ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

দানিউবের পাড়ে স্লোভাকিয়ান চিত্রকলার জগৎ

বরেন চক্রবর্তী

(২ বছর আগে) ২৩ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ৭:২০ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:১৫ পূর্বাহ্ন

mzamin

দু’দিন আগে বাসে করে  চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ শহর থেকে যখন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে আমরা ৪ জন নামলাম তখন মনে হলো আমরা যেন নাইট কোচে চেপে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম। প্রাগ থেকে বাসে উঠেছিলাম রাত বারোটায় আর ভিয়েনাতে নেমে গেলাম ভোর পাঁচটার দিকে। একে আর ঢাকা চট্টগ্রামের নাইট কোচে চড়া ছাড়া আর কীইবা বলা যায়? দেশ দু’টি, কিন্তু দূরত্ব বড়ো সামান্য। ভিয়েনাতে নেমেই সেখান থেকে সরাসরি পার্ক ইন বাই রেডিসন হোটেল। আমাদের হোটেলটি ছিল ভিয়েনার ইউনাইটেড নেশনস অফিসের ঠিক উল্টো দিকে। পরের দিন অস্ট্রিয়ার দু’টি সেরা আর্ট মিউজিয়ামও দেখে ফেলেছি, এর একটি বেলভেডিয়ার মিউজিয়াম, দুনিয়াজোড়া যার খ্যাতি। ভিয়েনা ‘করংং’ (কিস্) এর শহর। এই শহরের সব জায়গায় চুমু আর চুমু। কিন্তু এই চুমু ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো চুমু না, এ দেখার কিস্  বা চুমু। গতকালই দেখে নিয়েছি এই নগরীর বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের জন্য একটি  বিশেষ আকর্ষণীয় পোস্টার সাঁটানো আছে এখানে সেখানে। ওই পোস্টারগুলোতে একই কথা লেখা সব জায়গায় এবং ওই বাক্যটি হলো  ঘবাবৎ ষবধাব ঠরবহহধ রিঃযড়ঁঃ ধ করংং. এই বাক্যটির মাহাত্ম্য প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি।  তবে এটা ঠিক যে ভিয়েনা শহরের সব জায়গায় ‘কিস্’-এর ছড়াছড়ি। মেয়েদের গলার লকেটে কিস্, কপালে কিস্্-এর টিপ, ছেলেদের হাতে কিস্-এর উল্কি আর অনেক ক্যাফে আর পাবের নামও কিস্ । ভিয়েনা যেন কিস্-এর নগরী। এ কীসের ‘করংং’ যাকে অনুভব না করে ভ্রান্তির ছলে এই শহর থেকে উড়াল না দেয়ার জন্য সব ভ্রামণিকদের কাছে রীতিমতো আবেদন নিবেদন করা হচ্ছে। কিন্তু আজ তো আমরা ওই ‘কিস্’ দেখেই ফেলেছি ভিয়েনার বেলভেডিয়ার মিউজিয়ামে। উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে বাস কিংবা ট্যাক্সিস্ট্যান্ড  পর্যন্ত সব জায়গায় যে ‘করংং’-এর কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটি আসলে একটি পেইন্টিং, যার শিরোনাম ‘ঞযব করংং’ এবং এই কিস্-এর স্রষ্টার নাম হলো অস্ট্রিয়ান গেট  এঁংঃধা কষরসঃ (গুস্তাভ ক্লিমত্, ১৮৬২-১৯১৮)। ক্লিমত্ এই ‘কিস্’ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন ১৯০৭ সালে, তারপর সব ইতিহাস। শুধুমাত্র একটি ছবি দেখার জন্য প্রতিবছর   লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক যে একটি শহরে আসতে পারে তার সহজ দৃষ্টান্ত গুস্তাভ ক্লিমতের ‘দ্য কিস্’। ভিয়েনা মানেই কিস্ আর কিস্ মানেই হলো ভিয়েনা। শুধুমাত্র একটি শিল্পকর্ম থাকার বদৌলতে যে একটি মিউজিয়াম আভিজাত্যের মাপকাঠিতে একেবারে শিখরে উঠে আসতে পারে তার উদাহরণ ক্লিমতের কিস্।

 প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের জগতজোড়া খ্যাতি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’র জন্য, মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া মিউজিয়ামের সৌজাত্য হলো পিকাসোর অমর সৃষ্টি ‘গোয়ের্নিকা’, উফিজি মিউজিয়ামের কৌলিন্য হলো স্যান্ড্রো বত্তিচেল্লির ‘বার্থ অব ভেনাস’, ঠিক তেমনি ভিয়েনার বেলভেডিয়ার গ্যালারির গর্ব হলো গুস্তাভ ক্লিমতের আঁকা কিংবদন্তি পেইন্টিং ‘দ্য কিস্’। একদিনে কী আর ভিয়েনা দেখা হয়? শুধু বেলভেডিয়ার না, এই শহরে অ্যালবারটিনা, লিওপোল্ডসহ আরও আছে একাধিক বিশ্ববিশ্রুত আর্ট মিউজিয়াম। কিন্তু ভিয়েনা আসার দ্বিতীয় দিন আমরা এই শহরে থাকতে চাইলাম না। আগে থেকেই ঠিক করে এসেছি যে আমরা ওইদিন যাবোস্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাটিস্লাভাতে। দেশ দু’টি, তবে দূরত্বের নিরিখে দু’টি দেশের অবস্থানের ব্যবধান খুবই কম। আগের দিন রাতেই কোন স্টেশন থেকে স্লোভাকিয়ার বাস ছাড়ে তা চিনে এসেছি। তাই রেডিসন হোটেল থেকে ভোরবেলায় ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা ৪ জন রওনা হই ভিয়েনার ইন্টারন্যাশনাল বাস টার্মিনাল আর্ডবার্গ স্টিগ বাস স্টেশনের দিকে। নামেই আন্তর্জাতিক টার্মিনাল কিন্তু দেখতে আমাদের গাবতলী কিংবা যাত্রাবাড়ীর বাস স্টেশনের মতোই। টিকিট কেনার ধরনও ঠিক আমাদের দেশের মতোই। খোপের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ইউরো দিলেই বাসের টিকিট পাওয়া যায় অনায়াসে। উঠে গেলাম চকচকে ফকফকে এয়ারকন বাসে। আমার বৌ চন্দনা বিদেশে গেলে আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি আর কাল কোথায় যাবো তা নিয়ে কোনো চিন্তা করে না। শুধু যাত্রাপথে সাগর কিংবা নদীর দেখা মিললে সে বারবার প্রশ্ন করবে এই নদীর নাম কী এবং আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে কোনো সমুদ্র পাড় আছে কিনা? বাসে উঠেই চন্দনা জানলো আমরা ব্রাটিস্লাভা নামের এক শহরে যাচ্ছি। তখন চন্দনা বললো ব্রাটিস্লাভা নামে ইউরোপে একটা শহর আছে তা ও বাসে উঠে ওই প্রথম জানলো। গাড়ি চললোস্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাটিস্লাভার দিকে। বাসে করেওই দেশটিতে পৌঁছতে সময় লাগলো মাত্র এক ঘণ্টার মতো। ইন্টারন্যাশনাল নিরিখে তো নয়ই, এমন কী আন্তঃশহর ভ্রমণের নিরিখেও সময়টা নিতান্তই কম। এ যেন অস্ট্রিয়া থেকেস্লোভাকিয়া নয়, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া।  নেমে গেলাম ব্রাটিস্লাভার নোভি মোস্ট বাসস্টেশনে। এখানে নামলেই চোখে পড়ে দানিউব নদীর উপর দিয়ে সরাসরি চলে যাওয়া বিশাল ব্রিজ। ভেবেছিলাম বাস টার্মিনালে ইমিগ্রেশন পুলিশ অন্তত আমাদের পাসপোর্টগুলো একবার চেক করে দেখতে চাইবে। কিন্তু ওখানে তো কোনো পুলিশই ছিল না, পাসপোর্ট দেখবে কে? যদিও আমাদের ৪ জনেরই সেনজেন ভিসা, কিন্তু তারপরও ইউরোপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে গেলে আমি সবসময়ই আমাদের পাসপোর্ট আর মেডিকেল ইন্স্যুরেন্সের কাগজগুলো সবসময় সঙ্গে নিয়ে যাই।

 কিন্তুস্লোভাকিয়ায় পাসপোর্ট চেক করার মতো কোনো ব্যাপারই ছিল না। আমরা কোত্থেকে এসেছি এবং কোথায় যাবো তা জিজ্ঞেস করার লোক খুঁজে পেলাম না। ইউরোপের সাতাশটি দেশ যেন তাদের দেশের বাউন্ডারি লাইন চিরতরে মুছে দিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সংস্কৃতে একটা কথা আছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ পৃথিবীর সব মানুষই তাদের আত্মীয়। তাই এক আত্মীয় আরেক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এলে অনুমোদনের দলিল-দস্তাবেজ দেখাতে হবে কেন? অস্ট্রিয়া ওস্লোভাকিয়ার নো-ম্যানস ল্যান্ড পার হওয়ার সময় যখন কেউ আমাদের পাসপোর্ট ভিসা দেখতে চাইলো না তখন আমার মনে পড়ছিল হতভাগ্য বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানি বেগমের কথা। দু হাজার এগারো সালের সাত জানুয়ারি বাবার হাত ধরে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর বর্ডারে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত রেখা পার হচ্ছিলো পনেরো বছর বয়সের ফেলানি। বাবা পেরিয়ে গেছে সীমান্তরেখা কিন্তু ফেলানি ছিল কিছুটা পেছনে। তার এক পা ভারতে আরেক পা বাংলাদেশে। কিন্তু অমিয় ঘোষ নামের এক অতিদেশপ্রেমী  ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি কনস্টেবল ফেলানির বুকে চালিয়ে দিল গুলি। শুধু তাতেও তাদের রাগ কমলো না, তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার জন্য উনিশ শ’ পাঁচচল্লিশ সালে ইতালির মিলান শহরের সদর রাস্তায় সে দেশটির স্বৈরশাসক বেনিটো মুসোলিনিকে হত্যা করে যেভাবে  ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ঠিক সেই একই আদলে কিশোরী ফেলানির মৃত দেহকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে বিঁধিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল পাঁচ ঘণ্টা। ফেলানির একমাত্র অপরাধ সে বিনা পাসপোর্ট ভিসায় তার গ্রাম লাগোয়া অন্য দেশের বাজারে বাবার সঙ্গে সওদা করতে গিয়েছিল। ভাবা যায় একজন মানুষের খুলির ভেতরে মগজ কতোটা ভারি হলে একজন পনেরো বছর বয়সের ছোট্ট মেয়েকে স্মাগলার ভেবে একজন পুলিশ তার বুকে গুলি চালিয়ে দিতে পারে অবলীলায়! কিন্তু আমরা ৪ জন মানুষ একদেশ থেকে একেবারে বাসে চড়ে এসে নামলাম আরেক দেশে কিন্তু প্রশ্ন করার লোক খুঁজে পেলাম না একজনও। ব্রাটিস্লাভা শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে এই বাসস্টেশন। স্টেশন থেকে বেরুতেই মূল শহর। এই শহরে ওটাই আমার প্রথম আসা। ইউরোপের খুব কম বড় শহরই আছে যেখানে আমি আর আমার মেয়ে অনি অন্তত একবার যাইনি। কিন্তুস্লোভাকিয়া ছিল আমাদের অদেখা। 

দেশটির নাম ‘ঝষড়াধশরধ’ (স্লোভাকিয়া), এই ছোট্ট দেশটির জনসংখ্যা সাকুল্যে চুয়ান্ন লাখ অর্থাৎ আমাদের ঢাকা শহরের জনসংখ্যার ৪ ভাগের একভাগ। স্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা খুব বেশিদিনের নয়। ৩ দশক আগেও এই দেশটি  কমিউনিস্ট শাসিত চেকোস্লোভাকিয়ার অধীনে ছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট শাসনের পতন হলে উনিশ শ’ তিরানব্বই সালের পহেলা জানুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে   চেকোস্লোভাকিয়া নামের দেশটি দু’ভাগে ভেঙে যায়, একটির নাম হয় চেক রিপাবলিক আরেকটিস্লোভাকিয়া। এইস্লোভাকিয়াকে বলা হয় ‘ল্যান্ড লকড্ কান্ট্রি’ কারণ পাঁচ ছ’টি দেশ একেবারে জড়াজড়ি করে এই দেশটিকে ঘিরে আছে। এই দেশটির চতুর্দিকে পোল্যান্ড, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া আর চেক রিপাবলিক।স্লোভাকিয়া নামটি বেেসছে  ঝষধাং (স্লাভ) শব্দটি থেকে। ইউরোপের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী স্লাভিক ভাষায় কথা বলে এবং ওই স্লাভ কথাটি থেকেই দেশটির নাম হয়ে গেছেস্লোভাকিয়া, যেমন বাংলা ভাষা থেকে বাংলাদেশ। এই দেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে ছোট কিন্তু এটি বিশ্বের একটি হাই ইনকাম কান্ট্রি।

বাসস্টেশন থেকে বের হয়েই আমি ইংরেজি ভাষা জানে এমন একজন মানুষ খুঁজতে থাকলাম এবং কিন্তু কাছাকাছি অবস্থানে তা পেলাম না। ভ্রামণিক হিসেবে কোনো দেশে এলেই আমার মূল টার্গেট থাকে ওই দেশটির ন্যাশনাল গ্যালারি। আমি ভাবলাম একটি ক্যাবে চড়ে মিউজিয়ামে চলে যাবো। কিন্তু সময় তখন সকাল মাত্র সাড়ে আট টা। পৃথিবীর বেশির ভাগ মিউজিয়ামই সকাল দশটা এগারোটার আগে খোলে না। কিন্তু তারপরও ওটাই আমাদের প্রধান যাওয়ার জায়গা। একটি ট্যাক্সি ক্যাব থামালাম। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কারণ ওই ড্রাইভার সুন্দর ইংরেজি বলে এবং বোঝে।  ট্যাক্সিতে ওঠা মাত্রই ড্রাইভার বললো- তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমি আমার গন্তব্য ন্যাশনাল গ্যালারির কথা বললাম। লোকটি গাড়ি স্টার্ট দিতে যেয়েও স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির দরজা খুলে মুখে একটা চওড়া হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে আমাদের নামতে বললো। আমরা অবাক। কেন সে আমাদের নিয়ে গন্তব্যে যাবে না বিষয়টা আমার কাছে সহসা বোধগম্য হলো না। ড্রাইভার আমার কাছে জানতে চাইলো আমরা এই শহরের কোথায় কোথায় যেতে চাই। আমিস্লোভাক ন্যাশনাল গ্যালারি, ব্রাটিস্লাভা ক্যাসেল, স্লোভাক ন্যাশনাল থিয়েটার আর প্যালেসের কথা তাকে বললাম। সে হেসে বললো আমরা যেখানে যেখানে যেতে চাই ওই জায়গাগুলো এই বাসস্ট্যান্ড থেকে একদম কাছে, গাড়িতে চড়ে ওইসব জায়গায় যাওয়ার কোনো দরকারই নেই। একেবারে পায়ে হেঁটে আয়েশ করে ওই সব জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। ওই জায়গায় দাঁড়িয়েই সে আমাদের পেছনের দিকে চাইতে বললো আর তর্জনী উঁচিয়ে বললো- ওইতো ব্রাটিস্লাভা ক্যাসেল। পেছনে তাকিয়ে দেখি সত্যি তাইতো। আমাদের থেকে শ পাঁচেক গজ দূরে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে ওই দুর্গ। ড্রাইভারটি আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে পঁচিশ ত্রিশ গজ সামনে এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপারের দিকে হাত উঁচিয়ে বললো- ওইতো দানিউব নদী  আর ওই নদীর উপর দিয়ে চলে গেছে ওই যে দু’তলা বিশিষ্ট সুরম্য বিশাল এসএনপি ব্রিজ । আমরা যে  রাস্তায় তখন দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে বাঁ পাশ ধরে মিনিট দশেক হেঁটে গেলেই দেখা পাওয়া যাবেস্লোভাক ন্যাশনাল গ্যালারির। আমরা যেসব জায়গায় যেতে চাই সেই সব স্থাপনাগুলো নাকি ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে খুব একটা দূরে না। ড্রাইভারটি তার অবস্থানে স্থির থেকে শুধু তার ডান হাতের তর্জনীটি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে আমাদের সবকিছু দেখিয়ে দিলো। লোকটার বদান্যতা আর দরাজ মনে আমি মুগ্ধ। ড্রাইভারটা ফাঁকি দিয়ে টাকা রোজগারের  জন্য আমাদের সঙ্গে কোনো রকম দু নম্বরি করলো না। কিন্তু এর ঠিক উল্টোটিরও অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। কয়েক বছর আগে আমি আর আমার মেয়ে অনি প্যারিসের একটি জায়গায় মুজে মার্মাটন মিউজিয়ামটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যদিও ওই মিউজিয়ামটিতে আমরা আগেও একবার এসেছিলাম। খুঁজে যখন পািচ্ছলামই না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাবে করে মিউজিয়ামে যাবো, নিশ্চয়ই ক্যাব ড্রাইভার মিউজিয়ামটি চিনবে। উঠলাম একটা ট্যাক্সি ক্যাবে, ওমা একি! ড্রাইভারটি মাত্র এক দু’মিনিট গাড়ি চালিয়ে গাড়ি থামিয়ে বলে দিল- ওই তো মুজে মার্মাটন। সামনে তাকিয়ে দেখি সত্যি তাই।  সে টাকাটা কিন্তু ঠিকই নিয়ে নিলো। তখন অনি বললো-বাবা দেখেছ, ড্রাইভারটা কি নচ্ছার, আমরা তো এই মিউজিয়ামের উল্টো পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, লোকটা বললেই তো পারতো  যে এটাই মিউজিয়াম, কিন্তু গেট সামনের দিকে। সে তা না বলে গাড়িতে বসিয়ে আমাদের এক চক্কর খাইয়ে টাকা খসিয়ে দিলো অনেকগুলো। ব্রাটিস্লাভায় পাওয়া ড্রাইভারটির ব্যবহার প্যারিসে দেখা ড্রাইভারটির ঠিক উল্টো এবং তাতো হতেই পারে, সব মানুষের মন মানসিকতা তো আর এক রকম হয় না।  ওই ড্রাইভারের কথা মতো কিছুক্ষণ হাঁটার পরই দেখি চৌরাস্তার মোড়ে একেবারে জমিদার বাড়ির মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেস্লোভাকিয়ার ন্যাশনাল গ্যালারি। তখনো মিউজিয়াম খোলেনি। মূল দরজার সামনে যেয়েই বুঝলাম এখন এখানে যে প্রদর্শনীটি চলছে তার শিরোনাম ‘গড়ঃযবৎ রিঃয ঈযরষফ’ অর্থাৎ এই মিউজিয়ামে এখন ‘মা ও শিশু’ শিরোনামের চিত্রপ্রদর্শনী চলছে।

 মিউজিয়ামের দরজা খুলবে দুপুর এগারোটার দিকে, অর্থাৎ এখনো ঢের সময় বাকি। আমরা হাঁটতে থাকি মূল রাস্তা বরাবর। এই শহরে এসে মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানেই বুঝে নিলাম এখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত পোস্টার আর ভাস্কর্যের যেন মেলা বসেছে। রাস্তার ধারে এমন কিছু ভাস্কর্যের দেখা মিললো যেগুলো রীতিমতো কিম্ভূতকিমাকার। এক সময় আমরা এসে পৌঁছালামস্লোভাক ন্যাশনাল থিয়েটার চত্বরে। একটু দূরে হেঁটে যেতেই দেখি ঠিক রাস্তার পাশে অনেকগুলো পর্যটক একটা কিছুকে ঘিরে হাসি তামাশা করছে। আমরাও শামিল হই তাদের  সঙ্গে। সামনে যেয়ে দেখি অবাক কা-। এমন ভাস্কর্য জীবনে কখনো দেখিনি। একটা ম্যানহোল থেকে বের হয়ে আছে একজন মানুষের মুখ। তার মুখ প্রশান্তিতে ভরা এবং সে খুব আয়েশ করে চারপাশের শহরকে দেখছে। যে ভাস্কর্যটির সামনে আমরা তখন দাঁড়িয়ে আছি তার শিরোনাম ‘ঈঁসরষ’ (কুমিল) এবং বিভিন্ন সমীক্ষায় নাকি দেখা গেছে যে এই দেশটিতে পর্যটকরা এসে যেসব ছবি তোলে সংখ্যা বিবেচনায় তার শীর্ষে আছে ‘কুমিল’। এটি একটি প্রায় খামখেয়ালিপূর্ণ শিল্পকর্ম। এই ভাস্কর্যে দেখা যায় একজন পয়ঃনিষ্কাশন শ্রমিক ম্যানহোল থেকে সম্পূর্ণ বের না হয়ে, অর্ধেক শরীর ম্যানহোলের ভেতরে রেখেই ইট সুরকির রাস্তার মাঝে  দু’হাতের উপর থুতনি রেখে চেয়ে আছে শহরের দিকে। অদ্ভুত আইডিয়া ছিল শিল্পীর। নর্দমার কর্মী হয়ে গেছে শিল্পের উপাত্ত, ভাস্কর্যের বিষয়টি নিঃসন্দেহে অভিনব। ঠিক সে সময় চন্দনা বললো সে নাকি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। তাই সে এখন দানিউবের পাড়ে যেতে চায়। দানিউব নদীর পাড় তখন আমাদের অবস্থান থেকে মাত্র তিন চার’শ গজ দূরে।  বেলা তখন দশটা বাজে। আমি জানি চন্দনা একবার নদী কিংবা সমুদ্র পাড়ে গেলে সেখান থেকে আর আসতে চায় না। আর এক ঘণ্টা পরেই ন্যাশনাল গ্যালারির দরজা খুলবে। কিন্তু নদীটা যেহেতু দানিউব, তার পাড়ে তো যাওয়াই উচিত। ইউরোপের যেসব নদীগুলো ঐতিহাসিক ভাবে বহুল বিশ্রুত তার মধ্যে দানিউব কিন্তু অন্যতম এবং সেরা। পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কবি সাহিত্যিক গল্প উপন্যাস লিখেছেন এই নদীকে ঘিরে।

দুপুর সাড়ে এগারোটার দিকে আবার ফিরে এলাম ন্যাশনাল গ্যালারিতে। ততক্ষণে প্রদর্শনীর দরজা খুলে গেছে।স্লোভাক ন্যাশনাল গ্যালারি আসলে একটি প্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদে মিউজিয়ামের পথচলা শুরু হয় ১৯৪৯ সালে। এই গ্যালারিতে ঢুকেই বুঝতে পারলাম এই মিউজিয়ামের স্থায়ী কালেকশন খুব বেশি নয় তবে এখানে প্রদর্শনী হয় নিয়মিত। পৃথিবীর প্রায় সব মিউজিয়ামেরই একটি আইকন পেইন্টিং থাকে।স্লোভাক জাতীয় গ্যালারির আইকন পেইন্টিংটির শিরোনাম হলো  ‘ঞযব গড়ঁৎহরহম ঢ়ড়ৎঃৎধরঃ ড়ভ ক. ঐড়ৎাধঃয-ঝঃধহংরঃয’ তবে এই ছবির শিল্পীর নাম অজ্ঞাত।

এই মিউজিয়ামের চারপাশে বিখ্যাতস্লোভাক শিল্পীদের নানা ধরনের পেইন্টিং শোভা পাচ্ছে। কিন্তুস্লোভাক শিল্পকলার ইতিহাস ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো অত প্রভাবী নয়। আর তা ছাড়া ‘স্লোভাক আর্ট’ এর ইতিহাস অত দীর্ঘও নয়। যে দেশটি মাত্র ৩ দশক আগে স্বাধীন হয়েছে তাদের শিল্পকলার ইতিহাস অত ঐতিহ্যশালী হওয়ার কথাও নয়। কমিউনিস্ট শাসন আমলেস্লোভাক শিল্পীদের হাত-পা ছিল প্রায় বাঁধা এবং একটি বিশেষ গ-ির ভেতর ছিল তাদের তুলির যাতায়াত।  কমিউনিস্ট শাসনকালে শিল্পকলা একটি বিশেষ রাজনৈতিক কারণে ব্যবহৃত হতো এবং শিল্পীরা তাদের ইচ্ছেমতো কিছুই সৃষ্টি করতে পারতেন না। এটাই মূলতস্লোভাক পেইন্টিংয়ের একটি বড় সীমাবদ্ধতা। সেখানে নিজের ইচ্ছেমতো কোনো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা শিল্পীদের ছিল না। ‘স্লোভাক চিত্রকলা’ মূলত স্লাভ ফোকলোর আর ইউরোপীয় ঘরানার মিশেলে সম্ভূত। স্লাভ সম্প্রদায়ের পরম্পরাগত বিশ্বাস আর লোকাচারের বিষয়-আশয় স্থান পেয়েছে তাদের চিত্রকলায়।  চেকোস্লোভাকিয়ার শিল্পকলার সুস্পষ্ট প্রভাব আছে স্লোভাক আর্টে।  বিখ্যাত যেসবস্লোভাক শিল্পীদের পেইন্টিং এই ন্যাশনাল গ্যালারির ডিসপ্লেতে ছিল তাদের মধ্যে ছিল ঔধহ কঁঢ়বপশহ্ন (জ্যান কুপেকি, ১৬৬৭-১৭৪০), ঞরাধফধৎ ঈংড়হঃাপ্সৎু কড়ংুঃশধ (তিভাদর সন্টভেরি কোস্টকা, ১৮৫৩-১৯১৯), চপ্সষ ঝুরহুবর গবৎংব (পল ঝিনেই মার্স, ১৮৪৫-১৯২০), অষনল্পহ ইৎঁহড়াংশহ্ন (অ্যালবিন ব্রুনভস্কি, ১৯৩৫-১৯৯৭), ঠরশঃড়ৎ গধফধৎপ্সংু (ভিক্টর মাডারাস, ১৮৩০-১৯১৭) প্রমুখ। যেসব স্লাভ শিল্পীরা অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর বলয় থেকে বের হয়ে এসে নিজস্ব দেশীয় রীতিতে ছবি এঁকেছেন তাদের মধ্যে অ্যালবিন ব্রুনভস্কির নাম উল্লেখযোগ্য।  স্লোভাকিয়ায় কিউবিস্ট ঘরানার প্রবত্তা হলেন ঊংঃবৎ ঝরসবৎড়াধ-গধৎঃরহপবশড়াধ (ইস্টার সেমিরোভা মার্টিনিজকোভা, ১৯০৯-২০০৫) আর সুররিয়ালিজম অর্থাৎ পরাবাস্তববাদ রীতির প্রবর্তক হলেন  ওসৎড় ডবরহবৎ-কৎধষ (ইমরো ওয়েনার কার্ল, ১৯০১-১৯৭৮)। উনবিংশ শতাব্দীর আরও দুইজন কীর্তিমান পেইন্টার হলেন উড়সরহরশ ঝশঁঃবপশহ্ন (ডোমেনিক স্কুুটেকি, ১৮৪৯-১৯২১) এবং খধফরংষধা গবফňধহংশহ্ন (লেডিস্লাভ মেডনেনস্কি, ১৮৫২-১৯১৯)।

ইউরোপিয়ান আর্টের প্রতি আমার দুর্বলতা ইদানিং অনেকাংশে গেছে। একাধিকবার উফিজি, ল্যুভর, লন্ডন ন্যাশনাল গ্যালারি, রেইনা সোফিয়া, রিক কিংবা টেট মডার্ন দেখতে দেখতে প্রায় সিংহভাগ ইউরোপিয়ান গ্রেটদের চিত্রকলা আমার চেনা হয়ে গেছে। পাশের রুমেই চলছিল ‘মাদার উইথ চাইল্ড’ চিত্রপ্রদর্শনী। ‘মা ও শিশুর’ এত ছবির একত্র সম্মিলন আমি আগে আর কখনো দেখিনি। যাদের ছবি এখানে স্থান পেয়েছে তাদের বেশির ভাগইস্লোভাক শিল্পী। ‘মা ও শিশু’র এই বিশাল প্রদর্শনীতে যাদের ছবি আমার দু-চোখের সামনে এলো তাদের মধ্যে ছিলেন গধৎঃরহ ইবহশধ (মার্টিন বেনকা, ১৮৮৮-১৯৭১), Ľঁফড়াল্পঃ ঋঁষষধ (লুডোভিট ফুল্লা, ১৯০২-১৯৮০), গরষড়š অষবীধহফবৎ ইধুড়াংশহ্ন (মিলোস আলেকজান্ডার বেজোভস্কি, ১৮৯৯-১৯৬৮), ঔধহশড় অষবীু (জ্যানকো অ্যালেক্সি, ১৮৯৪-১৯৭০), গরশঁষপ্সš এধষধহফধ (মিকুলাস গ্যালেন্ডা, ১৮৯৫-১৯৩৮), উবুরফবৎ গরষষু   (ডেজিডার মিলি, ১৯০৬-১৯৭১) প্রমুখ। কিন্তু এই প্রদর্শনী দেখতে এসে ‘মা ও শিশু’ বিষয় নিয়ে আঁকা মিকুলাস গ্যালেন্ডার সিরিজ পেইন্টিং দেখে আমি রীতিমতো অভিভূত।

বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা মাদার অ্যান্ড চাইল্ড  শিরোনামের অনেক ছবি আমি ইতিমধ্যে দেখেছি এবং এদের মধ্যে আছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি তিন শিল্পী- মকবুল ফিদা হুসেন (১৯১৫-২০১১), এম.ভি ধুরন্ধর (১৮৬৭-১৯৪৪) আর যামিনী রায় (১৮৮৭-১৯৭২)। ‘মা এবং শিশু’ শিরোনামে মকবুল ফিদা হুসেনের সিরিজ পেইন্টিং আছে এবং এর প্রায় অর্ধ ডজন চিত্রকর্ম আমি দেখেছি দিল্লির  ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট (এনজিএমএ) মিউজিয়ামে। দিল্লির এই গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথ, হুসেন আর অমৃতা শেরগিলের পেইন্টিংগুলো পাশাপাশি অবস্থানে সবসময় ডিসপ্লেতে থাকে। হুসেন তার আঁকা প্রায় প্রতিটি ছবিতে মাদার তেরেসাকে ইউনিভার্সাল মাদারহুড অর্থাৎ বিশ্বমাতা হিসেবে কল্পনা করেছেন। প্রতিটি ছবিতে দেখা যায় মাদার তেরেসা একজন শিশুকে বুকে জড়িয়ে আছেন কিংবা তাকে আদর করছেন।  সারা জীবন মকবুল ফিদা হুসেন একজন আদর্শ মাতার মুখ খুঁজে বেড়িয়েছেন।  কিন্তু তারপরও কোনো ছবিতে তিনি মাদার তেরেসার মুখটি স্পষ্ট করে আঁকেননি। তবে ছবির আঙ্গিকই বলে দেয় এই ছবির ‘মা’ চরিত্রটি  অন্য কেউ নন, তিনি মাদার তেরেসা। প্রতিটি ছবিতে মা নীল পাড়ের শাড়ি পরে আছেন, যেমনটা পরতেন মাদার তেরেসা। নীল পাড়ের শাড়ি ছিল এই মহান নারীর আদর্শ আচ্ছাদন। হুসেন কখনো মাদার  তেরেসার স্পষ্ট মুখের আদল সৃষ্টি করতে চাননি কিন্তু দর্শক ওই ছবির দিকে চেয়েই বুঝতে পারে ওই ক্যানভাসে যে নারীর মুখ স্থিত হয়ে আছে তিনি মাদার তেরেসা ছাড়া আর কেউ নন। হুসেনের আঁকা মা ও সন্তান সিরিজটি মাদার তেরেসা সিরিজ শিরোনামেও পরিচিত।

আজ আমি স্লোভাকিয়ার ন্যাশনাল গ্যালারিতে যে প্রদর্শনীতে এসেছি সেখানে মিকুলাস গ্যালেন্ডার আঁকা অন্তত দশ-বারোটি মা এবং শিশুর পেইন্টিং আছে। ফাইন আর্টসের প্রফেসর গ্যালেন্ডা ছিলেনস্লোভাক চিত্রকলায় আধুনিকতার স্থপতিদের অন্যতম।স্লোভাকিয়ার সাধারণ মানুষদের যাপিত জীবন আর নিজ দেশের ল্যান্ডস্কেপ এঁকে তিনি কিংবদন্তি। বেঁচেছিলেন মাত্র তেতাল্লিশ বছর কিন্তু তার দেশের শিল্পকলাকে তিনি তার হ্রস্ব জীবনে দিয়ে গেছেন অনেক বেশি। মকবুল ফিদা হুসেনের মতো মিকুলাস গ্যালেন্ডাও তার আঁকা মা ও শিশুর কোনো মুখাবয়বকেই সরাসরি করে আঁকেননি। ছবি দেখে বোঝা যায় যে ছবিটি মা ও সন্তানের কিন্তু সব মুখই প্রচ্ছন্ন। ঠিক একইভাবে মা এবং সন্তানের ভালোবাসাকে অচ্ছেদ্য করে ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পী এরড়াধহহর এরধপড়সবঃঃর (জিয়ভান্নি গিয়াকোমেটি, ১৮৬৮-১৯৩৩), জার্মান এক্সপ্রেশনিজম ধারার শিল্পী  ঊসরষ ঘড়ষফব (এমিল নোল্দে, ১৮৬৭-১৯৫৬)।

চিত্রকলার ইতিহাসে ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ যেকোনো বিখ্যাত শিল্পীরই জন্যই একটি প্রিয় থিম এবং এই থিমটি একেক জনের ক্যানভাসে একেক আঙ্গিকে প্রতিভাত। ওই একই থিমকে বেছে নিয়েছিলেনস্লোভাক শিল্পী মিকুলাস গ্যালেন্ডাও। রেনেসাঁ যুগে ১৫০৩ সালে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা শিল্পীদের একজন ইতালীয় গ্রেট  জধঢ়যধবষ (রাফায়েল, ১৪৮৩-১৫২০) এর  ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’ চিত্রায়নের পর থেকে অনেক বিখ্যাত শিল্পী এই থিম নিয়ে ছবি এঁকেছেন। চিত্রকলায় মাতা মেরি আর যিশু হলেন আদর্শ মা এবং সন্তান।   ভারতবর্ষের চিত্রকলায় ‘যশোদা আর শ্রীকৃষ্ণ’র ছবিও নানাভাবে উপস্থাপিত। রবীন্দ্রনাথও এই চরিত্র দুটিকে উপজীব্য করে  এঁকেছেন একাধিক ছবি। একজন মা হলেন তার সন্তানের জীবনের ‘ঝঁঢ়বৎ যবৎড়’ (সুপার হিরো) এবং এই সুপার হিরোকে শিল্পকলায় একেক জন শিল্পী স্বকীয় মহিমায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। এই একই কনসেপ্ট নিয়ে পাবলো পিকাসো একাধিক ছবি এঁকেছেন। তার আঁকা ওই ছবিগুলো ছিল স্নেহ-ভালোবাসা-আবেগ-হর্ষ-বিষাদ নানা বিষয়ক।

মিকুলাস গ্যালেন্ডার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই মা যেন প্রায় একই ভঙ্গিতে তার সন্তানকে জড়িয়ে আছে। প্রতিটি  ছবিতেই মা এবং শিশু মিলে একটি দ্রঢ়িষ্ঠ ফর্ম তৈরি করেছে। গ্যালেন্ডার আঁকা বেশির ভাগ ছবিতেই মা’র শরীর থেকে সন্তানকে আলাদা করা কঠিন। পেইন্টিংগুলোতে  মায়ের কোলে সন্তানের উপস্থিতি সুসংহত এবং তা যেন দু-েদ্য। বেশির ভাগ ছবিতেই মা এবং সন্তানের মুখ প্রচ্ছন্ন। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইংরেজ লেখক জঁফুধৎফ করঢ়ষরহম (রুডিয়ার্ড কিপলিং, ১৮৬৫-১৯৩৬) লিখেছেন ‘এড়ফ পড়ঁষফ হড়ঃ নব বাবৎুযিবৎব, ধহফ ঃযবৎবভড়ৎব যব সধফব সড়ঃযবৎং’ অর্থাৎ ঈশ্বর সব সময় সব জায়গায় থাকতে পারবেন না বলেই তিনি পৃথিবীতে মাতৃরূপের সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ সন্তানের কাছে মা হলো বিকল্প ঈশ্বর। ওই একই ধারণার প্রতিফলন আছে মিকুলাস গ্যালেন্ডার মা ও শিশু সিরিজের ছবিগুলোতে। গ্যালেন্ডার পেইন্টিংয়ে সন্তান আর মা’র দেহ দুটি এমনভাবে সন্নিহিত যেন একজন আরেকজনের রক্ত মাংসের অংশ। মা আর সন্তান যেন একে অপরের পরিপূরক, দু’জনই অচ্ছেদ্য সম্পর্কের স্মারক। একেই বলে ‘ডধৎসঃয ড়ভ ঃযব ডড়সন’ আর ‘ঊসনৎুড়হরপ ঞড়মবঃযবৎহবংং’ অর্থাৎ এই ছবি গর্ভাশয়ের উষ্ণতা আর জন্মগত নৈকট্যের অভিজ্ঞান। মিকুলাস গ্যালেন্ডার আঁকা এই সিরিজ ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ালেই দর্শকদের হয়তো মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জন্মকথা’ কবিতটি-

‘খোকা মাকে শুধায় ডেকে-

এলেম আমি কোথা থেকে

কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।

মা শুনে কয় হেঁসে কেঁদে

খোকারে তার বুকে বেঁধে-

ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে...’ 

এই ছবিগুলোতে একজন মা যেন সত্যি সত্যিই তার সন্তানকে তার বুকের মাঝে আর তার তাবৎ সত্তার সঙ্গে অবিভাজ্য অচ্ছিন্নভাবে বেঁধে ফেলেছে। মিকুলাস গ্যালেন্ডার আঁকা এই  ‘মাদার উইথ চাইল্ড’ ছবিগুলো যেন সন্তান ও মায়ের সনাতন আদ্যকালীন রূপের সার্থক অতিষ্ঠা। প্রতিটি ছবিরই মানসতা, অন্তর্দৃষ্টি আর অন্তর্দর্শন প্রায় একই। ভাবগত কোনো পার্থক্য নেই।

সরাসরি  ‘গধফড়হহধ’ (ম্যাডোনা) শিরোনামেও  মিকুলাস গ্যালেন্ডার আঁকা দুটি পেইন্টিং ওই প্রদর্শনীতে ছিল। এর একটির শিরোনাম ‘ঞযব জড়ংব গধফড়হহধ’ (দ্য রোজ ম্যাডোনা, ১৯৩৩) এবং অন্যটির শিরোনাম ‘চরহশ গধফড়হহধ’ (পিঙ্ক ম্যাডোনা, ১৯৩৩)।  দুটি ছবি একই আঙ্গিকে আঁকা পার্থক্য শুধু রঙের বিন্যাসে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে কুমারী মাতা মেরি আর ম্যাডোনা একই নারী। ম্যাডোনার কোলে যে শিশুটি থাকে তিনিই স্বয়ং যিশু। ম্যডোনা হলেন পৃথিবীর সেরা মাতৃরূপী দেবী এবং তাকেই শিল্পীরা নানারূপে তুলে এনেছেন ক্যানভাসে। তবে বোদ্ধাদের ধারণা,  পৃথিবীর সেরা ম্যাডোনা এঁকে গেছেন রাফায়েল যে পেইন্টিংয়ের শিরোনাম ‘ঞযব ঝরংঃরহব গধফড়হহধ’  (দ্য সিসতিন ম্যডোনা, ১৫১৩)। তবে রাফায়েলের ম্যাডোনা আর মিকুলাস গ্যালেন্ডার আঁকা ম্যাডোনার অঙ্কনশৈলীতে বৈলক্ষণ্য আছে। রাফায়েলসহ অন্যান্য রেনেসাঁ শিল্পীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ডিটেইলে দেখা কিন্তু আধুনিক শিল্পীদের অনন্যতা হলো সবকিছু প্রচ্ছন্ন করে দেখা। ঠিক সে রকমই পার্থক্য ধরা পড়ে রাফায়েল আর গ্যালেন্ডার ম্যাডোনাতে। ওই প্রদর্শনীতে মিকুলাস গ্যালেন্ডার আঁকা ‘মাদার উইথ চাইল্ড’ সিরিজের যে ক’টি ছবি ছিল সেগুলোতে কিউবিস্ট আর এক্সপ্রেশনিস্ট ভাবধারার প্রতিফলন ছিল। এর পেছনে যুক্তিও আছে কারণমিকুলাস গ্যালেন্ডা নিজেই ছিলেন কিউবিজম আর এক্সপ্রেশনিজম ঘরানার শিল্পী। এই প্রদর্শনীতে ‘দ্য রোজ ম্যাডোনা’ আর ‘পিঙ্ক ম্যাডোনা’ শিরোনামে যে দুটি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে ওই ছবি দুটিতে স্থাপত্য রীতির ছায়া পড়ে, যেমনটা পড়ে গরপযবষধহমবষড় (মাইকেলাঞ্জেলো, ১৪৭৫-১৫৬৪)’র আঁকা পেইন্টিংয়ে। মাইকেলাঞ্জেলো ছবি আঁকতেন ক্যানভাসে কিন্তু সে ছবির ঢঙ অনেকটা হয়ে যেতো স্থাপত্যরীতির। এই প্রদর্শনীর অন্তত একটি ছবির ‘মা ও শিশু’ কে দেখে যামিনী রায়ের কথা হয়তো অনেক দর্শকদের মনে পড়বে।

কোনো গ্যালারিতে ঢুকলে আমার সময়জ্ঞান থাকে না। পেছনে চেয়ে দেখি চন্দনা আর অনি আমাকে ছেড়ে দানিউবের পাড়ে চলে গেছে। আমার সঙ্গে ঘুরঘুর করছে সুদি। বিকাল তখন ৪টা বেজে গেছে। এরপর যেতে হবে ব্রাটিস্লোভা ক্যাসেলে, অবশ্য ওই দুর্গ এই মিউজিয়াম থেকে খুব একটা দূরে না। রাতেই ফিরবো ভিয়েনা।

স্লোভাকিয়ার ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে ব্রাটিস্লাভা ক্যাসেলে হেঁটে যেতে সময় লাগলো প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট। এই শহরে আজ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আমরা একবারের জন্যেও ট্যাক্সিতে উঠিনি। আর উঠবোই বা কেন, সব ট্যুরিস্ট স্পটগুলো তো একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বিন্যস্ত হয়ে আছে দানিউবের পাড়ে। কোনো দুর্গ দেখার শখ আমার কোনোদিনই ছিল না। কারণ হাজার হাজার বছর আগে এই সব দুর্গগুলো ব্যবহার হতো হয় লুকিয়ে কামান দিয়ে গুলি করে মানুষ মারার জন্য, না হয়তো রাজ রাজাদের মণি-মাণিক্য আর হিরে-জহরত ডিসপ্লে করে রাখার জন্য। এ দুটোতেই আমার ঘোর আপত্তি। কিন্তু একজন ট্যুরিস্ট হিসেবে ওই দুর্গ না দেখে গেলে তোস্লোভাকিয়া দেখা অপূর্ণ থেকে যাবে নিশ্চয়ই কারণ এই দুর্গ হলো ব্রাটিস্লাভা শহরের প্রধান আইকন। ৪টি বিশাল টাওয়ার সমেত এই সুপরিসর আয়তক্ষেত্র সদৃশ দুর্গ দাঁড়িয়ে আছে দানিউব নদী থেকে তিন’শ ফুট উপরে। ক্যাসেলের পাদদেশে যেয়েই চন্দনা আর অনি রণে ভঙ্গ দিলো। পাহাড় ডিঙানোর ভয়ে ওরা বসে থাকলো নিচে। আমি আর সুদি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই ক্যাসেলের দিকে। দেড় হাজার বছর আগে নির্মিত এই ক্যাসেলের প্রথম ফ্লোরে দেশটির পার্লামেন্ট ভবন, সেকেন্ড ফ্লোরেস্লোভাকিয়া ন্যাশনাল মিউজিয়াম আর থার্ড ফ্লোরে দেশটির হিস্ট্রি মিউজিয়াম।  আমি আর সুদি সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে যাই একেবারে ক্যাসেলের ছাদে। ওখানে যেয়ে দেখি ডজন ডজন মানুষ বাইনোকুলার হাতে নিয়ে ছাদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে দূরে কী যেন খুঁজছে। সময়টা ছিল প্রাক-সন্ধ্যা, তাই দূরবীক্ষণ যন্ত্র যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, তা যে দূরবর্তী বস্তুকে নিকটবর্তী দেখাবে না, তা আমি নিশ্চিত। কিন্তু মানুষের অনুসন্ধিৎসার তো কোনো শেষ নাই। ওই লোকগুলো এই ক্যাসেলের ছাদের উপর দূরবিন দিয়ে চারপাশে কী খুঁজছে তা জেনে নিলাম। কোনো একজন গাইড আমাকে বললো দিনের বেলা এই ছাদে দাঁড়িয়ে খালি চোখেই  একসঙ্গে নাকি তিনটি দেশকে দেখা যায়। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা যায়স্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরিকে। চারপাশে তখন ক্রমেই নেমে আসছে আলো-আঁধারির খেলা। ওই ছায়া ছায়া প্রায়ান্ধকারের মাঝেই সুদি চারপাশে ছবি তুলে যাচ্ছে অক্লেশে। আমি মনে মনে হাসি, কারণ ক্যামেরা যতোই দামি হোক না কেন, ওই টিমটিমে হীনপ্রভ আলোতে সুদির তোলা ছবিগুলো যে অস্বচ্ছ অস্পষ্ট হবে আমি তা প্রায় নিশ্চিত। অবশ্য জীবনের সবকিছুই সব সময় স্পষ্ট হতে হবে তারও কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, কিছু কিছু বিষয় প্রচ্ছন্ন কিংবা অস্পষ্ট থাকাই শ্রেয়। 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status