ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

ভারতীয় রাজনীতিতে দখিনা হাওয়ার পরশ

জয়ন্ত চক্রবর্তী

(১ বছর আগে) ২২ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৯:৩০ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

mzamin

ভারতীয় রাজনীতিতে দখিনা হাওয়ার পরশ পণ্ডিত জওহরলাল নেহ্রুর হাত দিয়েই প্রবেশ করে, স্বাধীনতার পরে। তার আগে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আর হাঙ্গেরির সেবিকা এমিলি শেঙ্কল এর প্রেমকাহিনীর কথা আমরা জেনেছি


ঊনিশশো বাহান্ন সালের কোনো একটা সময় সেটা। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন এডউইনা মাউন্টব্যাটেন। ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অর্ধাঙ্গিনী। হাসপাতালের বাইরে লন্ডনের বাতাসে তখন বসন্ত এসে গেছে। চেরি আর মোপেল গাছগুলো পল্লবিত হয়েছে। লন্ডন এর ফিশ অ্যান্ড চিপস এর স্টোরগুলোতে ভিড়। লেডি মাউন্ট ব্যাটেন তার রোগপাণ্ডুর কাঁপা কাঁপা হাতে জীবনের সেরা গুপ্তধন তুলে দিলেন স্বামী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হাতে- পণ্ডিত জওহরলাল নেহ্রুর লেখা একাধিক প্রেমপত্র। 

লেডি মাউন্টব্যাটেন সেদিন বলেছিলেন, আমার জীবনের গোপন সম্পদ তোমার হাতে দিয়ে গেলাম, ভালো জায়গায় রেখে দিও। স্ত্রীর প্রেমপত্র হাতে নিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেন সেদিন কী বলেছিলেন? তিনি কী অন্য পুরুষের মতো ঈর্ষাকাতর হয়েছিলেন নাকি স্ত্রীর প্রেমের স্মারক দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন? না, দু’টির কোনোটাই তিনি করেননি। স্ত্রীর হাত দু’টো ধরে বলেছিলেন, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল আর তোমার প্রেমের সম্পর্ক আমার অজানা নয়।

বিজ্ঞাপন
ভালো লাগলো তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে, আস্থা রাখলে দেখে। তোমাদের প্রেমকে বরাবরই সম্মান জানিয়েছি, শ্রদ্ধা করেছি। নেহ্রু আর তোমার প্রেম ঈশ্বর প্রদত্ত ছিল। আমি কোনোদিনই এই প্রেমকে ঈর্ষা করিনি। অনেকদিন পরে লর্ড ও লেডি মাউন্টবাটেন এর কন্যা পামেলা মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন, পেন্টনিক লাভ ছিল তাঁর মা এবং পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মধ্যে। পরস্পরকে সম্মান, কাজের প্রতি সমীহ আর ভালোবাসার বিচ্ছুরণ ছিল তাদের সম্পর্কে। কাম গন্ধহীন সম্পর্ক কী নারী-পুরুষের মধ্যে হতে পারে? পামেলা লিখেছেন, আমি আমার ছোটবেলায় এমন কিছু দেখিনি। শুধু মনে আছে, পণ্ডিতজি আমার মায়ের কথাতেই ব্যাটন হোলে গোলাপ ফুল রাখতেন। পরে এটি তাঁর সিগনেচার হয়ে যায়। সেই গোলাপের সৌন্দর্য ছিল, গোলাপ কাঁটায় বিদ্ধ হতো না কেউ, আমার বাবাও নয়। বস্তুত হাসপাতালে শুয়ে এড উইনা মাউন্টব্যাটেন স্বামীর হাতে যে প্রেমপত্র তুলে দিয়েছিলেন, তার ছত্রে ছত্রে ছিল নেহ্রুর পাণ্ডিত্য  আর রসবোধ। তাই বিশ্বসাহিত্যে অমর হয়ে আছে এই প্রেমপত্র।


ভারতীয় রাজনীতিতে দখিনা হাওয়ার পরশ পণ্ডিত জওহরলাল নেহ্রুর হাত দিয়েই প্রবেশ করে, স্বাধীনতার পরে। তার আগে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আর হাঙ্গেরির সেবিকা এমিলি শেঙ্কল এর প্রেমকাহিনীর কথা আমরা জেনেছি। রোগশয্যায় সুভাষকে আরোগ্য করার ব্রত নেওয়া এমিলি যেদিন সুভাষ এর কাছ থেকে একগুচ্ছ রডোডেনড্রন উপহার পেয়েছিলেন সেদিনই কী  বুঝেছিলেন প্রেমের উন্মেষ এর? মহা বিদ্রোহী সুভাষ পরে এমিলিকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। রাজনীতির কারবারিদের মধ্যে প্রেম এইভাবেই আসে নীরবে। কেউ এই প্রেমের ডাকে সাড়া দেন, কেউ দেন না। কিন্তু কিউপিড তীর ছুড়েই চলে। অব্যর্থ তার লক্ষ্য. রাজনীতিবিদরাও তো মানুষ। পাবলিক ফিগার বলে তাঁরা প্রেম করতে পারবেন না- এমন কোনো দিব্যি দেওয়া নেই। তাই প্রেম এসেছে বারবার, দেশে এবং বিদেশেও। কে যেন বলেছে- প্রেম দুর্নিবার। কোনো যুক্তি মানে না, বোধ মানে না, মানে না বয়সও. আজ বরং ভারতীয় রাজনীতির কিছু বহু আলোচিত প্রেমের কাহিনী নিয়ে চর্চায় আসা যাক।

 

 


নেহ্রু-এডউইনা প্রেমের কাহিনী পল্লবিত হওয়ার কয়েক দশক পরে নেহ্রুর দৌহিত্র রাজীব গান্ধীর প্রেমকাহিনী অনির্বাণ হয়ে আছে। রাজীবকে কেমব্রিজে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। পড়াশোনায় তেমন মেধাবী না হলেও কাজ চালানোর মতো রেজাল্ট করতেন রাজীব। সুদর্শন হিসেবে তার নামডাক ছিল। এই সময়ই একটি গেট টুগেদার এ ইতালির ওরবাসামার মেয়ে নিল নয়না সুন্দরী সোনিয়া মাইনোকে দেখেন রাজীব। লাভ আট ফার্স্ট সাইট বলতে যা বোঝায় তাই হলো। ভীরু ভীরু পদক্ষেপে  রাজীব আর সোনিয়া ডেটিং শুরু করলেন কেমব্রিজ এর কাছে একটি গ্রিক রেস্তোরাঁয়। ওটিই ছিল তাদের মিটিং পয়েন্ট। অনেক পরে ওই গ্রিক রেস্তোরাঁর মালিক অ্যান্টোনি বলেছিলেনÑ এই রকম ভীরু প্রেম আমি আর দেখিনি। সোনিয়ার হাতের আঙ্গুল ছুঁতে রাজীব তিন মাস সময় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি একবার লন্ডন এ এলেন কাজে। রাজীব সেই সুযোগটি নিলেন। সোনিয়ার সঙ্গে মায়ের আলাপ করিয়ে দিতে হবে। সোনিয়াকে নিয়ে রাজীব গেলেন ভারতীয় হাইকমিশন এ। প্রথম দেখাতেই ইন্দিরার মন জয় করলেন সোনিয়া। সোনিয়া সেদিন যে ড্রেসটা পরে গিয়েছিলেন তার একটা কোণ ছিল ছেঁড়া। ইন্দিরা সেদিন পাশের ঘর থেকে সুঁই সুতো এনে নিজে হাতে সস্নেহে সেলাই করে দিয়েছিলেন সোনিয়ার পোশাক। রাজীব বুঝেছিলেন তিনি অনুমোদন পেয়ে গেছেন। এরপর রাজীবকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।  রাজীবকন্যা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী অবশ্য এতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না। বস্তুত, সোনিয়া গান্ধী-রাজীব গান্ধীর মেয়ে বলে কেউ তাকে প্রপোজ করার সাহস পেতো না। সেই সাহসটা দেখিয়ে ফেললেন রবার্ট ওয়াধেরা নামের এক যুবক। রবার্ট তখন পারিবারিক ব্যবসা পিতলের কারবার আর কৃত্রিম গহনা তৈরির ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। দিল্লির ইতালিয়ান হোম এ দেখা হওয়ার পর ডাকাবুকো রবার্ট এর প্রপোজ করাও হয়ে গেছে। রবার্ট দামি দামি অ্যান্টিক গহনা উপহার দিতেন প্রিয়াঙ্কাকে। এক সন্ধ্যায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, আমাদের সম্পর্ক যেন একদিন অ্যান্টিক ভ্যালু পায়। ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয়নি রবার্ট এর। বিয়ে করে নেন তিনি প্রিয়াঙ্কাকে।

 


সাহস দেখিয়েছিলেন আর একজন. কংগ্রেসের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ডিগগির রাজা দিগি¦জয় সিং। দিগি¦জয় এর স্ত্রী বেঁচে থাকতেই, সন্তানরা যথেষ্ট পরিণত হওয়ার পরই টিভি সঞ্চালিকা অমৃতা রাই এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে দিগি¦জয়ের। অমৃতা তখন ন্যাশনাল টেলিভিশন ছেড়ে রাজ্যসভা টিভি’র অ্যাঙ্কর-সাংবাদিক। কাজে কর্মে অমৃতাকে প্রায়ই যেতে হতো দিগি¦জয়ের কাছে। সাতশট্টির দিগি¦জয় প্রেমে পড়লেন অমৃতার। অমৃতা তখন সবে চল্লিশ পার। বিবাহিতা। দু’জনের প্রেমের গুঞ্জন ঝড় তুললো সংসদের ক্যান্টিনে। এরই মধ্যে দিগি¦জয়ের পত্নী বিয়োগ হলো। অমৃতার হলো ডিভোর্স। সব প্রতিকূলতা জয় করে দুইহাজার পনেরোর সেপ্টেম্বরে বিয়ের কথা ঘোষণা করলেন অমৃতা-দিগি¦জয়। তারা এখনও সুখী বিবাহিত দম্পতি। দিগি¦জয় এর ছেলেদের বয়স প্রায় অমৃতার সমান। তাতে কিছু আসে যায় না। প্রেমের ফাঁদ পাতা আছে ভুবনে। তাতে কখনও ধরা পড়ছে সাধারণ মানুষ, কখনও রাজনৈতিক সেলিব্রিটিও। প্রেম এমনই অমোঘ, অনিবার্য। আর এই অনিবার্যতার কারণেই সম্ভবত ইউপিএ আমলের তরুণ মন্ত্রী শশী থারুর মন্ত্রী পদ হারিয়েও প্রেমের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন। কেরালার এই কংগ্রেস মন্ত্রী প্রেমে পড়েন বিজনেস ওম্যান সুনন্দা পুস্করের। সুনন্দার যৌবন গরিমায় আচ্ছন্ন হন একদা কলকাতার বাসিন্দা, রাষ্ট্রসংঘে উচ্চপদে চাকরি করা শশী থারুর। শশী সুনন্দাকে সুবিধা পাইয়ে দিছেন এই অভিযোগে মন্ত্রীপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু রাজত্ব গেলেও রাজকন্যাকে ছাড়েননি শশী। ২০১০সালে কেরালার পালকাদ-এ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শশী। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সুনন্দা পুস্করের প্রাণহীন দেহ উদ্ধার হয় দিল্লির লীলা কেম্পনিসকি হোটেলে। খুন নাকি দুর্ঘটনা কে জানে! বিস্তর জল ঘোলা হয় ব্যাপারটা নিয়ে। সন্দেহের তির শশীর দিকে ছিল। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট শশীকে অব্যাহতি দিয়েছে। সুনন্দা পুস্কর দিল্লির ককটেল সার্কেল এ পরিচিত নাম ছিলেন। তার এই পরিণতি দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু প্রেম অবিনশ্বর। তাই আজও শশী সুনন্দার জন্মদিনে কেক কাটেন, মোমবাতি জ্বালান।
প্রেমের কেতন উড়েছে কংগ্রেস নেতা প্রয়াত রাজেশ পাইলট এর পুত্র শচীন এর ক্ষেত্রেও। সুদর্শন শচীন লন্ডনে পড়াশোনা করতে যান। সেখানেই তার আলাপ হয় তদানীন্তন জম্মু-কাশ্মীর এর মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লাহর কন্যা সারার সঙ্গে। লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাস, ট্রাফলগর স্কোয়াড এর পায়রারাও জেনে যায় এই প্রেমকাহিনী। শচীন হাবুডুবু খাচ্ছে কাশ্মীর কন্যার প্রেমে। এই খবর ভারতে এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে দুই পরিবারেই প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ওই যে কবি লিখেছেন- প্রেমের জোয়ারে ভাসবো দোঁহারে, বাঁধন খুলে দাও....।      
সব বাঁধন খুলে গেল। দুইহাজার চার এর জানুয়ারিতে বিয়ে করলেন শচীন - সারা। এখনও তাঁরা সুখী দম্পতি। দাম্পত্য সুখী করেছে অখিলেশ যাদব ও ডিম্পল যাদবকে। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ বছর তেরো আগে লক্ষেèৗ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম দেখেন ডিম্পলকে। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট? হতেও পারে অস্ট্রেলিয়া ফেরত স্মার্ট মেয়েটিকে মনে ধরে আখিলেশ এর। লক্ষেèৗ শহরের ইমামবাড়া থেকে শুরু করে চিকনের শাড়ির দোকান সাক্ষী হয়ে আছে এই উদ্দাম প্রেমের। অখিলেশ এর মাথার লাল টুপিটা পর্যন্ত পছন্দ করে কিনে দিতেন ডিম্পল। পরে মুলায়ম সিং যাদবের পুত্রবধূ হন ডিম্পল। হন সাংসদও।  ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এই প্রেমকাহিনীগুলোই ভাস্বর হয়ে আছে। এর বাইরে কী খুচরো প্রেম নেই? আছে, ছিল এবং থাকবে। জেলবন্দি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি ভালোবাসা দৈহিক আকর্ষণ হতে পারে, কিন্তু তাতো একধরনের প্রেমই। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ঘর বাড়ি স্বজন স্ত্রী, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সবতো ছেড়েছেন এই প্রেমের জন্যেই। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেম তাকে অন্য মানুষে পরিণত করেছে। নীতিবাগিশরা যতই রে রে আওয়াজ তুলুন আসল প্রেমের কাছে সবই অকিঞ্চিৎকর। সাম্রাজ্য ত্যাগ করা যায় বোধহয় প্রেমের জন্যে। কে যেন প্রেমিকার গালের তিলের জন্যে সমরখন্দ দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? 

 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status