দেশ বিদেশ
নরসিংদী কারাগার থেকে বন্দির পলায়ন
জেল সুপার ও জেলার বরখাস্ত, ১৩৬ কয়েদির আত্মসমর্পণ
নরসিংদী প্রতিনিধি
২৫ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবারনরসিংদী জেলা কারাগারের জেল সুপার আব্দুল কালাম আজাদ ও জেলার কামরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে নরসিংদী জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের বরাত দিয়ে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গত শুক্রবার বিকালে দুষ্কৃতকারীরা নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে জেলখানায় থাকা ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ কারাবন্দি পালিয়ে যায়। ওই সময় জেলখানার অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, আট সহস্রাধিক গুলি লুট করা হয়। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সব নথি ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে এবং পলায়নরত আসামিরা যাতে আত্মসমর্পণ করে, সেজন্য গত রোববার রাত থেকে নরসিংদী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করা হচ্ছে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সোমবার ১০ জন ও মঙ্গলবার ১২৬ জনসহ মোট ১৩৬ জন কয়েদি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মাধ্যমে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল হকের আদালতে আত্মসমর্পণ করে।
যেভাবে হামলার সূত্রপাত
নরসিংদী জেলা কারাগারটি শহরের ভেলানগরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। এই ভেলানগর ও জেলখানা মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত কয়েকদিন ধরেই লাগাতার বিক্ষোভ-সমাবেশ করছিলেন। শুক্রবারও সেখানে একই রকমভাবে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছিলেন। তবে সেদিন সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের খুব একটা দেখা যায়নি। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ করেই হাজারো জনতা কারাগারের দিকে এগোতে থাকে। তারা গিয়ে সেখানে প্রথমে ইটপাটকেল, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। হামলাকারীদের প্রায় সবার হাতে লাঠিসোটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এ সময় প্রাথমিকভাবে কারারক্ষীরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কিন্তু একপর্যায়ে কারারক্ষীরা পিছু হটে। তখন হামলাকারীরা কারাগারের দুই দিকের ফটক অনেকটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় হামলায় চার কারারক্ষী গুরুতর আহত হয়। পরে কারারক্ষীরা নিরুপায় হয়ে জেলখানার ভেতরে ঢুকে নিজেদের রক্ষা করেন। জেল কোড অনুযায়ী, গুলি করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা মূল কারাগারের ভেতরে ঢুকে সেলগুলো শাবল ও লোহার জিনিসপত্র দিয়ে ভেঙে কয়েদিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। কিছু কারারক্ষীর কাছ থেকে চাবি নিয়েও সেলের তালা খোলা হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েদিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এরমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৯ সদস্য ছিল; যাদের মধ্যে দু’জন নারী। কোনো কোনো সাধারণ কয়েদি পালিয়ে যেতে না চাইলে তাদের মারধর করে জেল থেকে বের করে দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা কারাগারের পোশাক নিয়েই পালিয়ে যায়। কারারক্ষীরা পিছু হটার পর অস্ত্র ভাণ্ডার ভেঙে মোট ৮৫টি অস্ত্র ও কয়েক হাজার গুলি লুট করে হামলাকারীরা। এ সময় কারাগারের ভেতরে কয়েদিদের থাকা খাবারও লুট করা হয়। বন্দিদের কাছে থাকা টাকাও ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। কারাগারের ভেতরে কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের থাকার কোয়ার্টার ও ব্যারাক রয়েছে। সেসব আবাসিক ভবনে অনেকে পরিবার নিয়েও থাকেন। হামলাকারীরা সেসব ভবনেও হামলা চালায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। লুটপাটও চালানো হয়। হামলার সময় পুরো আবাসিক এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের পরিবার আবাসিক এলাকার ভেতরে মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেও হামলার চেষ্টা চালানো হয়। হামলার বর্ণনা দিয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারের জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আক্রমণের সময় কয়েক হাজার হামলাকারী এসে প্রথমে কারাগারের মূল ফটক ভেঙে ফেলে এবং ভেতরের ফটক আক্রমণ করলে কারারক্ষীরা প্রথমে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ বাঁচাতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। একপর্যায়ে জেল সুপার, জেলারসহ অন্যরা নিজেদের কক্ষ ছেড়ে জেলের ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং তারা বন্দিদের সঙ্গে মিশে যান। এতেই তাদের প্রাণরক্ষা হয় বলে জানান জেল সুপার। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা প্রতিটি সেলে ঢুকে শাবল, চাপাতি, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে তালা ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে এবং পালাতে উৎসাহ দেয়। এ সময় অস্ত্র ও চাল-ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য লুট হয়।’ এ ঘটনার সময় জেলা পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল জানিয়ে জেল সুপার বলেন, ‘আমি বিষয়টি পুলিশ সুপারকে অবহিত করি। তখন পুলিশ সুপার জানান, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। ফলে তিনি আমাদেরই কারাগার রক্ষার ব্যবস্থা নিতে বলেন।’
পুরস্কার ঘোষণা
সোমবার নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশের প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘অস্ত্র লুট হয়েছে। কেউ অস্ত্রধারী ধরিয়ে দিতে পারলে বিশেষ পুরস্কার, অস্ত্র উদ্ধার করে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কারাগারে হামলার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। যেহেতু এখানে অনেক ধরনের অপরাধ হয়েছে ফলে আরও মামলা হবে।
তদন্তে দুই কমিটি
নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা-অগ্নিসংযোগ ও কয়েদি পালানোর ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার বিকালে কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মশিউর রহমান এ তথ্য জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র যুগ্ম সচিব ড. ফারুককে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ একজন এডিশনাল আইজি প্রিজনকে প্রধান করে তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি করেছে। উভয় কমিটিকে আগামী ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ সময় মশিউর রহমান বলেন, এরইমধ্যে জেলা কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেখানে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি’র ক্যাম্প করা হয়েছে। কারাগারের বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ ব্যবস্থা সচল করা হয়েছে। পাশাপাশি ফটক ও সিসি ক্যামেরা মেরামত করা হয়েছে। কারাগারকে প্রাথমিকভাবে থাকার উপযোগী করা হয়েছে জানিয়ে মশিউর রহমান বলেন, ‘কয়েকজনকে সেখানে রাখা হয়েছে। এরপর কয়েদিদের মধ্যে যারা আত্মসমর্পণ করতে আসবেন তাদেরও এখানে রাখা হবে।’
সেনাপ্রধানের নরসিংদী কারাগার পরিদর্শন
নরসিংদী কারাগার ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুট ও আসামিদের বের করে নেয়ার ৫ দিন পর বুধবার দুপুর পৌনে ১টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান হেলিকপ্টারযোগে নরসিংদী মুছলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে অবতরণ করেন। পরে তিনি ১টা ২০ মিনিটে নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন। এ সময় নরসিংদী জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।