ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

ডারউইনের শহরে

কাফি কামাল

(১১ মাস আগে) ২২ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১১:৪৯ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

mzamin

যুক্তরাজ্যের কিছু শহরও তেমন। একধরনের বিশেষ কেক বা বিস্কুটের জন্য সুনাম রয়েছে শ্ৰুবুরির। সিমনেল কেক বা ফুট কেক বা বিস্কুটের রেসিপিটির উৎপত্তি এই শহরে। এটি একটি ক্লাসিক্যাল ইংলিশ ডেজার্ট। নাট্যকার উইলিয়াম কনগ্রেড তার 'দ্য ওয়ে অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' নাটকের একটি ডায়লগে এসবুরি কেকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন- "হোয়াই ব্রাদার উইটফুল অফ সালোপ, ইউ মে বি এজ শর্ট এজ এ এসবুরি কেক, ইফ ইউ প্লিজ

লর্ড ক্লাইভ ও চার্লস ডারউইন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ল অত্যন্ত পরিচিত দুইটি চরিত্র। একজন বেনিয়ার আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী, আলোচিত-সমালোচিত বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী। দুইজনের জন্মই ওয়েলস বর্ডারের কাছে ইংল্যান্ডের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় কাউন্টি শ্রপশায়ারে। একজন শহরে জন্মে; হয়েছেন প্রকৃতি গবেষক আর অন্যজন গ্রামে জন্মে; হয়েছেন ইতিহাসের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী। সেই এপশায়ারের প্রধান শহর ক্রসবুরি।

বিজ্ঞাপন
ট্রেনে চড়ে যে শহরে গেলে স্টেশন থেকে বেরুতেই নীরবে স্বাগত জানায় ঐতিহাসিক ক্যাসল। আর পিউত্তর স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত অভিজাত ভবনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত এসবুরি স্টেশনকে বলা হয়- গেটওয়ে টু ওয়েলস। প্রবাসের যাযাবর জীবনে ২০২০ সালে বৃটেনের পশ্চিম মধ্যভূমি তথা ইংল্যান্ডের হৃদয়খ্যাত বার্মিংহামে শুরু হয় আমার অস্থায়ী বসবাস। পরিবার- পরিজনহীন এক নিঃসঙ্গ জীবন। প্রতি সপ্তাহে বেরিয়ে পড়ি এদিক-সেদিক। কোনো না কোনো ছোট-বড় শহর কিংবা গ্রামে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা করি দিনভর। তেমনই এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে ছুটলাম সবুরি। এসবুরি হচ্ছে শ্রপশায়ারের প্রধান শহর।

ওলভারহ্যাম্পটন থেকে ওয়েলস অভিমুখী ট্রেনে চড়ে বড় বড় ফসলের মাঠ, পাহাড় আর অরণ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে গিয়ে পৌঁছলাম সবুরি। খুবই পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর স্টেশন। চতুর পেরোতেই বামপাশে ক্যাসল, এবং সেটা পর্যটকদের নীরবে স্বাগত জানায়। প্রথমবার আমার সেটা জানাই ছিল না; বরং আমার কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ডারউইনের আঁতুড়ঘর। গুগল ম্যাপের সহায়তা নিয়ে তাই স্টেশন থেকে বেরিয়ে প্রথম ট্রাফিক লাইট থেকে ডানদিকে হাঁটা ধরলাম। সেভারন নদীর তীর ধরে স্মিথফিল্ড রোড হয়ে কিছুটা এগোলে হাতের ডানপাশে এক অদ্ভুতে গেটের মতো ভাস্কর্য দেখে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালাম । মনে হলো পাথর দিয়ে হাড়ের মালার মতো কিছু একটা বানিয়েছেন শিল্পী । ভাস্কর্যটির নাম-কোয়ান্টাম লিপ স্কাল্পচার। যা ভেবেছিলাম, সে রকমই ঘটনা ।

ডারউইনের থিউরি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে যা ডাইনোসরের হাড়, ডিএনএ ও মেরুদণ্ডের প্রতিনিধিত্ব করে। বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী ডারউইনের জন্মের দ্বি-শতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৯ সালে ভাস্কর রনবীর লাল এটি তৈরি করেন। ডারউইনের প্রৌপুত্র র‍্যান্ডেল কেইনস এটির উদ্বোধন করেছিলেন।

কোয়ান্টাম লিপ পেরুলেই সেভারন নদীর দুকূলকে এক করেছে যে ব্রিজটি তার নাম-ওয়েলস ব্রিজ। এই শহরটিকে ঘিরে রেখেছে সেভারন নদী। আর শহরের চারপাশের বসতিগুলোকে যুক্ত করেছে একাধিক ব্রিজ। তবে শ্রুসবুরি শহরের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে- প্রধান সেতু দু'টির একটি পূর্বে, অন্যটি পশ্চিমে। পূর্বের সেতুটির নাম ইংলিশ ব্রিজ আর পশ্চিমের সেতুটির নাম ওয়েলশ ব্রিজ। কারণ এই শহরটির পূর্বদিকে ইংল্যান্ড আর পশ্চিমদিকে ওয়েলশ। যাই হোক, ওয়েলশ ব্রিজ পেরিয়ে সেভারন থিয়েটার হলকে পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম দ্য মাউন্ট রোড ধরে। দুইশ' মিটারের মতো সামনে গেলেই হাতের ডানপাশে উঠে গেছে একটি প্রাইভেট বাড়ির পথ। গেটে এবং পাশের দেয়ালের ফলকে উৎকীর্ণ একটি নাম চালর্স ডারউইন। সেভারন নদীর পশ্চিমতীরে টিলার উপর বাড়িটির অবস্থান। বাড়ির নাম দ্য মাউন্ট। বড় এবং অভিজাত এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বিজ্ঞানীদের একজন চার্লস ডারউইন। তার লেখা, অন দ্য অরিজিন অফ দ্য স্পিসিস, পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করেছিল। প্রায়শই তার একটি তত্ত্বকে কেন্দ্র করে বিতর্কের ঢেউ বয়ে যায়। বাড়িতে এখন কেউ থাকেন না। চত্বরটি বেশ পরিপাটি। সেখানে দাঁড়ালে শ্রুসবুরি শহরের পশ্চিম অংশটি চোখে পড়ে। ঘাসের চত্বরে বসে কিছুক্ষণের জন্য ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম। ডারউইনের পূর্বপুরুষ তথা পর-দাদার বাড়ি ছিল নটিংহামশায়ারের কৃষিপ্রধান এলাকা নিউ আর্কের এলসটনে। ডারউইনের বর-দাদা ছিলেন একজন আইনজীবী, ডাক্তার ও বিজ্ঞানী। ডারউইনের দাদা এরাসমুস ডারউইন ছিলেন চিকিৎসক, দাসবাণিজ্য বিলোপকারী ও কবি। তিনি বার্মিংহামের কাছের প্রাচীন টাউন লিডফিল্ডে বসবাস করতেন। ডারউইনের চিকিৎসক পিতা রবার্ট ডারউইন বসবাস শুরু করেন এসবুরি। চার্লস ডারউইন পারিবারিক ধারাক্রমে চতুর্থ প্রজন্মের চিকিৎসক না হলেও চতুর্থ প্রজন্মের বিজ্ঞানচর্চায় নিজ বংশের, শহরের, সর্বপরি দেশের নাম উজ্জ্বল করেন।

দ্য মাউন্ট থেকে ফেরার পথে ঢু মারলাম থিয়েটার সেভারন হলে। ইংরেজি নাটক আর এসবুরি শহরের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এই শহরকে বলা হয় ইংরেজি নাটকের আদিভূমি। দাবি করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম সেক্সপিয়ার এই শহরে নাটক মঞ্চস্থ ও তাতে অভিনয় করেছেন। অবশ্যই সেক্সপিয়ারের জন্মভূমি স্ট্রাটফোর্ড আপন এভন সবুরি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার চালর্স ডিকেন্স এই শহরে এসেছেন বারবার। যারা ইংলিশ নাটক পছন্দ করেন তাদের কাছে পছন্দের একটি নাম 'ক্রিসমাস ক্যারল' । ডিকেন্সের জনপ্রিয় এই নাটকটি আমি দেখেছিলাম ডার্বি অবস্থানকালে। সেটাই ছিল আমার প্রথম মঞ্চে বনে একটি ইংরেজি নাটক দেখা। সে নাটকের একটি চরিত্রের নাম এবেলিজার ভুজ। বাংলায় যেমন কৃপণ বুঝাতে ৰখিল বা কারুনের নাম উল্লেখ করা হয়, ঠিক তেমনি একটি কৃপণ চরিত্র এবেনিজার। ক্ষসবুরির অন্যতম দর্শনীয় স্থান কোয়ারি গার্ডেনের কাছে সেন্ট চাদ চার্চের ইয়ার্ডে রয়েছে এবেনিজার ক্রুজের একটি কবর। ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'ক্রিসমাস ক্যারল' চলচ্চিত্রটির এবেনিজার ক্রুজের কবরচিত্রটি এখানে শ্যুট করা হয়েছিল। যদিও বলা হয়, স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরাতেও এই ধরনের একটি কবর আছে এবং ডিকেন্স সে কবর দেখেই এবেনিজার চরিত্রটি অঙ্কিত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। যাই হোক, বৃটেনের এককালের পয়েট লরিয়েট বা রাজকবি জন ওয়েভার শ্রুসবুরি শহরে জন্ম দিয়েছিলেন ইংরেজি ব্যালে। পাশাপাশি তিনি প্রবর্তন করেছিলেন প্যান্টোমাইমের। আগেই বলেছিলাম, শ্রুসবুরি শহরটিকে পেঁচিয়ে রেখেছে সেভারন নদী। যা ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী। ক্রসবুরির আকর্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে সেভারন নদীর তীর ধরে হাটহাঁটি। দ্য মাউন্ট থেকে ফেরার পথে ওয়েলস ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে যে ওয়াকওয়েটি চলে গেছে আমি সেটি ধরেই এগোলাম। বলে রাখি, ওয়েলস ব্রিজের গোড়ায় বেশকিছু ইঞ্জিন নৌকা দেখা গেল। আপনি চাইলে সেভারন নদীর জলপরি সাবরিনার নামে একটি নিয়মিত বোট ট্যুর করতে পারেন। ওয়েলস ব্রিজের গোড়ায় ভিক্টোরিয়া কোয়ে থেকে প্রতিদিন সাবরিনা নৌকাগুলো চলে । মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই সার্ভিসগুলো দেয়া হয়। এ ছাড়া চাইলে নৌকাবাইচও করতে পারবেন। সেজন্য ভাড়ায়। ক্যানো পাওয়া যায়। আয়রন ব্রিজ এলাকায় গেলেই আপনি এই ক্যানো পাবেন। চাইলে মাছও ধরতে পারবেন। আমার নৌকা চড়ার কিংবা মাছ ধরার সময় নেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে দেখে নিতে চাই প্রাচীন এই শহর। কিছু দূর সামনে এগোতেই হাতের বামপাশে বিশাল এক পার্ক চোখে পড়লো। শহরের কেন্দ্রস্থলে সেন্ট চাদ চার্চ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ঢালু এই পার্কে মানুষের ঢল নেমেছে। নানা বয়সের ইংরেজ নারী-পুরুষ আর শিশুরা সেখানে নানাভাবে উপভোগ করছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। বাচ্চারা খেছে আর নারী-পুরুষ করছে সূর্যস্নান। সেখানে নদীর উপর একটি মনোরম ঝুলন্ত ব্রিজ ওপারের সঙ্গে গড়েছে সেতুবন্ধন। ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে কিছুটা এগোলেই কিংসল্যান্ড রোড এলাকাটি হচ্ছে শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা । কিন্তু আমি নদীর পাড় ধরে দুই তীরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগোলাম। ডানদিকে ওপারে পেঙ্গওয়ার্ন বোট ক্লাব। পেঙ্গওয়ার্ন বোট ক্লাবের পর ওপারে, মানে শহরের বিপরীত পাশে কিছু বাড়ির পেছনে বা রেস্টুরেন্ট-পাবের পেছনে তৈরি করা হয়েছে সময় কাটানোর দারুণ ব্যবস্থা । বেঞ্চ আর সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে একদম নদীর তীরে । যেখানে বসে শহর, নদী আর নদী তীরের পথ ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষ আর পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নদীর শহরকূলে রয়েছে বিশাল সবুজ ঢালু চতুর আর সে চতুরে কোয়ারি। যেখানে গ্রীষ্মকালে বেশকিছু ইভেন্ট আয়োজন করা হয়। আর কোয়ারির একদম কেন্দ্রস্থলেই ডিজেলের অবস্থান। এই ডিঙ্গেল নামের এই ল্যান্ডস্কেপ বাগানটি তৈরি করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত মালি পার্সি থ্রোয়ার। আর ডিঙ্গেলে সেভারনের জলপরি সাবরিনার ভাস্কর্য। শ্রুসবুরি শহরের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র বলা যায় কোয়ারি পার্ক ও ডিঙ্গল। ষোড়শ শতকে নির্মিত এই পার্কটি এমন একটি অবস্থানে অবস্থিত যে, পুরো শহরকে আকর্ষণীয় করে তুলে। আমি ঘুরে দেখেছি ইংল্যান্ডের বহু শহর, কিন্তু কোথাও এমনটা চোখে পড়েনি।

সেভারনের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে পূর্বপ্রান্তের ইংলিশ ব্রিজে চলে এলাম। এবার নদীর তীর থেকে উঠে রাস্তা ধরে ছুটলাম পূর্বদিকে লর্ড হিলের কলামে। ইংলিশ ব্রিজ থেকে পূর্বদিকে যে প্রধান সড়কটি চলে গেছে সেটা ধরে কিছুদূর এগোলেই লর্ড হিলের কলাম। পথেই হাতের বামপাশে একটি ত্রিকোনাকৃতির ভূমির উপর শ্রুসবুরি অ্যাবে। এলাকাটির নাম অ্যাবে ফোরগেট । শহরের প্রাচীনতম ভবনগুলোর একটি এই অ্যাবে একটি অবশ্য দর্শনীয় স্থাপনা। আর্ল রজার ডি মন্টগোমারির উদ্যোগে বেনেডিক্টাইন মঠ হিসেবে নির্মিত হয়েছে ১০৮৩ সালে। এখনো প্যারিশ চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। একটি চক্কর কাটলাম অ্যাবের চারপাশে। প্রতিষ্ঠার পর দ্রুতই এটি ইংল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান এবং প্রভাবশালী চার্চে পরিণত হয়েছিল। রাজ আনুকূল্য পাওয়া চার্চটি শ্রুপশায়ার, স্টাফোর্ডশায়ার ও ওয়েলসের বিভিন্ন এলাকায় জমিসহ নানা সম্পদের অধিকারী হয়। গ্রামীণ জমিদারদের দান-দক্ষিণায়। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে অর্থ যোগ হলে যা ঘটে প্রায়ই, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমাদের দেশে বিখ্যাত মসজিদ-মাজারের খাদেম ও পরিচালনা পরিষদের লোকজনের বিরুদ্ধে অর্থ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ উঠে হরহামেশাই। মামলা-মোকদ্দমা ও খুনোখুনিতে পর্যন্ত গড়ায়। এই শ্রুসবুরি অ্যাবের বিপুল সম্পদের তত্ত্বাবধান নিয়েও স্বাদশ- ত্রয়োদশ শতকে নানাপক্ষের মধ্যে হামলা, অস্ত্রের মুখে পদত্যাগ, জোর করে তাড়িয়ে দেয়া, অপহরণ, পক্ষ-বিপক্ষ এবং মামলা- মোকদ্দমার ইতিহাস পাওয়া যায়। বিষয়টি আমাকে একধরে ভাবনার অতলে তলিয়ে দেয়।

অ্যাবের চত্বরে ভাবনার ঘুরপাক থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম লর্ড হিলের কলাম অভিমুখে। এটি শ্রুসবুরির অন্যতম এক দ্রষ্টব্যস্থান। শহরের পূর্বপ্রান্তে, ইংলিশ ব্রিজ পার হয়ে পূর্বদিকে কিছুদূরে গেলেই লর্ড হিলের উঁচু কলামটির অবস্থান। ১৩৩ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্তম্ভটি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে লম্বা ডরিক কলাম। যে স্তম্ভের শীর্ষে দণ্ডায়মান ১৭ ফুট উচ্চতার জেনারেল রোনাল্ড হিলের ভাস্কর্য। এটি মনুমেন্ট টু বৃটিশ লিবার্টির চেয়ে ছোট হলেও স্তম্ভ ও ভাস্কর্যের উচ্চতা মিলিয়ে বেশি। ১৮১৪-১৬ সালে নির্মিত এই কলামের উচ্চতা লন্ডন ট্রাফালগার স্কয়ারের নেলসনের স্তম্ভের চেয়েও বেশি। লর্ড হিলের কলাম থেকে ফেরার পথে ইংলিশ ব্রিজের আগে বামদিকে চলে গেছে যে প্রধান সড়কটি তা ধরে সামান্য এগোলেই কোলহাম পাম্পিং স্টেশন। এটি একটি ঐতিহাসিক পাম্প স্টেশন। উনিশ শতকে নির্মিত এই পাম্পিং স্টেশনটি বাষ্পচালিত যা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। এখন একটি মাঝে মাঝে কাজ করে। তবে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

শহরের চতুরপাশে ঘোরা হলো, এবার মূল শহরটি দেখার পালা। শহরটি খুব বড় নয়, তবে প্রাচীন এবং ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ। শহরটিতে ৬৬০টি তালিকাভুক্ত ভবন রয়েছে। যা এই শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাচীনত্বের নিদর্শন। যার মধ্যে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে তৈরী কিছু কাঠের বাড়িও রয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আঁকাবাঁকা অপরিসর রাস্তা ও কানাগলি। এই শহরটি মধ্যযুগীয় কিছু রাস্তার প্যাটার্ন বিদ্যমান। এক রাস্তা থেকে ভবনের মধ্যখান দিয়ে আরেক রাস্তায় যাওয়ার সরু পথকে শাটস বলা হয়। বাংলায় যেগুলোকে বলা হয় কানাগলি। তেমনই কানাগলির একটি হচ্ছে কফি হাউস প্যাসেজ। এর প্রতি দারুণ আগ্রহ আছে পর্যটকদের। আর হাউ স্ট্রিটের পূর্বপ্রান্তে একটি সুন্দর বাড়ি চোখে পড়বে। সেটি হচ্ছে আয়ারল্যান্ড ম্যানশন। ধনী উল ব্যবসায়ী রবার্ট আয়ারল্যান্ড নিজের বসবাসের জন্য ১৫৭৫ সালে এই ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। এই শহর ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই উল শিল্পের জন্য প্রভূত উন্নতি লাভ করেছিল। এলিস পিটার্সের ব্রাদার ক্যাডফেল উপন্যাসটির চরিত্র এবং পটভূমি এই শ্রুসবুরি শহর। এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া গ্রন্থের লেখক ই এম ফস্টারের হাওয়ার্ড এন্ড উপন্যাসেও বর্ণিত হয়েছে শ্রুবুরি। শহরের ভবনগুলোর প্রাচীনত্ব দেখতে দেখতে ভাবনার স্রোতে ভেসে গিয়ে পৌঁছলাম শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ১২৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্য স্কয়ারে। দ্য স্কয়ারকে বলা হয় হার্ট অব শ্রুসবুরি। স্কয়ারের বেশির ভাগ ভবনের বয়স ছয়শ' বছরের বেশি। দ্য স্কয়ারে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপনকারী লর্ড ক্লাইভের একটি ভাস্কর্য। আপনার মনে নিশ্চয় কৌতূহল জন্মাবে, যখন জানবেন এই শহরের নির্বাচিত মেয়র ও এমপি ছিলেন তিনি। আর লর্ড ক্লাইভ জন্মেছেন শ্রুসবুরি থেকে প্রায় ১৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমের একটি সুন্দর ভিলেজ টাউন মার্কেট ড্রাইটনে। কেবল লর্ড ক্লাইভই নন, এই শহর থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিখ্যাত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিসরায়লি। লর্ড ক্লাইভ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কাছে একজন খলনায়ক। কিন্তু বৃটিশদের কাছে তিনি একজন কীর্তিমান। তবে উপনিবেশ স্থাপনকারী কিংবা ইতিহাসের খলনায়কদের অপমানের ইতিহাস শেষ হয় না। যে এসবুরির সন্তান লর্ড ক্লাইভ ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, যাকে এককালে ভোট দিয়ে নিজেদের মেয়র ও এমপি বানিয়েছিলেন এলাকাবাসী, তারাই এখন দাবি তুলছে নগর থেকে তার ভাস্কর্য অপসারণে। আমি এমন এক সময় শ্রুসবুরি ঘুরতে এলাম, যখন এটা নিয়ে চলছে শোরগোল। দ্য স্কয়ার থেকে তার ভাস্কর্য সরাতে পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে ১০ হাজার মানুষ। অন্যদিকে সেটা রক্ষায় পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে ৬ হাজার মানুষ। যদিও ভাস্কর্য অটুট আছে, তবে অপমান তো বহমান। এখানে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি । পুরো একটি দিন ঘোরাঘুরি করেও শহরে তেমন এশিয়ান মানুষ চোখে পড়েনি। কালো মানুষ দেখলাম হাতেগোনা কয়েকজন। আসলে শ্রপশায়ার তথা ক্রসবারি একটি শ্বেতাঙ্গ প্রধান এলাকা।

শ্রপশায়ারের অধিবাসীদের ডাকা হয় সালোপিয়ান। এসবুরি শহরের ৯৮.৫ ভাগ ইংরেজ শ্বেতাঙ্গের বিপরীতে এশিয়ান ও আফ্রিকানদের সংখ্যা ০.৫ ভাগ। তার মধ্যে কালোদের সংখ্যা ০.১ ভাগ। অথচ ইংল্যান্ডের গড়পড়তা শ্বেতাঙ্গের সংখ্যা ৮৭ ভাগ। এ ছাড়া ইংল্যান্ডে গড়পড়তা খ্রিস্টানদের সংখ্যা যেখানে ৭১.৭ ভাগ, সেখানে শ্রুসবুরিতে সেটা ৭৭.৯ ভাগ । ঐতিহাসিকভাবেই এই এলাকাটি রক্ষণশীল প্রধান। যাই হোক, দ্য স্কয়ারের একটি মাল্টি এওয়ার্ড বিজয়ী ইনডোর মার্কেট হচ্ছে ১৫৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মার্কেট হল। এখানে আছে সবধরনের জিনিসের দোকান। আপনি যদি প্রাচীন জিনিসপত্রের প্রতি আগ্রহী হন তবে একবার ঢু মেরে দেখতে পারেন ট্রেজার ট্রবে। সামরিক স্মৃতিচিহ্ন থেকে শুরু করে ভিনটেজ পোশাক, ক্যামেরা এবং ক্যাবিনেটসহ হাজারো পুরোনো জিনিসপত্র দেখতে পাবেন । আর এর প্রতিটি জিনিসপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা মানুষের নানা রকম স্মৃতি । আপনি নিশ্চয়ই এমন কিছু পাবেন যা আপনার মনকে শ্রুসবুরি এন্টিক সেন্টার থেকে কিনে নিতে বাধ্য করবে। আপনি যদি কফি ও মিষ্টি খাবার পছন্দ করেন তবে দ্য মার্কেট ক্যাফে হচ্ছে আপনার জন্য অবশ্য গমনীয় । বাংলাদেশে এক একটি জেলা একেক রকম খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। কুমিল্লার  রসমলাই, টাঙ্গাইলের চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, চট্টগ্রামের শুটকি কিংবা খুলনার চুইঝাল ।

যুক্তরাজ্যের কিছু শহরও তেমন। একধরনের বিশেষ কেক বা বিস্কুটের জন্য সুনাম রয়েছে শ্রুসবুরির। সিমনেল কেক বা ফ্রুট কেক বা বিস্কুটের রেসিপিটির উৎপত্তি এই শহরে। এটি একটি ক্লাসিক্যাল ইংলিশ ডেজার্ট। নাট্যকার উইলিয়াম কনগ্রেভ তার 'দ্য ওয়ে অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' নাটকের একটি ডায়লগে ক্রসবুরি কেকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন- 'হোয়াই, ব্রাদার উইটফুল অফ সালোপ, ইউ মে বি এজ শর্ট এজ এ শ্রুসবুরি কেক, ইফ ইউ প্লিজ। বাট আই টেল ইউ টিজ নট মডিশ টু নো রিলেশনস ইন টাউন।' কোনো এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে যাদের আগ্রহ আছে, তারা ঢু মারতে পারেন শ্রুসবুরি মিউজিয়াম ও আর্ট গ্যালারি। এটি একটি অভিনব ভিক্টোরিয়ান ভবন। জাদুঘরে প্রত্মতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, জীবাশ্ম, আলঙ্কারিক শিল্প ও সিরামিক এবং শ্রুসবুরির সামাজিক ও শিল্প ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে পারেন। এই জাদুঘরে ৩ লাখের মতো জিনিস রয়েছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট চাদ চার্চে চলে গেলাম। শ্রুসবুরি অ্যাবে পুরোনো হলেও সেটা বলতে গেলে শহরের প্রাস্ত সীমায় । সেভারন নদীঘেরা শ্রুসবুরি মূল শহরের বাইরে। কিন্তু মূল শহরের মধ্যেই ১৭৯২ সালে সেন্ট চাদ চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। চার্চের উঁচু গোলাকার মিনারটি শ্রুসবুরির একটি ল্যান্ডমার্ক । ফলে এই চার্চটি ঘুরে না দেখলে আপনার শ্রুসবুরি ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যাবে।
 

প্রাণিকূলের মধ্যে মানুষের সবচেয়ে ঘনিষ্ট দুটি প্রাণী হচ্ছে কুকুর ও বিড়াল । যদিও মানুষ অন্যকে ছোট করতে বা গালি দিতে এই দুইটি প্রাণীর নাম উল্লেখ করে, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রেও এরাই অগ্রগণ্য। ইংল্যান্ডের প্রায় লোকজন কুকুর পোষে। বেশির ভাগ ঘরেই থাকে পালিত কুকুর। কেবল শখের বসে নয়, বিশেষ প্রয়োজনেও অনেকেই কুকুর পোষেন। পৃথিবীব্যাপী কুকুরের প্রভুভক্তির রয়েছে অসংখ্য গল্প-কাহিনী। প্রভুভক্তির ব্যাপারে বিড়ালের তেমন গল্প নেই। তবে মানুষের আদর পাওয়ার বেলায় বিড়াল বোধহয় এগিয়ে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একজন বিখ্যাত সাহাবি বিড়ালের প্রতি ভালোবাসার কারণে আবু হুরায়রা বা বিড়ালের পিতা অ্যাখায়িত হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে অনেক রেস্টুরেন্টে কুকুর নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু একটি ব্যতিক্রমী ক্যাফে আছে শ্রুসবুরি শহরের মারডলে। যেটাকে বলা হয় বিড়াল ক্যাফে। হ্যাঁ, সেখানে রয়েছে এগারোটি পালিত বিড়াল। আপনি যদি বিড়াল পছন্দ করেন তবে কফিপান করতে করতে বিড়ালের নানা খেলাধুলো উপভোগ আর বিড়ালকে আদর করতে পারবেন। অবশ্যই এখানে অতিরিক্ত সময় কাটাতে চাইলে আপনাকে অতিরিক্ত অর্থও পরিশোধ করতে হবে। আমি প্রচুর কফিপান করি, কিন্তু বিড়াল আমার পছন্দ নয়। তবুও বিখ্যাত ক্যাফেটি এক চক্কর ঘুরে দেখলাম। আর যারা রাতের শহুরে জীবন উপভোগ করতে চান, তাদেরও হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। শহরে অনেকগুলো বার ও পাব শহরের রাতকে রঙিন করে তোলে।

দিনের উজ্জ্বল সূর্যও ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। শহর ঘোরা শেষ করে এবার ছুটলাম এসবুরি ক্যাসলে। ক্যাসলের প্রাঙ্গণে ছোট্ট সাজানো ফুল বাগানেই রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি কামান। ১০৬৭ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাসলের গ্রাউণ্ডে আপনি বিনামূল্যে ঘুরে দেখতে পারবেন। তবে দুর্গে প্রবেশের জন্য আপনাকে টিকিট কাটতে হবে। গ্রীষ্মকালে প্রচুর লোকজনকে বিশেষ করে বয়স্কদের এই ক্যাসলের গ্রাউন্ডের বেঞ্চে বসে গল্প করতে এবং মধ্যাহ্নভোজ উপভোগ করতে দেখা যায়। এসবুরি ক্যাসলের ভেতরে রয়েছে সলিয়েরস অফ শপশায়ার মিউজিয়াম। যেখানে দেখতে পারেন অস্ত্র, ইউনিফর্ম, মেডেল এবং রৌপ্যপাত্রের একটি সংগ্রহ যা বৃটিশ সেনাবাহিনীর ৩০০ বছরের বেশি সময়ের বিবর্তন এবং শ্রপশায়ারের সৈন্যদের আত্মত্যাগকে প্রদর্শন করে। আপনি যদি সামরিক এবং সামরিক ইতিহাসে আগ্রহী হন, তবে একটি দর্শন মূল্য দিয়ে সেগুলো দেখতে পারেন। বৃটিশ সেনাবাহিনীর লাইট ইনফ্যান্ট্রি সপ্তদশ শতক থেকে শ্রুসবুরির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই লাইট ইনফ্যান্ট্রির যোদ্ধারা আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধেও অংশ নিয়েছে। শহরতলীর কপথন ব্যারাককে বলা হয় লাইট ডিভিশনের আধ্যাত্মিক বাড়ি। ক্যাসলের আরেকটি বিষয় লরার টাওয়ার। এখানে চড়ে আপনি

শহরটি একটি প্যানোরামিক দৃশ্য অবলোকন করতে পারবেন। ক্যাসলের পাশেই যে আরেকটি কৌতূহলী স্থাপনার অবস্থান, সে সম্পর্কে ঘুরতে যাবার আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। হ্যাঁ, সেটি অবশ্যই ভিন্ন জিনিস। ক্যাসল মানেই রাজবাড়ি। আর ক্যাসলের পাশেই রয়েছে কারাগার। কারাগারের নাম দ্য ডানা । অনেকেই শ্রুসবুরি প্রিজন বলেও চিনেন। একেবারে গা-ঘেঁষে। বর্তমানে এসবুরির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই কারাগার। জাদুঘরে পরিণত করা এই কারাগারটি আপনাকে ভাবনার জগতে নিয়ে যাবে। শ্রুসবুরি কারাগারের ভেতরের দৃশ্য নিয়ে চিত্রায়িত হয়েছে বিবিসিস টাইম উইথ সিন বিন। আইটিভিস প্রে, মোস্ট হান্টেট। আর বিসিসি চিত্রায়িত করেছিল এই কারাগারের ৩৯ জন্ম সেল । শ্রুসবুরি কারাগারে সর্বশেষ ফাঁসিটি কার্যকর হয়েছিল ১৯৬১ সালে। একুশ বছর বয়সে জর্জ রিলিকে ওই বছরের ৯ই ফেব্রুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। সময় থাকলে, অর্থের বিনিময়ে কারাগারের এস্কেপ রুমটি উপভোগ করতে পারেন। এই কারাগার নিয়ে রয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি এ ই হাউসম্যানের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। তিনি লিখেছেন-

They hang us nwo in Shrewsbury jail: 

The whistles blwo forlorn,

 And trains all night groan on the rail

 To men that die at morn.

 There sleeps in Shrewsbury jail to-night,

 Or wakes, as may betide,

A better lad, if things went right,

Than most that sleep outside.

ক্যাসলের ঠিক উল্টোপাশেই শ্রুসবুরি লাইব্রেরি। এককালে এই লাইব্রেরি ভবনটিই ছিল শ্রপশায়ার স্কুল। যা পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের সেরা স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই ভবনটি ১৫৫০-১৮৮২ পর্যন্ত দীর্ঘ তিনশ' ৩০ বছর এ ভবনে পাঠদানে ব্যবহৃত হয়। পরে স্কুল ভবনটি নদীর দক্ষিণ তীরে স্থানান্তর করা হয়। বিখ্যাত রবিনসন ক্রুশোর লেখক ড্যানিয়েল ডিপো অষ্টাদশ শতকে এই স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। চালস ডারউইন, উপন্যাসিক স্যামুয়েল বাটলার, পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু আরভিন এই স্কুল ভবনে পড়াশোনা করেছেন। আমরা প্রথম হিমালয় বিজয়ী হিসেবে নাম জানি তেনজিং নোরগে ও অ্যাডমন্ড হিলারির।

কিন্তু তাদের চেয়ে তিন দশক আগে ১৯২৪ সালে তিব্বতের দিক থেকে সর্বপ্রথম হিমালয় জয় করেন এই অ্যান্ড্রু আরভিন। তবে ফেরার পথে তার মৃত্যু হয়। শ্রুসবুরি স্কুল ভবন যখন লাইব্রেরি ও জাদুঘরে পরিণত করার ইতিহাসও দেড়শ' বছরের পুরোনো। বিংশ শতকে কিছুদিন উন্নয়ন কাজের জন্য লাইব্রেরিটি স্থানান্তর করা হলেও ১৯৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার বোন প্রিন্সেস মার্গারেট সেটি রিওপেন করেন। ডারউইনের একটি ভাস্কর্য রয়েছে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে। এসবুরি স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন বৃটিশ সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী মাইকেল হেসেলটাইন, ব্রুনাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স ওমর আলি বলকিয়াহসহ অসংখ্য রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক, ক্রীড়াবিদ, বিচারক, রাষ্ট্রদূত, শিক্ষাবিদ এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন।

শ্রুসবুরি ছিল পাউইস রাজ্যের প্রথমদিকের রাজধানী। প্রাচীন বৃটিশদের কাছে যা পেঙ্গওয়ার্ন নামে পরিচিত। আর এসবুরি নামটি এসেছে ঝোপঝাড় থেকে। প্রাক-মধ্যযুগেই শুরু হয় শ্ৰুসবুরির ইতিহাস। বিশ্বাস করা হয় যে, অ্যাংলো-স্যাক্সন শ্রুসবুরি ছিল একটি সুরক্ষিত জনবসতি। আর নবম শতকের শুরুতে এখানে একটি টাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শ্রুসবুরির দক্ষিণ-পূর্বদিকে মাত্র ৫ মাইল দূরের রক্সেটার গ্রামটি একসময় ভিরোকোনিয়ামের স্থান ছিল। যা রোমান বৃটেনের চতুর্থ বৃহত্তম ক্যান্টোনাল রাজধানী। শ্রুসবুরিকে আধুনিক রূপ দেন রজার ডি মন্টগোমারি। উইলিয়ামের কাছ থেকে শহরটি উপহার হিসেবে পাওয়ার পর তিনি সেখানে দশম শতকের শেষদিকে শ্রুসবুরি ক্যাসল, বেনেডিক্টাইন চার্চ হিসেবে শ্রুসবুরি অ্যাবে নির্মাণ করেন। এগারো শত ৫৫ সালে এসবুরি অ্যাবের পাশে একটি কুষ্ঠরোগী হাসপাতাল এবং একটি সাধারণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে শহরটি উল শিল্পের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। শ্রুসবুরি ড্রাপারস কোম্পানিটি বহু বছর ধরে ওয়েলশ উলের বাণিজ্যে আধিপত্যে বিস্তার করেছিল। চতুর্দশ শতকের শুরুতে শহর থেকে কয়েক মাইল উত্তরে রাজা চতুর্থ হেনরি ও হেনরি হটস্পার পার্সির মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। যেটা এখনো ব্যাটলফিল্ড নামে পরিচিত। তবে শ্রুসবুরি শহরটি যে কারণে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তা হচ্ছে এটি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের জন্মনগর।

রক্তে সাংবাদিকতার নেশা। তাই যেকোনো শহরে গেলে সেখানকার গণমাধ্যম সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার একটি অভ্যাস তৈরি হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এই ছোট্ট শহর শ্রুসবুরি থেকে দুইটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। একটি শ্রপশায়ার স্টার, অন্যটি শ্রুসবারি ক্রনিকল। এই শ্রুসবুরি ক্রনিকল দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে একটি । যার প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৭৭২ সালে। রয়েছে তিনটি রেডিও স্টেশন। বিবিসি শ্রুসবুরি, ফ্রি রেডিও শ্রপশায়ার ও ব্ল্যাক কান্ট্রি। এ ছাড়া আছে অনলাইন গ্রুপশায়ারলাইভডটকম। যাই হোক, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। এসবুরি শহরে উদযাপিত হয় ডারউইন উৎসব। আর বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো একটি ফুল উৎসব হলো শ্রুসবুরি ফ্লাওয়ার শো। ১২৫ বছর ধরে চলছে দুই দিনব্যাপী এই শো প্রতি বছর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে। প্রতি বছর আগস্ট মাসের ব্যাংক হলিডের দিনে অনুষ্ঠিত হয় ফোক ফেস্টিভ্যাল। খুবই জনপ্রিয় এই ইভেন্ট উপভোগ করতে সারা যুক্তরাজ্য থেকে লোকজন হাজির হয়। এ ছাড়া কমেডি ও কমিকস ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। এই সব উৎসবের যেকোনো একটিকে উপলক্ষ করে ঘুরে যেতে পারেন এসবুরি। আর আপনি যদি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন তবে আপনার জন্য একটি আদর্শ শহর শ্রুসবুরি। 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status