ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

বদ্ধ রুমে নিয়ে বের করলেন বন্দুক

শামীমুল হক

(১ বছর আগে) ২২ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৫:৩৬ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৩:৪৪ অপরাহ্ন

mzamin

বগুড়ার সোনাতলা। একটি উপজেলা। সুন্দর পরিপাটি এ উপজেলা প্রকৃতি ঘেরা। গাছ গাছালি আর গ্রামীণ মাটির পথে ভ্যানে যাতায়াত অপরূপ এক দৃশ্য। সেই সোনাতলার  কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সোনাতলার কথা এলেই সামনে ভেসে আসে ভেদার কথা। দুই হাজার এক সালের কথা। অফিস অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাই বগুড়া ও রংপুর সরজমিন প্রতিবেদনের জন্য। একদিন বগুড়ার সাংবাদিক আমজাদ হোসেন মিন্টুর ঘরে সকালের নাস্তা করছিলাম। এ সময় ভাবি এসে বললেন, ভাই একটি কথা বলতে চাই।

বিজ্ঞাপন
আপনার ভাইকে অনেকবার বলেছি। তিনি শুনেন না। আমি বললাম ভাবি বলেন, আমি শুনবো। ভাবি বললেন, সোনাতলার ভেদাকে নিয়ে রিপোর্ট করতে কতো করে বলি আপনার ভাইকে। তিনি রিপোর্ট করেন না। ভেদা সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণাও দিলেন ভাবি। ভেদা হজ করে এসেছেন। চার, পাঁচটি বিয়ে করেছেন। ক’দিন আগে দ্বিতীয় বউকে তালাক দিয়েছেন। বিশেষ তার সুদের কারবারের জালে বন্দি গোটা সোনাতলা। অসহায়, নিঃস্ব, দরিদ্র লোকদের তিনি সুদে টাকা দেন। নিয়মিত সুদ পরিশোধ না করলে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে আসেন। কাউকে কাউকে তার বাড়িতে এনে বেঁধে রাখেন। টাকা পেলে ছাড়েন। এই সুদের ব্যবসা করে একাধিক বাড়ি করেছেন। বাগানবাড়ি করেছেন। আরও কিছু বলতে যাবেন এ সময় মিন্টু ভাই বাধা দিলেন। ভাবি চুপ হয়ে গেলেন। নাস্তার পর এলো চা। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিন্টু ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম আজ কোথায় যাবো? তিনি বললেন শিবগঞ্জে যাওয়ার কথা আমাদের। আমি বললাম, না আজ সোনাতলা যাবো। ভেদাকে দেখার শখ আমার। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সোনাতলা প্রতিনিধিকে ফোন লাগালেন। বললেন, আমরা আসছি। আপনার এলাকার কি কি রিপোর্ট করা যায় একটু ভেবে রাখুন। আমরা বগুড়া শহর থেকে অটোতে করে সোনাতলা গেলাম। স্থানীয় প্রতিনিধির বাড়ি খুঁজে বের করলেন আমজাদ হোসেন মিন্টু। সোনাতলা প্রতিনিধিকে ভেদার কথা বলতেই বেঁকে বসলেন। বললেন, আজ পর্যন্ত তিনি কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেননি। আর বলবেনও না। এ বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় বলেন আমি আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি। এবার আমি বললাম, ঠিক আছে কথা না বলুক আমরা তো চেষ্টা করতে পারি? সোনাতলা প্রতিনিধি আমাকে বললেন, বস আপনি আমাকে লজ্জা দিবেন না। কারণ আপনাকে নিয়ে যাবো কিন্তু তিনি আপনার সামনেও আসবেন না। আমি আপনার কাছে লজ্জা পাবো। তার চেয়ে বরং আপনারা দু’জন যান। সিদ্ধান্ত হলোÑ কথা না বললে না বলুক। আমরা যাবো। প্রয়োজনে ফিরে আসবো। এর আগে প্রতিনিধির বাড়ি থেকে বের হয়ে ভেদার কাছ থেকে সুদে টাকা নেয়া লোক বের করতে থাকলাম। একেক বাড়িতে যাই আর বীভৎস সব কাহিনী সামনে আসে। কারও ঘর ভেঙে নেয়ার কাহিনী বলছেন। কেউ বলছেন, টাকা দিতে না পারলে তার কিশোরী মেয়েকে যেন বাগানবাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এ জন্য দিন- তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে যায়। এক সময় নোট নিতে নিতে হয়রান হয়ে পড়ি। এবার একটি ভ্যান নিয়ে ভেদার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা। ওই ভ্যানে বসা এক বৃদ্ধাকে ভেদার কথা জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে দেন। বলেন, ওর জন্য আজ আমি পথের ভিখারি। সুদে টাকা নিয়ে দিতে পারিনি। শেষে ঘরসহ বাড়ি লিখে দিতে হয়েছে। কথায় কথায় ভেদার বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামলো। আমরা নেমে গেলাম। ভ্যান এগিয়ে যাচ্ছে অন্য যাত্রীদের নিয়ে। আমরা তিন জন হাঁটতে লাগলাম। একটু সামনে এগুতেই সোনাতলা প্রতিনিধি বললেন, এটি ভেদার বাগান বাড়ি। গ্রামের ভেতরে যেন এক রাজবাড়ী। চমৎকার কারুকাজ। চারদিকে গাছ গাছালিতে ঢাকা। আরেকটু এগুতেই ভেদার বাড়ি। যে বাড়িতে ভেদা বসবাস করেন। 
বাড়ির সামনে একটি কামরাঙ্গা গাছ। এ গাছের নিচে আমরা দাঁড়ালাম। সোনাতলা প্রতিনিধিকে পাঠালাম খবর দিতে। তিনি গেটে ধাক্কা দিতেই দেখেন উঠানে বসে আয়েশি ভঙ্গিতে ভেদা চা খাচ্ছেন। তাকে জানালেন, চাচা ঢাকা ও বগুড়া থেকে দুই জন সাংবাদিক এসেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ভেদা নিরুত্তর। প্রতিনিধি চলে এলেন। আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রায় আধাঘণ্টা। ভেদার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। এমনকি ভেতরে বসারও আমন্ত্রণও নেই। কি করা যায়। সোনাতলা প্রতিনিধি বলেন, আমি তো আগেই বলেছি এমন হবে। এবার আমি বললাম আপনারা দাঁড়ান, আমি যাই। গেট ধাক্কা দিয়ে প্রথমেই সালাম দিলাম। এরও কোনো উত্তর পেলাম না। পাশে একটি টুল দেখতে পেলাম। সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। আর বলতে থাকলাম, ঢাকা থেকে এসেছি আপনার মতো একজন পরোপকারী লোককে দেখার জন্য। আপনার মতো একজন জনদরদী লোককে দেখার জন্য। আপনার দেরি হচ্ছে দেখে আমি নিজেই চলে এলাম। কেমন আছেন বলুন। এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন ভেদা। বললেন, আপনারা তো তিন জন এসেছেন তাই না? বললাম জ্বি। এখানে কোথায় বসতে দেই। চলুন বাইরে যাই। সেই কামরাঙ্গা গাছের নিচে। তিন জনের জায়গায় এখন ভেদাকে নিয়ে চারজন হলো। ভেদা বললেন, কে কোথা থেকে এসেছেন বলেন। আমি বললাম, আমি তো আগেই বলেছি। উনি আমজাদ হোসেন মিন্টু। বগুড়া থেকে এসেছেন। আর ও...। ভেদা বললেন, ওকে চিনি। ও আমাদের এলাকার ছেলে। হঠাৎ করে বললাম- ভেদা ভাই, সামনে জাতীয় নির্বাচন। বগুড়ায় শুনে এলাম আপনি নির্বাচন করবেন। আসলে কি তাই? ভেদা বললেন, দেখেন নির্বাচন তো করতে চাই। বিএনপি এবার আমাকে মনোনয়ন দেবে। আমার যে জনপ্রিয়তা চোখ বুঝে পাসও করবো। বললাম, আপনার এখানে আসার আগে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তারা বললেন, আপনার মতো মানুষ হয় না। আপনি অসহায়দের পাশে টাকা নিয়ে দাঁড়ান। যথাসাধ্য উপকার করেন। এসব কথা বলতে বলতে আরও আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে। এবার ভেদা বললেন, আরে ভাইজান আমি আপনাদের নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আসুন বাড়ির ভেতরে আসুন। সেখানে কথা বলবো। নিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতরে। প্রথমেই গাড়ির গ্যারেজ। সেখানে রাখা তার গাড়ি দেখালেন ঘুরে ঘুরে। এরপর নিয়ে গেলেন ড্রয়িং রুমে। অর্ডার দিলেন নাস্তা দেয়ার জন্য। আমরা কথা চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ বললাম, শুনলাম আপনি চার/পাঁচটি বিয়ে করেছেন। কিন্তু আমার ভালো লেগেছে দ্বিতীয় বউকে নাকি তালাক দিয়েছেন। আবার সে যেন চলতে পারে তাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন। এ কথাটি শুনে খুশি হলেন। বললেন, ভাই কি করবো। অসহায় অনেক মহিলা আসে। তাদের বিয়ে করে রেখে দেই। এত সম্পদ কে খাবে? খা তোরা খা। আর যেটাকে তালাক দিয়েছি সেটা আমার সঙ্গে থাকতে চায় না। তাই দুই লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছি। ঠিক করিনি বলুন? কথার মধ্যেই বাইরের আরও দু’জন লোক এসে হাজির। কথা বার্তায় বোঝা গেল তারা সুদে টাকা নিতে এসেছেন। এক সময় তাদের টাকা দিয়ে বিদায় করলেন। তারপর আমাদের কাছে এসে বললেন, দেখুন হাতে-পায়ে ধরে টাকা নিয়ে গেল। আমি তাদের টাকা দিয়ে উপকার করি। বিনিময়ে তারা আমাকে মাস গেলে বকশিশ দেয়। এটাকে অনেকে সুদ বলে। আরে তোদের ক্ষমতা থাকলে তোরা দে না। এবার ভেদা আমার হাত ধরে বললেন, আসুন ভেতরে আসুন। দেখুন আমি কীভাবে থাকি। আমাদের তিন জনকে দেখাতে লাগলেন একে একে তার রুম। তার কোন স্ত্রী কোন রুমে থাকেন তাও দেখালেন। তার সন্তানদের রুমও দেখালেন। বাদ গেল না তার কাজের মেয়ের রুমও। এরপর আবার গিয়ে ড্রইং রুমে বসলাম। এবার আমাকে একা নিয়ে গেলেন ভেতরে। একটি রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভয়ে বুক ধুকপুক করছে। আবার করলেন কি সিন্দুক খুলে তা থেকে দুটি অস্ত্র বের করলেন। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। এই বুঝি আমি শেষ। বন্দুক দিয়ে আমাকে গুলি করবে। বন্দুক হাতে নিয়ে আমাকে টানলেন। বন্দুক দুটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, ভালো করে দেখেন। দুই অস্ত্রই আমার লাইসেন্স করা। সঙ্গে রাখি। নিরাপত্তার জন্য রাখি। আমি বললাম, অবশ্যই রাখা উচিত। আপনি এত বড় মানুষ। শত্রুতো থাকতেই পারেÑবলেই উঠে দাঁড়ালাম। এবার উনাকে বললাম আমাদের তো আবার বগুড়া যেতে হবে। চলুন বাকি আলাপ শেষ করে নেই। বললেন, আরে যাবেন কই। না খেয়ে যাওয়া যাবে না। আলাপে আলাপে ড্রইং রুমে গিয়ে বসলাম। আমার কাছে মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরই মধ্যে হরেক রকমের নাস্তা এলো। নাস্তা খেতে খেতে বললাম, আপনার ছবি দরকার। রিপোর্ট করতে হলে তো ছবি লাগবে। কাজের ছেলেকে নির্দেশ দিলেন, যে ক’টি অ্যালবাম আছে সব নিয়ে আয়। সাংবাদিক সাব যেটা মনে চায় নিয়ে যাবে। অ্যালবাম এনে সামনে দিলেন। বাছাই করে বেশ ক’টি ছবি নিলাম। ফাঁকে ফাঁকে সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে নিলাম। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে সোজা বগুড়া। এরপর অফিসে রিপোর্ট পাঠানো। সঙ্গে ছবি। পরদিন মানবজমিন পত্রিকায় লাল হরফে লিড নিউজÑ ‘সোনাতলার ভেদা যেভাবে কোটিপতি’। রিপোর্ট নিয়ে বগুড়ায় হইচই। অতিরিক্ত কপি পাঠানো হয়েছিল অফিস থেকে। সকাল দশটার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে গেছে। বগুড়ার মানুষের হাতে হাতে মানবজমিন। ভেদাকে নিয়ে এই প্রথম কোনো পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হলো। আরও ক’দিন থেকে ঢাকায় এলাম। কিন্তু বগুড়া থেকে খবর এলো ভেদা মানহানির মামলা করেছে। আসামি প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরী, রিপোর্টার হিসেবে আমি ও আমজাদ হোসেন মিন্টু। এ মামলা নিয়ে আরেক কাহিনী। মামলার সমন জারি হয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে আসামি পলাতক হিসেবে। সবই করা হয়েছে গোপনে। কোনো কিছুই অফিস পর্যন্ত আসেনি। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার পর আমজাদ হোসেন মিন্টুর চোখে পড়ে। তিনি অফিসকে বিষয়টি জানান। প্রধান সম্পাদক ঠিক করেন বগুড়ার আদালতে হাজিরা দেবেন। সে মোতাবেক তারিখ নির্ধারণ করে ঢাকা থেকে আমরা তিন জন বগুড়া যাই। বগুড়ায় মতিউর রহমান চৌধুরী গেছেন আর এ খবর গোপন থাকবে এটা অবিশ্বাস্য। বগুড়া প্রেস ক্লাব সহ সকল সংগঠন লাইন ধরেছে মতি ভাইকে অভ্যর্থনা জানাতে। কেউ কেউ মতি ভাইকে তাদের অফিসে নিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। পরদিন স্থানীয় পত্রিকাসহ জাতীয় পত্রিকায় রিপোর্ট ‘মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বগুড়ায়।’ আর যায় কোথায়? পরদিন সকালে পত্রিকা দেখে ভেদা জেনে যায় বিষয়টি। তাই আদালত খোলার আগেই তিনি টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হন। ওই দিন যে উকিলই আদালতে প্রবেশ করেছেন তার হাতে মোটা দাগে টাকা দিয়েছেন। বলেছেন তার পক্ষে কথা বলার জন্য। ঢাকা থেকে যারা এসেছেন তাদের জামিন নামঞ্জুর করার জন্য। 
বেলা দশটার দিকে আদালত বসে। আমরা চারজন সাড়ে দশটার দিকে আদালতে প্রবেশ করি। এ সময় সকল উকিল একসঙ্গে দাঁড়িয়ে মাননীয় আদালত তারা আসামি। দীর্ঘদিন তারা আদালতকে অবমাননা করেছেন। তীব্র হইচইয়ের মধ্যে আমাদের একজন মাত্র উকিল কি বলছিলেন কেউই বুঝতে পারছিলাম না। এবার আদালত সবাইকে শান্ত হতে বলে জানতে চান আপনাদের দাবি কি? সবাই একসঙ্গে বলে উঠেন জামিন নামঞ্জুর করতে হবে। আদালত জানতে চান আইনের কোথায় লেখা আছে জামিন দেয়া যাবে না। এ সময় ক’জন আইনজীবী বলে উঠেন, আসামিরা আদালত অবমাননা করেছেন। এ সময় আদালত বলেন আদালত অবমাননার বিষয়টি আদালত দেখবেন। আপনাদের কি? বলেই বিজ্ঞ আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। 
রিপোর্ট করতে গিয়ে দেশের অধিকাংশ জেলায় ঘোরা হয়েছে। অফিস অ্যাসাইনমেন্ট ছিল নওগাঁর বাংলাভাইয়ের কুকীর্তি আর আস্তানা নিয়ে রিপোর্ট করার। তখনো বাংলাভাই আত্মগোপনে যাননি। কিন্তু তার বাহিনীর কর্মকাণ্ড পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছিল। মানুষকে হত্যা করে গাছে উল্টো করে বেঁধে রাখার সেই বর্বর কাহিনী বাংলাভাই ও তার বাহিনীর। এমন নৃশংস কাহিনী নওগাঁ ও রাজশাহীর বাগমারার সর্বত্র চলছিল। আমি যখন নওগাঁ যাই তখন প্রায় বাংলাভাই আত্মগোপনে। বাংলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া এক সাংবাদিকের বর্ণনায় পরে আসছি। আগে নিজের কথা কিছু বলে নেই। নওগাঁ শহরের একটি হোটেলে উঠেছি। খাবার দাবার সব বাইরে থেকে আনতে হয়। পেটে খুব ক্ষুধা। হোটেলের বয়কে বললাম খাবার নিয়ে আসতে। মাছ আর ডাল। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মুখে দিয়ে আর গিলতে পারছি না। তরকারিতে মেথি দেয়া। জীবনে মেথি দিয়ে রান্না হয় এই প্রথম জানলাম। মুখের ভাত ফেলে দিয়ে ভাবলাম ডাল দিয়ে খেয়ে নেই। ওমা সেখানেও একই অবস্থা। পরে একটি রুটি এনে পানি দিয়ে চুবিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে নওগাঁ প্রতিনিধি সাদেকুল ইসলাম হাজির। শুরু বাংলাভাইয়ের বর্বরতার চিত্র দেখতে। একেক জায়গায় যাই আর বর্ণনা শুনে শিহরে উঠি। সে সময় পত্র- পত্রিকায় যা লেখা হয়েছে তার চেয়ে ভয়াবহ। তবে সেখানে গিয়ে আরেকটি বিষয় নজরে আসে। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি মানে সর্বহারা বাহিনীর আরেক চিত্রও নিজ কানে শুনতে পাই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক বাজারে এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা। কথা হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। তিনি বললেন, যারা মারা যাচ্ছে বেশির ভাগই সর্বহারা বাহিনীর সদস্য। আর এই সর্বহারাদের কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধা বলেন, বিশাল হাওরের মাঝে মাঝে গ্রাম। সর্বহারা সদস্যরা সন্ধ্যার পর কোনো বিলে বা মাঠে এক হয়। ছোট ছোট ভাগে তারা গ্রামে প্রবেশ করে। একদিন আমার  পাশের বাড়িতে রাতে হাজির হয় সর্বহারা বাহিনীর একটি গ্রুপ। দরজা নক করতেই ভেতর থেকে খুলে দেয়া হয়। সবাই ঘরে যায়। দুই তিনটি রুমের একটি রুমে প্রবেশ করে ক’জন।  দুজন যায় পাশের একটি ঘরে। সেখানে গিয়ে বড় খাসিটি নিয়ে আসে। বাড়ির মালিককে বলে ‘নে এটা রান্না কর।’ মালিক অসহায়। এরই মধ্যে রুম থেকে বলা হয় আমাদের পানি দে। ওই বাড়ির মালিকের দুটি মেয়ে। ছেলে নেই। বড় মেয়েটি কিশোরী। নিরুপায় হয়ে ওই কিশোরীই যায় পানি নিয়ে। কিশোরী পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করার পর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। ওদিকে বাবা খাসি জবাই করে তাদের জন্য রান্নাবান্না করে তৈরি করে। খাবার সময় হলে ডাক দেয়। রুম থেকে বেরিয়ে আসে সবাই। ওই কিশোরী রক্তাক্ত দেহ নিয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। আর শুনতে ইচ্ছে হলো না। বৃদ্ধকে থামিয়ে দিলাম। সর্বহারা নামই শুনেছি। তাদের বর্বরতার কিছু খবর পত্রপত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু এমন নৃশংস কাহিনীও যে ঘরে ঘরে আছে তা জানা ছিল না। 
পরদিন ক’জন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একজন সরাসরি বাংলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। কীভাবে দেখা হলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন। আগেই অ্যাপয়েনমেন্ট নেয়া ছিল। বিশাল হাওরের মাঝ দিয়ে জমির আইল দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটছি আমরা দু’জন। কয়েক মাইল যাওয়ার পর হঠাৎ চার/ পাঁচজন আমাদের পথরোধ করে। পুরো শরীর তল্লাশি চালায়। এরপর বলে দেয় সামনে গেলে এমন আরেকটি গেইট পাবেন। সেখানেও তল্লাশি হবে। আপনারা যে আসবেন আমাদের আগেই জানানো হয়েছে। সেখান থেকে আবার কয়েক মাইল যাওয়ার পর পথ আটকে দাঁড়ালো কয়েকজন। আবারো তল্লাশি। এরপর বললো, এবার ডানে গিয়ে বামে যাবেন। দশ মিনিট যাওয়ার পর একটি মসজিদ পাবেন। সেখানে প্রবেশ করবেন। তাদের কথামতো গিয়ে পাওয়া গেল মসজিদ। মোটরসাইকেল রেখে ভেতরে প্রবেশ করতে যাবো এ সময় দুজন এগিয়ে এসে বললেন, ওজুস্থানে গিয়ে ওজু করে নিন। তাদের কথামতো ওজু করে নিলাম। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা। ভেতরে ভয়। জান নিয়ে ফিরে যেতে পারবো তো? এরপরই খবর আসে দু’তলায় যাওয়ার। বাংলাভাই সিংহাসনে বসে আছেন। সামনে কম করে হলেও ১০/১২ প্রকারের খাবার। বলা উচিত দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায়। পেটে এখনো দানা পানি পড়েনি। বাংলাভাই আমাদের নিয়ে বসলেন। তিন জনে মিলে খাবার খেলাম। আর খেতে খেতে আলাপ চলতে থাকে। খাবার শেষে বিদায় নিলাম। এর পরদিনই বাংলাভাই আত্মগোপনে চলে যান। এ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। একেবারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর বের হয় তার লাশ। 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status