দেশ বিদেশ
প্রাণ ফিরেছে বুড়িগঙ্গার
রাশিম মোল্লা
১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবারকিছুদিন আগেও বুড়িগঙ্গার পানি ছিল আলকাতরার মতো কালো। দূষিত পানির দুর্গন্ধে নদীর পাড়ে যাওয়া যেত না। নাক চেপে খেয়াপারাপার হতেন যাত্রীরা। গত মাস থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি ও বর্ষার পানি বুড়িগঙ্গার ময়লা আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কালো পানির স্থলে বিরাজ করছে স্বচ্ছ পানি। বিকাল হতেই নদী ভ্রমণপিপাসুরা ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। মূলত দালান-কোঠার শহরে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সময় কাটাচ্ছে। দুপুর হতে না হতেই শিশু ও শ্রমিক শ্রেণির লোকজন গোসল করতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সত্যিই বুড়িগঙ্গা যেন নতুন সাজে সেজেছে। বর্ষার পানিতে টলমল করছে নদী। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বুড়িগঙ্গা। নগরের ময়লা আবর্জনার দূষণে শীত ও গ্রীষ্মে বুড়িগঙ্গার পানি এতটাই নোংরা থাকে যে, দুর্গন্ধে টেকা দায়। সেই বুড়িগঙ্গায় গিয়েই দেখা যায়, ঢেউয়ের উপরে ডেউ আছড়ে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে নদীপ্রেমীরা যেন আনন্দে আটখানা। কেননা বছরের বেশির ভাগ সময় বুড়িগঙ্গার পানি থাকে ঘোলা, কালো আর দুর্গন্ধযুক্ত। বর্ষা আসতে না আসতেই পানির স্বচ্ছতা বুড়িগঙ্গার সবকিছুকেই পাল্টে দিয়েছে। মুক্ত হাওয়া বইছে এখন বুড়িগঙ্গার দু’পাড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসছেন বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন অংশে।
কামরাঙ্গীর চরের বাসিন্দা লেখক শহীদ হায়াত মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে বুড়িগঙ্গা কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বর্ষা মৌসুমের কারণে বুড়িগঙ্গা পেয়েছে ভরা যৌবন। বাতাস ছাড়লেই নদীতে ঢেউ তোলে। সেই ঢেউয়ে নৌকা দোল খায়। তার সঙ্গে দোলে যাত্রীরা। তিনি বলেন, বর্ষার সময় বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে নৌকা বাইচ হতো। কিন্তু এখন আর হয় না। কথা হয় নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির সহ-সভাপতি রণজিত চন্দ্র সরকারের সঙ্গে তিনি বলেন, নগরবাসীকে বিনোদন এবং বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ টিকিয়ে রাখতে এই সময়ে বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইচ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা যেতে পারে।
বেগম বদরুন নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিনা বেগম বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী একটি জীবন্ত ইতিহাস। বর্ষা মৌসুমের আগে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকে। বর্ষা মৌসুমে পাল্টে যেতে শুরু করে। রূপ আর রঙে বদলে গেছে বুড়িগঙ্গা। বদলে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি এবং পানির রঙে ফিরেছে স্বচ্ছতা। সারা বছরই বিরাজ করুক বুড়িগঙ্গার এমন রূপ। তিনি বলেন, এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জেনেছি বুড়িগঙ্গার তলদেশে ১২ ফুটেরও বেশি পলিথিন জমা হয়ে আছে। এসব পলিথিন অপসারণ করা গেলে শুষ্ক মৌসুমেও কিছুটা স্বচ্ছ পানি দেখা যেত।
নদী ভ্রমণে আসা সবুজ অরণ্য বলেন, পড়ন্ত বিকালের সূর্যালোকে মনে হচ্ছে বুড়িগঙ্গা যেন হাসছে। কিন্তু তার এ হাসি ক্ষণস্থায়ী। সারা বছর তার এ হাসি ধরে রাখতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষজনকে। বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী বসবাসকারীরা জানান, এবার বর্ষা আসার আগেই নদীর পানি বদলাতে শুরু করেছে। এটাকে তারা ভালো লক্ষণ হিসেবে মনে করছেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হতে না হতেই বুড়িগঙ্গার পানি কালো রঙ ধারণ করে। তখন গোসল করাতো দূরের কথা, পানি হাতে নেয়াই মুশকিল হয়ে যায়। পচা পানির গন্ধে দুই তীরের বাসিন্দাদের মাঝে দেখা দেয় পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া হক বলেন, বর্ষা মৌসুমেই স্বচ্ছ পানি। মৃদু ঢেউ। বুড়িগঙ্গায় এমন দৃশ্য দেখা মেলে। গ্রীষ্মকালে নাকে রুমাল চেপে পারাপার হতে হয়। ৩০ বছর ধরে তৈল ঘাটে নদী পারাপার করছেন আবদুর রাজ্জাক মাঝি। তিনি বলেন, আমরা এখন মনের সুখে নৌকা চালাই। শান্তিতে নদী পারাপার করি। বিকাল হলে বহু লোকজন ঘুরতে আসে। ঘণ্টা হিসেবে ভ্রমণ করে। অনেকে সখ করে নৌকা চালায়। আনন্দে তাদের সন্ধ্যা গড়ায়। তবে রাত হওয়ার আগেই সবাই ফিরে যায়। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের সভাপতি ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, বিআইডব্লিইটিএ’র গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ১০ ফুট পলিথিনের স্তূপ জমে গেছে। বর্তমানে এর চাইতে বেশি পলিথিনের স্তূপ জমে আছে। বুড়িগঙ্গায় এই স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ধরে রাখতে হলে তলদেশে জমে থাকা অবশিষ্ট পলিথিনও দ্রুত অপসারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে বুড়িগঙ্গায় যাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে না পারে সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাট টার্মিনাল এলাকার পানি সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার হয়। প্রায় দুই যুগ আগেও অনেকে বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একসময় এ নদীতে ইলিশ মাছও পাওয়া যেত। ঢাকার মানুষের মাছের চাহিদার বড় অংশ সরবরাহ করতো এ নদী থেকে। তবে বর্তমানে জাল ফেলতেই উঠে আসে শাকার ফিশ। বুড়িগঙ্গা জুড়ে এখন শুধুই শাকার ফিশের রাজত্ব। বুড়িগঙ্গার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার পানি আরও বেশি স্বচ্ছ। নদীর তীরে বেড়িবাঁধে বসে গল্পে মত্ত হাজারো মানুষ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খোলা মোড়া থেকে সোয়ারীঘাট (ঠোডা) পড়ন্ত বেড়িবাঁধে ভিড় জমে যায়। বছিলা ব্রিজ, পোস্তগোলা ও বাবুবাজার ব্রিজের ওপর থেকে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় জমান নগরবাসী।
বুড়িগঙ্গাসহ সকল নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলে নদীর হত্যাকারীদের বিচার চাই। একই কথা খাল বা ড্রেন বা অন্যান্য জলাশয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।