দেশ বিদেশ
যে কথা বলতে পারছেন না রুমানা
জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
২৫ জুলাই ২০২২, সোমবার
অপমানের তীর ছোড়া হয়েছে বারবার। সেই ক্ষতের মধ্যে এলো বদলির আদেশ। এবার বিভাগীয় মামলা, কারণ দর্শাও নোটিশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমানা আক্তার এবং সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসি-ল্যান্ড) সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক এই বিধি ব্যবস্থা আলোচিত নানা কারণে।
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন উপলক্ষে গত ২০শে জুলাই আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সে জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হওয়ার তথ্য দেন। এর আগে গত ১২ই মে ওই উপজেলায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় গৃহ নির্মাণে ক্রুটি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে সুপারিশ পাঠান।
এতে ওই উপজেলায় নির্মাণাধীন ১শ’টি গৃহের প্রতিটিতে গ্রেড বিমে নিম্নমানের রড এবং অধিক দূরত্বে রিং ব্যবহার করার মাধ্যমে অনিয়ম ও ত্রুটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়। ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে সুপারিশের চিঠিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আক্তার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাপস চক্রবর্তী, উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম সুমন, এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী কর্তৃক নিয়োগকৃত উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসাইন এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফুল ইসলাম গৃহ নির্মাণ কাজ যথাযথ তদারকি না করে দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতি করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। তবে তাদের কারও বিরুদ্ধে সরাসরি অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। ইউএনও এবং এসি-ল্যান্ড বদলি হলেও পিআইও এবং প্রকৌশলীরা নিজনিজ কর্মস্থলেই রয়েছেন এখনো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আক্তার চট্টগ্রামের বাঘাইছড়ি এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফুল ইসলাম বর্তমানে থানচিতে কর্মরত।
জেলা প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা গত ২৮শে এপ্রিল আখাউড়ায় আশ্রয়ণের ওইসব ঘর নির্মাণ সাইট পরিদর্শন করতে যান। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, সে সময় সাততারা, খোলাপাড়া, চানপুর সাইটে চরম অপমানকর আচরণ করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি তথা উপজেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কর্মকর্তাদের আলাদা আলাদা করে দাঁড় করানো হয়। চানপুরে পিআইও এসি-ল্যান্ড এক সঙ্গে দাঁড়ানো ছিলেন। শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে জেলা থেকে যাওয়া একজন কর্মকর্তা তাদের পাশে দাঁড়ান। এটি দেখে শীর্ষ কর্মকর্তা তার সঙ্গী ওই কর্মকর্তাকে চোরদের পাশে কেন দাঁড়িয়েছে বলে ধমক দিয়ে সরে আসতে বলেন। মোগড়া ইউনিয়নের খোলাপাড়া সাইটে নারী কর্মকর্তার শারীরিক গঠন নিয়ে মন্তব্য করে শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘মোটির ঘরের মোটি।’ তাকে লাথি মারার কথা বলেন। এসি-ল্যান্ড এবং পিআইওকে চোর, দুর্নীতিবাজ এবং ঘুষখোর বলে গালাগাল করেন। এসি-ল্যান্ডের কাছে জানতে চান তার ঘরে এসি আছে কিনা। বলেন, ‘তোর বাপ কী করে।’ ঘটনাস্থলেই জনসম্মুখে এ ধরনের আচরণের পরিসমাপ্তি ঘটেনি, ওই কর্মকর্তার মিলনায়তনে ভরা মিটিংয়ে, অফিস কক্ষে এবং বাংলোতে আপত্তিকর বাক্য প্রয়োগে বারবার অপমান-অপদস্থ করা হয় তাদের। যা শিষ্টাচারের সকল সীমা অতিক্রম করে বলে সূত্রগুলো জানায়। সূত্র জানায়, উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির একটি বৈঠকে আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আক্তার তার বক্তব্য দেয়ার জন্যে মাইক্রোফোন অন করতে চাইলে সেটি অন হচ্ছিল না। এটি চালু করার জন্য ২-৩ বার চেষ্টার মুহূর্তে শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার মাইক্রোফোন লাগবে না। এমন ব্যবস্থা করবো সারা বিশ্ব আপনাকে চিনবে। মাইক্রোফোন ছাড়াই বলেন।’ বৈঠক শেষে ওই কর্মকর্তার কক্ষে গেলে আবারো রুমানা আক্তারকে উদ্দেশ্যে করে বলতে থাকেন, বিশ্ব চোর। তার রুমে থাকা বাইরের অফিসারদের (সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী, ফোর লেনের প্রকল্প পরিচালক ও সমাজসেবা কর্মকর্তা) বলেন, ‘চোরের দিকে তাকিয়ে দেখেন।’ এরপর ২৯শে এপ্রিল তার বাংলোতে ডেকে নেন আখাউড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের। সেখানেও এসি-ল্যান্ড এবং পিআইও’র সামনে আরেক দফা অপমান করা হয় রুমানা আক্তারকে। লাথি মেরে গাছে উঠিয়ে দেয়ার কথা বলেন। কর্মকর্তারা পদস্থ কর্মকর্তার এই আচরণ নীরবে সহ্য করেন।
মাদারীপুর জেলা সদরের বাসিন্দা ৩৩ ব্যাচের রুমানা আক্তার আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ২০২১ সালের ৫ই জুলাই। ১০ মাস ১৭ দিন চাকরির পর গত ২২শে মে বিদায় নেন এখান থেকে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৬৫৩টি ঘর নির্মিত হচ্ছে আখাউড়ায়। এর মধ্যে ১ম পর্যায়ে ৪৫টি, ২য় পর্যায়ে ৬০৬টি এবং ৩য় পর্যায়ে ২টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়।
আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৬শ’ ঘর নির্মাণের দায়িত্ব ছিল ইউএনও রুমানা আক্তারের কাঁধে। তার যোগ দেয়ার আগে ৫০টি ঘর নির্মাণ সম্পন্ন হয়। তিনি যোগদানের পর ৯টি স্পটে ২শ’ ঘর নির্মাণের কাজে হাত নেন। সবগুলো ঘরের কাজ একসঙ্গে দেখাও দুরূহ ছিল। যখন পরিদর্শনে গেছেন তখন সব ঠিকঠাক পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ঠিকাদাররাই অনিয়ম করেছে। কাজের ফাঁকফোকর ঠিকাদার, পিআইও এবং ইঞ্জিনিয়ারই ভালো বোঝেন। রড বা রিং কোথায় কতো গ্যাপে হবে সেটি অন্যদের ধরার সুযোগ নেই। আর রডের বিমগুলো ঢালাই করা হয়েছে বিকালে বা সন্ধ্যার পর। ইউএনও’র বদলির খবরে আখাউড়ার সবশ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন বাবুল তার ফেসবুকে পোস্টে বলেন, ‘জনবান্ধব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আক্তারের বদলিতে আখাউড়াবাসী অত্যন্ত ব্যথিত ও দুঃখিত। উনি উপজেলাবাসীর জন্যে মনেপ্রাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সততা নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে বহু জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।’ জেলায় প্রথম পর্যায়ে ১০৯১টি ঘরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ২য় পর্যায়ে ৩ হাজার ঘরের কাজ হাতে নেয়া হলেও সম্পন্ন হয় মাত্র ১৪৫২টি। আর তৃতীয় পর্যায়ের ১৭৩৯টি ঘরের মধ্যে ১১৯৯টি ঘরের উদ্বোধন করা হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলায় ঘর নির্মাণ কাজ চললেও শুধু আখাউড়াতে মাননিয়ন্ত্রণ যেভাবে দেখা হয়েছে অন্য কোথাও সেভাবে দেখা হয়নি বলেই অভিযোগ উঠেছে। ব্যক্তি আক্রোশ এখানে কাজ করছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নারী কর্মকর্তাকে গৃহিণী বানিয়ে দেয়ার মন্তব্যও করেছেন ওই শীর্ষ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে জানার জন্য জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফ আহমেদ রাসেলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।