ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

বিশ্বজমিন

প্রসিকিউটর থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী

মানবজমিন ডেস্ক
৪ নভেম্বর ২০২৪, সোমবারmzamin

ঠিক তিন মাসের কিছু বেশি সময় আগের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। ঘোষণা করলেন তার অতীত ও ভবিষ্যৎ। এর মাত্র একদিন আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হিসেবে কমালা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়ে যান। তখন কমালা হ্যারিসের সামনে প্রচারণা চালানোর সময় খুব কম। অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। ফলে যে তিন মাসের একটু সামান্য সময় বেশি ছিল, তার মুহূর্তও নষ্ট করেননি কমালা। রাজনীতিতে একটি কথা আছে- হয়তো নিজেকে পরিচিত করো না হয় তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীই তোমাকে পরিচিত করে তুলবে। ঠিক ওই মুহূর্তে কমালা হ্যারিস মার্কিন জনগণের সামনে প্রথম বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তার রেকর্ড অথবা একজন সিনেটর হিসেবেই পরিচয় দেননি। একই সঙ্গে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার একজন প্রসিকিউটর হিসেবে অনেক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তাও জানিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনে তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে কমালা বলেন, সব রকম অপরাধীকে দেখে নিয়েছি। তার মধ্যে আছে নারী নির্যাতনকারী, ভোক্তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া প্রতারক, নিজেদের লাভ অর্জনের জন্য যারা আইন ভেঙে প্রতারণা করেছে। নির্বাচনী প্রচারণায় এসব কথা তিনি বার বার বলেছেন। ৬০ বছর বয়সী কমালা এই নির্বাচনকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা একজন প্রসিকিউটর এবং একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির মধ্যে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।

 তিনি অব্যাহতভাবে ডনাল্ড ট্রাম্পের আইনি ঝামেলাগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন  ভোটারদের। ক্যালিফোর্নিয়ার কোর্টরুমের  ভেতরে এবং বাইরের দিনগুলোর দিকে যদি ফিরে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে কমালা নিজেকে সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার বিরোধী পক্ষ তাকে নিয়ে যা বলেন তা তার রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে। তারা তার সেই অধ্যায়টিকে স্পর্শ করতে পারেন না। ক্যালিফোর্নিয়ার আলামেডা কাউন্টিতে একটি আইনি স্কুল থেকে আইন প্রয়োগের যাত্রা শুরু হয়েছিল কমালা। এর অধীনে পড়ে বার্কলে এবং তার নিজের শহর ওকল্যান্ড। ১৯৯০-এর দশকে সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সহিংস অপরাধের বিরুদ্ধে লড়ছিল ওকল্যান্ড। কমালা হ্যারিসের মতো তখনকার একজন জুনিয়র প্রসিকিউটরের জন্য এ কাজটি ছিল দুঃসাধ্য। ওই সময় কমালার সঙ্গে কাজ করেছেন তেরেসা ড্রেনিক। তিনি বলেন, কিন্তু এসব মামলার ভয়াবহতার অর্থই হলো একজন তরুণ ও উচ্চাভিলাষী অ্যাটর্নির জন্য এটা ছিল একটি টপ জব। পরিবেশটা ছিল পট বয়লারের মতো। প্রতিদিন যে বেদনা ও ক্ষোভের বিষয় তার মুখোমুখি হওয়া ছিল কঠিন। আমাদের জন্য এটা ছিল আরও তীব্র। অপরাধের মাত্রা ছিল খুবই ভয়াবহ। বিষয়টি ছিল কোকেন মহামারির মতো। গ্যাং মার্ডার হচ্ছিল। রাস্তার কোণায় হত্যাকাণ্ড হতো। মিস ড্রেনিক এবং হ্যারিস একই ট্রায়াল টিমে কাজ করেছেন। তিনি স্বীকার করেন, জুরিদের সামনে কমালা হ্যারিস থাকতেন আত্মবিশ্বাসী। তার সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ক্রমাগত বেড়েছে। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিষয় দেখে এমন একটি কোর্টে কমালাকে অন্য একটি টিমে স্থানান্তরিত করা হয়। কমালা ছিলেন নির্যাতিত শিশুর প্রতি খুব, খুব বেশি যত্নশীল। তিনি তাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতেন যে, তারা তার সঙ্গে মিশে যেতো এবং সব কথা প্রকাশ করে দিতো। 

এটা ওই সময় ছিল যখন কমালা হ্যারিস ডেটিং দিচ্ছিলেন স্থানীয় রাজনীতির কিংমেকার এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট অ্যাসেম্বলির স্পিকার উইলি ব্রাউনের সঙ্গে। বর্তমান গভর্নর গাভিন নিউসম, সান ফ্রান্সিসকোর মেয়র লন্ডন ব্রিড সহ রাজ্যের সবচেয়ে সুপরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করেছেন উইলি ব্রাউন। ওই সময় কমালা হ্যারিসকে দুটি রাজ্যের বোর্ডে নিয়োগ দিলেন এবং তাকে সান ফ্রান্সিসকোর হাইপ্রোফাইল ডেমোক্রেট ডোনারদের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ১৯৯৫ সালে ওই শহরের মেয়র নির্বাচিত হন উইলি ব্রাউন। এরপরই কমালার সঙ্গে তার স্বল্প সময়ের মন দেয়া-নেয়ার ইতি ঘটে। এর তিন বছর পরে সান ফ্রান্সিসকো ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিসের দায়িত্বে আসেন কমালা হ্যারিস। উইলি ব্রাউন ছিলেন তার চেয়ে ৩০ বছরের বড়। তাদের সম্পর্কের সময় শহরের কিছু হেভিওয়েট রাজনীতিকের সঙ্গে মেশা শুরু করেন। সান ফ্রান্সিসকোর রাজনীতিতে রাজনৈতিক মেশিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর কারণ, দেশের সবচেয়ে সেরা কিছু রাজনীতিকের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে এই রাজ্যে। তার মধ্যে আছেন প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, প্রয়াত সিনেটর ডিয়ানে ফেইনস্টেইন। তাদের দু’জনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন কমালা। গাভিন নিউসমের মতোই তিনি উঠে আসতে থাকেন। রাজনীতির বিশ্বে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলেন। সান ফ্রান্সিসকোর রাজনীতি ছিল রাফ অ্যান্ড টাফ। সেখান থেকে দ্রুততার সঙ্গে উঠে আসেন কমালা। এ সময়েই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অন্যতম একজন বন্ধুর সাক্ষাৎ পান তিনি। তিনি ডেমোক্রেটদের উল্লেখযোগ্য সবচেয়ে বড় ডোনার। তিনি হলেন অ্যাপল কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের বিধবা স্ত্রী লরেন্স পাওয়েল। সান ফ্রান্সিসকো ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি পদে ২০০৩ সালে প্রচারণার সময় কমালা হ্যারিসের তহবিলে তারা দান করেন ৫০০ ডলার। তাকে হায়ার করেছিলেন যে ব্যক্তি তাকে হারিয়ে তিনি নির্বাচিত হন। তার ২০ বছর পরে বিলিয়নিয়ার এই হিতৈষী বাইডেন-কমালার পুনঃনির্বাচনী প্রচারণায় প্রায় ১০ লাখ ডলার দান করেন। এ তথ্য ফরচুন ম্যাগাজিনের। তবে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমালাকে কতো অর্থ ডোনেট করেছেন লরেন্স পাওয়াল তা এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এই অঙ্ক অনেক বেশি হবে। 

২০০৪ সালে ইস্টারের একদিন আগে সান ফ্রান্সিসকোতে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে কমালা হ্যারিসের দায়িত্বের ঠিক চার মাসের মধ্যে একটি গ্যাংয়ের এক সদস্য একে-৪৭ রাইফেল ব্যবহার করে ২৯ বছর বয়সী পুলিশ কর্মকর্তা আইজাক এসপিনোজা’কে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড পুরো শহরকে বিস্মিত করে। অনেক রাজনীতিক এবং পুলিশের প্রথম সারির অনেক সদস্য এর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন। কিন্তু এর বিরোধিতা করেন কমালা হ্যারিস। এটাই ওই শহরে শীর্ষ প্রসিকিউটর হওয়ার ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক যাত্রা। তিনি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন জেল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। হত্যাকাণ্ডের ঠিক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনি এই মত প্রকাশ করেন। আইজাক এসপিনোজার স্ত্রী বলেন, কিন্তু তিনি পরিবারের সঙ্গে আলোচনা না করে কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা বুঝতে পারছি না। দ্রুততার সঙ্গে এমন বিরোধিতা সামনে চলে আসে। ওই কর্মকর্তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিনেটর ফেইনস্টেইন। তিনি খুনিকে চূড়ান্ত মূল্য দেয়ার দাবি তোলেন। গির্জায় প্রার্থনা সভা শেষে তিনি বেরিয়ে আসেন। বলেন, তিনি জানতেন কমালা হ্যারিস মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হবেন। কিন্তু সান ফ্রান্সিসকো ক্রোনিকলে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে একটি মতামত কলাম লেখেন কমালা। তাতে তিনি বলেন, নীতির ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। ওই সময় কমালার সিদ্ধান্তের সমর্থন করেছিলেন দীর্ঘদিনের নাগরিক অধিকার বিষয়ক অ্যাটর্নি জন বারিস। তিনি বলেন, কমালার জন্য রাজনৈতিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করেন। তা সত্ত্বেও তিনি একজন হিতৈষী হিসেবে এটা করেছেন। তাই কমালা তার সিদ্ধান্তে একেবারেই জোরালো অবস্থানে ছিলেন। তিনি যথেষ্ট বিতর্ক সয়েছেন। এই ঘটনা তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু কমালা তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। এই কমালা ওকল্যান্ড শহরে একটি কর্মজীবী পরিবারে একজন সিঙ্গেল মা হিসেবে বড় হয়েছেন। ২০১০ এবং ২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কমালা হ্যারিসের দু’টি সফল প্রচারণা বিষয়ক ম্যানেজার ছিলেন ব্রায়ান ব্রোকাউ। তিনি বলেন, কমালা হ্যারিস কি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব? উত্তরে বলতে হয়, একেবারেই নয়। যদি প্রশ্ন করা হয় তিনি কি প্রাকৃতিকভাবেই দক্ষ? উত্তরে বলতে হয়- হ্যাঁ। তিনি শেষের ফলের দিকে দৃষ্টি দেন। সান ফ্রান্সিসকো ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে প্রথম যে বড় সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন তা থেকে তিনি কিছু শিক্ষা নিয়েছেন বলে মনে হয়। চার বছর পরে তিনি আবারো এক নাটকীয় হত্যাকাণ্ডের পর মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেন। কিন্তু এবার তার সিদ্ধান্ত কীভাবে প্রতিফলিত হবে বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সান ফ্রান্সিসকোতে তিন ছেলেকে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন টানি বোলোগনা। এক পর্যায়ে অস্ত্রধারী তাদের গাড়ি থামায়। তার দুই ছেলেকে হত্যা করে সে। তৃতীয় জন মারাত্মক আহত হয়। এর অল্প পরেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে এডউইন র‌্যামোন উমানা নামের একজন এমএস-১৩ গ্যাংয়ের সদস্যকে। তার একজন শত্রু ছিল। তাকে খুন করার মিশনে নেমেছিল উমানা। কিন্তু ভুল করে সে ৪৯ বছর বয়সী বোলোগনাকে টার্গেট করে ফেলে।

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status