ঢাকা, ১৭ জুন ২০২৪, সোমবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলহজ্জ ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

এমপি আনার হত্যা

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মূর্তিমান আতঙ্ক শিমুল ভূঁইয়া

রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে
২৫ মে ২০২৪, শনিবারmzamin

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকারী দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম শিমুল ভূঁইয়া। বহুরূপী শিমুল ভূঁইয়ার সৈয়দ আমানুল্লাহ, আমানুল্লাহ সাঈদ, শিহাব, ফজল মোল্লা, ফজলসহ বিভিন্ন ছদ্মনাম রয়েছে। শুক্রবার দুপুরে ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘর তালাবদ্ধ। ছোট ভাই শিপলু ভূঁইয়ার বাড়িতেও কারও সাড়া পাওয়া যায়নি। পাশের আরেকটি বাড়িতে বাস করেন বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকি ভূঁইয়া। লাকি ভূঁইয়ার ছেলে তানভীর ভূঁইয়াও সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। লাকি ভূঁইয়ার বাড়িটিও তালাবদ্ধ। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম (আনার) হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থি শিমুল ভূঁইয়ার নাম এখন সকলের মুখে মুখে। এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে যশোর সদর, অভয়নগর ও ফুলতলা থানায় হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও বিস্ফোরকসহ মোট ৮টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্ক এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম, তার বড় ছেলে ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদল ও ছোট ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন
ডুমুরিয়ার রুদাঘরা ইউপি চেয়ারম্যান ইমরান হোসেন প্রার্থী ও একই ইউনিয়নের  চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হোসেনকে হত্যা করে লাইম লাইটে আসে শিমুল ভূঁইয়া। এছাড়া শীর্ষ চরমপন্থি ইমান আলী ও গণেশসহ অসংখ্য হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে ভূঁইয়া পরিবারের কথায় চলে ফুলতলা উপজেলা প্রশাসন। এলাকার রাজনীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ এখন ভূঁইয়া পরিবারের হাতে।

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম (আনার) হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন শিমুল ভূঁইয়া, তার স্ত্রী সাবিনা মুক্তা এবং ভাইপো তানভীর ভূঁইয়া। এরপরই এই পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। চাচা প্রয়াত হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ নেতা। খুলনার বিএল কলেজে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার কথা পরিবারের থেকে বলা হলেও ছোটবেলা থেকে তিনি সন্ত্রাসী এবং অনেক মামলার আসামি। 
তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, শিমুল ভূঁইয়া প্রথমে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর রাজনীতি করতেন এবং তিনি বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেন। তার ছোট ভগ্নিপতি ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির অন্যতম রূপকার ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এবং ভাগ হয়ে যাওয়া জনযুদ্ধের প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক নেতা মোফাখ্‌খারুল ইসলাম। তার হাত ধরেই তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল) বিভাগীয় সামরিক শাখার প্রধান হন। ১৯৯১ সালে যশোর জেলার অভয়নগর থানা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী গণেশকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে লাইম লাইটে আসেন শিমুল ভূঁইয়া। এ মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। ২০০২ সালে তিনি ইমান আলী নামে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেন। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে মোফাখ্‌খারুল ইসলামের নির্দেশে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল) ভেঙে দিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল জনযুদ্ধ) আত্মপ্রকাশ করে। তখন জনযুদ্ধের বিভাগীয় সামরিক শাখার দায়িত্ব পান শিমুল ভূঁইয়া। তার সেকেন্ড ইন কমান্ডকরা হয়  ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালী গ্রামের আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপনকে। সংগঠনটি ‘প্রচারই প্রসার’ স্লোগানকে সামনে রেখে হত্যা, চাঁদাবাজি করে দায় স্বীকার করার মধ্যদিয়ে আলোচনায় আসে।  একই বছর ২৫শে আগস্ট খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি  এডভোকেট মঞ্জুরুল ইমামকে নিজ বাড়ির অদূরে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে শিমুল ভূঁইয়া ও দাদা তপনের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

ভূঁইয়া পরিবারের আধিপত্য: মৃত নাসির ভুইয়ার ৬ ছেলে ও ২ মেয়ে। পুলিশে চাকরিজীবী একজন বাদে সব ছেলেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।  মেজ ছেলে বকুল ভূইয়া ফুলতলায় ইজিবাইক, সিএনজি ও অন্যান্য পরিবহন খাত থেকে নিয়মিত থেকে চাঁদা আদায় করেন। সেজো ছেলে মুকুল ভূঁইয়া ওরফে হাতকাটা মুকুল ২০০৪ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হন। এই শীর্ষ সন্ত্রাসী বেঁচে থাকাকালে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে দুই হাত হারায়। এরপর রয়েছেন বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া। তার পরেই আরেক সন্ত্রাসী টিপলু ভূঁইয়া। ছোট ছেলে শরিফ মোহাম্মদ শিপলু ভূঁইয়া দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যার সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ।

একই পরিবারের তিন চেয়ারম্যান খুনের নায়ক শিমুল ভূঁইয়া: খুলনার ফুলতলায় উপজেলার কর্তৃত্ব নিয়ে ভূঁইয়া পরিবারের সঙ্গে সরদার পরিবারের বিরোধ প্রায় তিন যুগ ধরে। এ উপজেলায় সরদার পরিবারের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আধিপত্যের কারণে ১৯৯৮ সালের ১৮ই আগস্ট হত্যা করা হয় উপজেলার দামোদর ইউপির চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা সরদার আবুল কাশেমকে। ওইদিন বেলা ১২টার দিকে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে বসে থাকা অবস্থায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজেই মাথায় গুলি করে হত্যা মিশন সফল করেন। এরপর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তারই বড় ছেলে সরদার আবু সাঈদ বাদল। ২০১০ সালের ১৬ আগষ্ট নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে সরদার আবু সাঈদ বাদলকে হত্যা করা হয়। কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেন শিমুল ভূইয়া ও তার ক্যাডার বাহিনী। এ দুটি হত্যা মামলার বাদী ছিলেন সরদার আবুল কাশেমের ছোট ছেলে সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। তিনি বিপুল ভোটে ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ ছাড়া জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় ২০১৭ সালের ২৬শে মে রাতে নিজ অফিসে বসে থাকা অবস্থায় সরদার আলাউদ্দিন মিঠুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ডিবি পুলিশের পোশাক পরে হত্যাকারীরা কিলিং মিশনে অংশ নেয়। এ হত্যা মামলায় পুলিশি তদন্তে নেপথ্যের গড ফাদার হিসেবে ফুলতলার বর্তমান নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেন এবং শিমুল ভূঁইয়ার ছোট ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান শরিফ মো. শিপলু ভূঁইয়ার নাম আসে। অভিযোগ রয়েছে ভূঁইয়া পরিবারের গড ফাদার হয়ে বর্তমানে কাজ করছেন ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন।

শিমুল ভূঁইয়ার ফুফাতো ভাই প্রবাসী আকতারুজ্জামান পলাতক: এদিকে ফুলতলার দামোদর গ্রামের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পুলিশের কাছে চিহ্নিত পলাতক আমেরিকা প্রবাসী মো. আকতারুজ্জামান ওরফে শাহিন সম্পর্কে শিমুল ভূঁইয়ার ফুফাতো ভাই। তবে, পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি এই আকতারুজ্জামান ভাড়া করেছিলেন। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই।

রাজনৈতিক শেল্টারে শিমুল ভূঁইয়া: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থিদের আধিপত্য এখন আর সেভাবে চোখে পড়ে না। জনযুদ্ধের প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক নেতা মোফাখ্‌খারুল ইসলাম, বিভাগীয় সামরিক শাখার প্রধান এবং পরবর্তী পার্টি প্রধান আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপন, আবির হাসান, অমিত হাসান, শোয়েব, সুমন, ইকবাল হোসেন সৈকত, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পাটির (এম এল) আব্দুর রশিদ, নিউ বিপ্লবি কমিউনিস্ট পার্টিও প্রধান মৃণালসহ অসংখ্য শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্রসফায়ার, একে অপরের গুলিতে নিহত হলেও শীর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া রয়ে গেছেন ধরাছোয়ার বাইরে। তার অনুগত সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। জাতীয় পার্টির শাসনামল থেকে বিভিন্ন সরকার পরির্বতন হলেও শিমুল ভূঁইয়াকে কেউ আঘাত করতে পারেনি। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই শীর্ষ সন্ত্রাসী বড় বড় অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যশোর সদর, অভয়নগর ও ফুলতলা থানায় এ পর্যন্ত ৮টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এরমধ্যে দুটি হত্যা এবং চাদাঁবাজি, অপহরণ ও বিস্ফোরক আইনে মামলা রয়েছে। এছাড়া আরো মামলা আছে কিনা তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

মৌলভীবাজারে জাতীয় পার্টির সম্মেলন সম্পন্ন / ‘আমরা আওয়ামী লীগে নেই, বিএনপিতেও নেই

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status