৭২ হাজার পিস ডেনিম /চিনো/কার্গো প্যান্ট, আউটওয়্যার, ফেন্সি অ্যাপারেলস উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে। তবে বর্তমানে সব কয়টি লাইন চালু না হওয়াতে বার্ষিক উৎপাদন হচ্ছে ৬০ লাখ পিস। সর্বমোট আয়তন দুই লাখ ৭১ হাজার ২৭২ বর্গফুট। এতে ইটিপি প্ল্যান্ট ও ওয়াশিং প্ল্যান্ট সুবিধাও বাস্তবায়ন হয়েছে। দেশবন্ধু টেক্সটাইলস তার পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরির মাাধ্যমে মনোনিবেশ করেছে যা পরিবেশ গত সমস্যা নিরসন ও জ্বালানি উৎকর্ষ বৃদ্ধি করছে।
 

অর্থ-বাণিজ্য থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

অর্থ-বাণিজ্য সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status