দেশ বিদেশ
স্ত্রীর নাম ব্যবহার করে এনএসআই কর্মকর্তার দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
১৪ বছরে ২৫ ব্যাংক একাউন্টে প্রায় ১২৬ কোটি টাকা লেনদেন, দুদকের দুই মামলা
স্টাফ রিপোর্টার
২২ মে ২০২৪, বুধবার
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) নিম্নমান সহকারী মো. আকরাম হোসেন। দুই দফা পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সহকারী পরিচালক। এতেই পোয়াবারো তার স্ত্রী সুরাইয়া পারভীনের। প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এই দম্পতির নামে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল কমিশনের উপ-পরিচালক মশিউর রহমান বাদী হয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা- ১ এ মামলা দুটি দায়ের করেন।
একটি মামলায় মো. আকরাম হোসেন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৫২০ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন এবং মিথ্যা ও ভিত্তিহীন ঘোষণা দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে যোগসাজশে ৬ কোটি ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬২ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। আরেকটি মামলায় মেসার্স স্টার ইলেক্ট্রো ওয়ার্ল্ডের মালিক সুরাইয়া পারভীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৫১ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের গোয়েন্দা বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মো. আকরাম হোসেন ১৯৮৯ সালে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) নিম্নমান সহকারী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে তিনি সুরাইয়া পারভীনেক বিয়ে করেন। ১৯৯৭ সালে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে জুনিয়র ফিল্ড অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক হন। এনএসআইয়ের এই কর্মকর্তা সর্ব প্রথম আয়কর নথি খোলেন ২০০৯-২০১০ কর বর্ষে। একই বছরে ব্যবসায়িক হিসেবে ও আয়কর নথি খোলেন আকরামের স্ত্রী সুরাইয়া পারভীন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত এক দশক আগেও কর দেয়ার মতো আয় ছিল না এনএসআই কর্মকর্তা আকরাম হোসেনের। তবে এই এক দশকে স্ত্রী সুরাইয়া পারভীনের নাম ব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন স্টার ইলেক্ট্রো ওয়ার্ল্ড ও লিরা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস নামে বিশাল কোম্পানি। এসব ব্যবসার নামে খোলা প্রায় ২৫টি ব্যাংক হিসাব স্ত্রীর হয়ে ব্যবহার করতেন এনএসআইয়ের এই কর্মকর্তা। গত ১৪ বছর এসব হিসাবে প্রায় ১২৬ কোটি টাকা জমা ও ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। দুদকের অনুসন্ধানে এনএসআইয়ের এই কর্মকর্তার নামে ২০০২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নাটোর সদর ও সদরের বাইরের নওয়াপাড়া মৌজায় ১৯৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ জমি কেনার তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকার দক্ষিণ খান মৌজায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ জমি, টেকনাফের সেন্টমার্টিনে ২০ শতাংশ জমি কেনার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার মিরপুর সেনপাড়া পর্বতায় নিজ ও স্ত্রীর নামে ১ হাজার ৪৮২ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মিরপুর সেনপাড়ায় ১০০ বর্গফুটের দোকান ও সাভারে সাড়ে ১৬ শতাংশ জমির উপর পৌনে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়তলা কমার্শিয়াল ভবন থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আকরাম হোসেন ২০০৯-১০ করবর্ষ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত বেতন বাবদ আয় করেন ৩৮ লাখ টাকা। এই সময়ে তার পারিবারিক ব্যয় দেখান ২৫ লাখ ১৫ হাজার ৪৯৬ টাকা। এর বিপরীতে তিনি সম্পদ বিবরণীতে শেয়ার বাজার থেকে ১৯ লাখ ৩২ হাজার ১০ টাকা আয় ও ভবন নির্মাণ ব্যয় দেখান ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬২ টাকা দেখান। তবে এই আয় ব্যয়ের অর্থের উৎসের কোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি। দুদকের কাছে দাখিল করা আকরামের সম্পদ বিবরণী থেকে জানা যায়, আকরাম হোসেনের স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ ও পারিবারিক ব্যয় বাবদ তার সর্বমোট সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি ৩৬ লাখ ৯৯ হাজার ৩৮৩ টাকা। এর বিপরীতে তার বৈধ আয় পাওয়া যায় ১ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ২১ টাকা। বৈধ আয় বাদে ৬ কোটি ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬২ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পায় সংস্থাটি।
একইভাবে দুদকের কাছে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে আকরাম হোসেন ২০১৪-১০১৫ করবর্ষে ৩৯ লাখ টাকা ও ২০১৭-২০১৮ করবর্ষে ২০ লাখ টাকাসহ মোট ৫৯ লাখ টাকা উপহার প্রাপ্ত হন মর্মে উল্লেখ করেন। যা তাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনের আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে। তবে এই উপহারের কোনো বৈধ উৎস তারা দেখাতে পারেননি। দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, আকরামের বিয়ের ২০ বছর পর ২০০৯ সালে হঠাৎই তার স্ত্রী মিসেস সুরাইয়া পারভীন রাতারাতি ব্যবসায়ী বনে যান। ২০০৯ সালে আকরামের মতো তার স্ত্রীও আয়কর নথি খোলেন। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে তার স্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) কোনো অনুমতিও নেয়নি বলে জানায় দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আয়কর নথি খোলার পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মিসেস সুরাইয়া পারভীনের ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ২৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৪ টাকা উত্তোলন করেন। দুদকে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বামী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত থাকা অবস্থায় অনুমোদন ছাড়া স্ত্রীর ব্যবসা পরিচালনা করা ও বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন ‘অস্বাভাবিক’ বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
এ ছাড়া সুরাইয়া পারভীনের নামে মিরপুর সেনপাড়া পর্বতায় ৯৮০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, একই এলাকায় ১ হাজার ৬৫০ বর্গফুটের আরও একটি ফ্ল্যাট, স্বামীর সঙ্গে সেনপাড়ায় ১ হাজার ৪৮২ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের যৌথ মালিকানা ও নাটোরে ১৫ শতাংশ কৃষি জমির সন্ধান পায় দুদক।