ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

মহেঞ্জোদারোর পথে

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন

(২ বছর আগে) ২২ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

mzamin

আমরা গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম। ছোট বড় প্রাসাদসম সমাধিগুলো ইন্দো-পারস্য স্থাপনার আদলে স্যান্ড স্টোনের তৈরি। আর কিছু সমাধি অতীব সাধারণ। এই দশ বর্গ কি.মি. একেবারেই সবুজহীন ধূসর প্রান্তর। প্রথমেই আটকোণ বিশিষ্ট যার সমাধি সৌধ দেখলাম সেটি হলো সুলতান ইব্রাহিম-এর। ইনি দিল্লির নয় ইনি এখানকার মানে সিন্ধুর গভর্নর ছিলেন, রাবা ইয়া খান তারখান যিনি সম্রাট আকবরের সিন্ধু অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন

পৃথিবীর বহু জায়গায় এমন কি দেশের মধ্যেও আমরা সমমনা বেশ কয়েকজন ঘুরেছি এবং ভবিষ্যতে ও ঘুরবার আশা পোষণ করি। আমাদের এ ভ্রমণ গোষ্ঠীটি প্রায় প্রতিদিন সকালের নির্মল আড্ডা আর প্রাতঃরাশের সংগঠক প্রখ্যাত চিত্র প্রযোজক ও ব্যাবসায়ী জনাব হাবিবুর রহমানকে ঘিরে। ভ্রমণের ব্যাপারে তার কখনো অনীহা নেই। ২০১৯ সালে এমনই এক ভ্রমণে আমরা গিয়েছিলাম ইরানে পারস্য সভ্যতার কিছু নির্দশন দেখতে। গিয়েছিলাম পারসে পোলিস, দারাইউস দি গ্রেট-এর রাজধানী আর সাইরাস দ্যা গ্রেট-এর বিখ্যাত সমাধি দেখতে।

 


সেখানেই হাবিবুর রহমানের প্রশ্ন কোন সভ্যতা পুরাতন ‘পারস্য না সিন্দু সভ্যতা’? বলেছিলাম, সিন্ধু সভ্যতা ৪০০০ হাজার বছরের পুরাতন। বললেন, তাহলে আমরা মহেঞ্জোদারো হরপ্পা কেন দেখবো না? বললাম ও দুটো তো পাকিস্তানে আপনি কি যাবেন ও সব জায়গায়? পাকিস্তানে হলেও যাবো কারন ওটাতে আমাদেরই সভ্যতা-দ্রাবিড়দের।
সেই থেকে প্রায় তিন বছর নানা ধরনের পরিকল্পনা করে অবশেষে আমরা পাকিস্তানের এককালের রাজধানী, আমার শৈশব হতে বেড়ে ওঠার শহর, করাচিতে এসে পৌঁছলাম। প্রাথমিকভাবে সিন্ধু আর পাঞ্জাবের এই দুই পুরাকীর্তির শহর হলেও আমাদের ১৪ জনের মধ্যে ৯ জনের জন্য পাকিস্তান এই প্রথম। তাই করাচি হতে উত্তরে চীন-পাক সীমান্ত খুলজরামো গিরিপথ (১৬০০০ ফুট) পর্যন্ত কারাকোরাম হাইওয়ে ও সিল্করুট হয়ে সড়ক পথে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে করাচিতে দু’রাত কাটিয়ে হোটেল ছাড়তে আর বের হতে হতে প্রায় সাড়ে নয়টা। আমাদের গন্তব্য হায়দ্রাবাদ, পাকিস্তানের তথা সিন্ধু প্রদেশের অন্যতম শহর। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে করাচি হতে হায়দ্রাবাদে যেতে লাগে ৪ ঘণ্টার কাছাকাছি সময়। কিন্তু আমরা সরাসরি হায়দ্রাবাদ যাচ্ছি না। আমরা ন্যাশনাল হাইওয়ে-৫ ধরে প্রথমে যাবো ঠাট্টা- সেখান হয়ে হায়দ্রাবাদে রাত কাটাবো। করাচি শহর হতে ঠাট্টা যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগবার কথা।
করাচি হতে বের হবার আগে সারতাজ, আমাদের গাইড, আমাদেরকে কালাপুল এবং তৎসংলগ্ন গোরা কবরস্থান বা ‘সাদা কবরস্থান’ মানে এখানে খ্রিস্টান কবরস্থান দেখাব। কারণ এটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী কবরস্থান। এই কবরস্থানের ইতিহাসের সাথে করাচির গোড়পত্তনের ইতিহাস জড়িত। অনেকটা কলকাতার নর্থ পার্ক স্ট্রিট খ্রিস্টান কবরস্থানের মতো। 

 


জায়গা দুটি আমিই দেখতে চেয়েছিলাম কারণ আমার শৈশবে মালিরের বাসা হতে স্কুলে আসবার ও যাবার পথে এ দুটি জায়গা অতিক্রম করতে হতো। এই দুই জায়গাতেই ছিল ‘বাস স্টপ’। ‘কালা পুল’ বা ‘কালা সেতু’, মূলত এটি ছিল ছোট একটি লোহার পুল যার নিচ দিয়ে ট্রেন লাইন চলে যেত এখনও যায়। রং কালো ছিল বলে বোধ হয় কালা পুল নামেই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এখন এখানে একটা ছোটখাট ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে। জায়গাটি এখন চিনবার উপায় নেই। কালাপুলের একটু সামনেই বিখ্যাত ‘গোরা কবরস্থান’। কবরাস্থানে প্রথম কবরটির গায়ে লেখা ১৮৪৩ হলেও পত্তন হয় ১৮৪৫ সালে। প্রায় ২০ একরের উপর বিস্তীর্ণ এই সমাধিগাহ। এখন দেয়াল দিয়ে ঘেরা, বেশ পরিচ্ছন্ন কোথাও পড়েছিলাম যে ২০০২ সালে সন্ত্রাসীরা একজন আমেরিকান সংবাদকর্মীকে জিম্মি করেছিল পরে তার মৃতদেহ এই কবরস্থানে পাওয়া যায়। তার নাম ছিল ড্যানিয়েল পার্ল। ওই সময় পাকিস্তান ছিল ভয়াবহ সন্ত্রাসী জঙ্গীদের কবলে।
করাচির এই দুই জায়গা দেখে আমরা পাকিস্তানের অন্যতম ডিফেন্স সোসাইটি ছেড়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫ ধরলাম ঠাট্টার পথে। প্রায় আধা ঘণ্টা লাগলো করাচির  শহরতলীগুলো পার হতে। এসব রাস্তা বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের দিকে তৈরি হয়েছিল। আমার পরিষ্কার মনে আছে যে মালির ফার্মের পূর্বদিক দিয়ে যখন নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছিল তখনই শুনেছিলাম হায়দ্রাবাদকে যুক্ত করবার জন্য এ রাস্তা। তখন পাকিস্তানে ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের শাসনামল। 
প্রায় ঘণ্টা খানেক চলবার পর আমরা করাচির শেষ উপশহর পার হবার পথে। রাস্তার ধারের বাড়িঘর আর দোকানপাট বলে দেয় এখানে বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের বাস। রাস্তার পাশে বেশির ভাগ দোকানপাটই লোহা-লক্কর, বাতিল দ্রব্যাদি এবং লেদ মেশিনের। বাসস্থানগুলো জানিয়ে দেয় যে এখানকার সিংহভাগ বাসিন্দাই কথিত মোহাজের।
১৯৪৭ ভারত  ভাগের পর বর্তমানের ইন্ডিয়া হতে আগত, মূলত উর্দূ ভাষাভাষীরাই মোহাজের নামে পরিচিত। এদের সিংহভাগ এসেছে দিল্লি, উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন শহর ও অঞ্চল হতে। এদের ৯০ ভাগ করাচিতেই বসবাসরত তাই করাচিকে মোহাজেরের শহর বলা যায়। এক সময় ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত বাঙালিরা ছিল মোহাজেরদের পরেই বৃহত্তর গোষ্ঠী। আজও করাচিতে প্রায় ৩০ হাজার বাংলা ভাষাভাষী বসবাসরত। তবে এরা এখনো নাগরিকতত্ব পায়নি।
বলছিলাম মোহাজেরদের কথা। এই উর্দূ ভাষাভাষীরাই, উত্তর ভারত হতে উর্দূ নিয়ে এসেছিল করাচি তথা পাকিস্তানে। এরাই এই ভাষাকে জিইয়ে রেখেছিল। আজ উর্দু উপমহাদেশ তথা দুনিয়ার অন্যতম ভাষা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যদি পাকিস্তানে বহু অঞ্চলে উর্দু বলার মানুষ কম। স্মরণযোগ্য যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুভাষী ছিলেন না। তিনি উর্দু বললেও তেমন লিখতে পারতেন না। উর্দু ভাষার জোর সমর্থক ছিলেন নবাব লিয়াকত আলী খান এবং অন্যন্যরা।
এখনও ভারতের কয়েকটি রাজ্যে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা। একদা মোগল সৈনিকদের মধ্য হতে জন্ম নেয়া উর্দুভাষা দ্রুত উপমহাদেশের অন্যতম ভাষায় পরিণত হয়। এটি হিন্দুস্তানি ভাষা। আর এই উর্দুর বর্জনের কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত হয়। সংঘটিত হয় ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন আর চূড়ান্তভাবে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। উর্দু পাকিস্তানি নয় হিন্দির পাশাপাশি হিন্দুস্তানের ভাষা। 
আমরা যে রাস্তা ধরেছি সে রাস্তাটি চারলেনের। সড়ক দ্বীপে নানা ধরনের হোর্ডিং বেশিরভাগই রাজনৈতিক। পাকিস্তানের ৩টি প্রধান রাজনৈতিক দলেরই পতাকা শোভা পাচ্ছে, মোহাজির কওমী ম্যুভমেন্ট (এমকিউএম), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। 
মাত্র গতকাল সারতাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে করাচির এমন দুর্দশা কেন? এখনকার করাচি মনে হয় হতদরিদ্র হয়ে রয়েছে। আমার দেখা সেই মোহনীয় শহর করাচি এখন নেই। উত্তরে সারতাজ বলেছিলেন এখন করাচির অভিভাবক নির্ণয় করা কষ্টকর। সরকার পিপিপি-এর, মেয়র এমকিউএম এর আর শহরের পাঁচ এমপিএ পিটিআই-এর। কাজেই ধাক্কাধাক্কি। ‘করাচি কিসিকা নেহী’ বলেছিলেন সারতাজ।
চায়ের আর কিছুক্ষণের বিরতির জন্যে থামলাম। গাড়ি থেকে নামতেই সামনে দেখলাম আমার শৈশবের দেখা সেই গাধার গাড়ি। গাধাটি গাড়ির সামনে বাঁধা। গাধাটি চুপচাপ দাঁড়ানো। চালক জীর্ণ শীর্ণ ময়লা কাপড় পরা পাশে দাঁড়ানো। আমি দাঁড়িয়ে ছবি উঠালাম। আমাদের অনেকেই গাধার গাড়ির সাথে দাঁড়িয়ে ছবি উঠালেন। আমার সফরসঙ্গীদের জন্য এটি এক অদ্ভুদ গাড়ি। আমার কাছে শৈশবের স্মৃতি যখন করাচীর মত শহরে এ গাড়ি মাল টেনে ছুটে চলত। এ গাড়ি এই রেস্তরাঁ হতে ডেকচি ভরে বিরিয়ানি নিয়ে যাবার অপেক্ষায়। হয়তো কোনো বিয়ে বাড়ির জন্যে নির্ধারিত। সবাই বিস্ফোরিত চোখে এমন অদ্ভুত গাড়িটি দেখছিলেন। প্রায় ঘণ্টা খানেক কাটালাম এই রেস্তরাঁতে। রওয়ানা হলাম ঠাট্টা-এর পথে। 
রাস্তার দু’পাশ বিস্তীর্ণ প্রায় মরু অঞ্চল। যদিও করাচির প্রান্তর বাড়ছে তবে ছোট ছোট শহর এবং তার পাশাপাশি কিছু নতুন শিল্পাঞ্চল তৈরি হবার পথে। নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠছে যার নাম বিন কাসেম টাউন। আরও কিছুদূর যাবার পর প্রথমবারের মতো টোল প্লাজায় থামল। রাস্তার টোল দিয়ে পুনরায় রওয়ানা হলাম। পার হলাম ছোট একটি খারের মতো। পানি নেই বলা যায়। রাস্তার দু’ধারে সবুজের (নালা) কোনো চিহ্ন নেই শুধুমাত্র কাঁটাসহ বাবলা গাছ, যার স্থানীয় নাম কিক্কর। আর কিছু চোখে পরলনা। গাছটি উটের প্রিয় খাদ্য। বলা হয়ে থাকে এ গাছের কাঠ লোহার মতো শক্ত। গরুর গাড়ির চাকা বানাতে কাজে লাগে। দু’পাশে ধূ ধূ মরু প্রান্তর। দূরে একটি গ্রাম হয়তো সেদিকেই যাচিছল সারিবদ্ধভাবে চার পাঁচটি উট। ক্রমেই আবহাওয়া গরম হয়ে উঠছে।
আমরা ঘারো নামের একটা ছোট শহরের মতো জায়গা পার হলাম। করাচি থেকে রওয়ানা হয়েছি প্রায় ৩ ঘণ্টা। এখন বারোটার উপরে আর ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা ‘ঠাট্টা’ সিন্ধুর পরিত্যক্ত পুরাতন শহর এবং শহরের ভগ্নস্তূপ ‘মাকলি’তে পৌঁছবো। জীবনে প্রথম ‘ঠাট্টার মাকলি ঐতিহাসিক পরিত্যক্ত শহর দেখেছিলাম, তখন স্কুলে পড়ি। এখানে মোগল এবং মোগলদের আগের দিল্লির প্রতিনিধি গভর্নরদের বাসগৃহ, মসজিদসহ দোকানপাট আর বিশাল সমাধি ক্ষেত্র রয়েছে। এখানকার ভগ্নস্তূপের মধ্যে রয়েছে সিন্ধু অঞ্চলের প্রথম মসজিদ। আমরা মাকলিতে পৌঁছলাম। দুপুরের সূর্য তেঁতে উঠেছে। হাওয়াটা গরম। মরু অঞ্চলে এ হাওয়ার নাম লু।
আমরা পাঁচ-ছয় জন নামলাম। তানভীর, শমসের, ফারুক, আমানুল্লাহসহ কয়েকজন টিকিট নিয়ে প্রবেশ করলাম। আগে ঘেরা দেয়া ছিল না, ছিল না টিকেটের ব্যবস্থা। হেঁটে দেখা সম্ভব নয় কারণ সম্পূর্ণ জায়গাটি বিস্তীর্ণ। এ স্থানটি মোগলদের আগে তিনটি শাসকগোষ্ঠীর রাজধানী ছিল। পরে মোগলদের শাসন শুরু হলে এখানে পালা করে গভর্নররা ছিলেন। ১৪ হতে ১৮ শতাব্দী পর্যন্ত বেশ রমরমা ছিল। এ শহর পরে বিশাল সমাধি ক্ষেত্রে পরিণত হয়। প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা। তথ্যে প্রকাশ প্রায় ৫ লক্ষ সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে প্রাসাদ যেমন রয়েছে তেমনি আমীর ওমরাদের সমাধিও রয়েছে। অনেক নামী-দামি ব্যক্তি এবং শাসকদের কবরও রয়েছে।
আমরা ভিতরে প্রবেশ করে পেলাম প্রায় ৮ জন বহন করতে পারে ব্যাটারিচালিত গাড়ী। ২০০০ রুপি দিয়ে ঠিক করা হলো আমাদেরকে মাকলির মাঝামাঝি দরবেশ হযরত শেখ বাবা ইয়া লাঙ্গোটির মাজার নিয়ে যাবে এবং ফেরত নিয়ে আসবে। এখানকার বেশিরভাগ সমাধি সৌধগুলো ওই সময়কার দিল্লি হতে নিয়োজিত সিন্ধুর শাসক বা গভর্নরদের। 
আমরা গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম। ছোট বড় প্রাসাদসম সমাধিগুলো ইন্দো-পারস্য স্থাপনার আদলে স্যান্ড স্টোনের তৈরি। আর কিছু সমাধি অতীব সাধারণ। এই দশ বর্গ কি.মি. একেবারেই সবুজহীন ধূসর প্রান্তর। প্রথমেই আটকোণ বিশিষ্ট যার সমাধি সৌধ দেখলাম সেটি হলো সুলতান ইব্রাহিম-এর। ইনি দিল্লির নয় ইনি এখানকার মানে সিন্ধুর গভর্নর ছিলেন, রাবা ইয়া খান তারখান যিনি সম্রাট আকবরের সিন্ধু অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তারখান ছিলেন দিল্লির সুলতানদের সময়কার তুর্কমান যোদ্ধাদের উত্তরসূরী। ইসাশান তারখান সমাধি সৌধটিই ছোটখাট প্রসাদের মতো। এই অষ্টকোণ সমাধি সৌধের মাঝখানেই সুলতান ইব্রাহিমের সমাধি। এর পরে দেখলাম ইসা খান তারখান এর সমাধি।
ঈসা খান তারখান প্রথমে গুজরাটের গভর্নর ছিলেন বহুদিন। পরে তিনি সিন্ধুতে আসেন। ঠাট্টা তখন সিন্দুর রাজধানী। এমনি আরও কয়েকটি প্রাসাদসম সমাধি রয়েছে এই মাকলি এলাকায়। এই সম্পূর্ণ সমাধি ক্ষেত্র এখন ইউনেস্কো ওয়ার্র্ল্ড  হেরিটেজ সাইট। এরই মধ্যে ধূ ধূ মরু প্রান্তরে রৌদ্রের তাপ বাড়া শুরু হযেছে। ঠাট্টায় আমাদের সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে বের হয়ে গাড়িতে চাপলাম। এখন দুপুরের খাবার খেতে রেস্তরাঁ খুঁজে বের করতে হবে। সারতাজকে বলা হলো যে দুপুরের খাবারের জায়গা বের করতে।
বেশ কয়েক কিলোমিটার গিয়ে হাইওয়ে ছেড়ে সরু রাস্তা দিয়ে চললো। আমাদের পরিবর্তিত চালক সাত্তার আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন করাচি হতেই। সারতাজকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। সারতাজ জানালেন যে কাছেই এই অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ হ্রদ রয়েছে এবং এর পাড়ে বেশকিছু রেস্তরাঁ থাকলেও সিন্ধু ট্যুরিস্ট কর্পোরেশন-এর রেস্তরাঁ রয়েছে যেখানে লেকের মাছ পাওয়া যায়, মিষ্টি পানির মাছ। সেখানেই আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা হবে। লক্ষ করলাম করাচি ত্যাগ করবার পর হতেই আমাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ভ্যান জুটেছে আমাদের বহরে।
কিছুক্ষণ পর আমরা দেয়ালে ঘেরা একটি কম্পাউন্ডে আসলাম। দু’পাশে বেশকিছু রুম রয়েছে সামনে বিশাল এলাকা জুড়ে পানির আঁধার এর নাম ‘কিনজার লেক’ বা কিনজার হ্রদ। আমরা নামলাম। সারতাজ আমাদেরকে রেস্তরাঁর নিচতলায় নিয়ে আসলেন। সামনে বিস্তৃত এই বিশাল হ্রদ দেখা যায়। পাড়জুড়ে লম্বা লম্বা নল খাগড়ার বন। ঘাটে কয়েকটি স্পিডবোট বাঁধা রয়েছে। জায়গাটি সত্যই সুন্দর তবে খদ্দের হিসেবে আমরা ১৬ জন আর একটি ছোট পরিবার রয়েছে।  সবাই যার যার মতো অর্ডার দিলেন। রেস্তরাঁর ম্যানেজার জানালেন যে, কোরাল মাছ যা এখানে ভেটকি নামে পরিচিত আছে খেতে চাইলে সম্পূর্ণ মাছটি ভেজে দিতে পারে তবে কিছুটা সময় লাগবে। তথাস্ত বলে সায় দেয়া হয়। কিছুক্ষণ পর একটি মাঝারি আকারের মাছ এনে দেখালো। এই মাছটিই আমাদের জন্যে তৈরি করা হবে। বসে রইলাম অপেক্ষায়। একটু হেঁটে বাইরের বারান্দায় গিয়ে হ্রদের আয়তন অনুমান করবার চেষ্টা করছিলাম। 
কিনজার হ্রদ, মিঠা পানির সবচাইতে বড় হ্রদ। এখান হতেই হায়দ্রাবাদসহ করাচিতেও সুপেয় পানি এ অঞ্চলের সরবরাহ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ২৫ কি.মি. এবং প্রস্থ ৬ কি.মি.। শুধু সুপেয় পানিই নয় মূলত এখান হতেই মিঠা পানির মাছের সরবরাহ হয় করাচির মার্কেটে বিশেষ করে করাচীর এমপ্রেস মার্কেটে। ছোট বেলায় করাচিতে থাকাকালে রুই থেকে শুরু করে কোরাল মাছ পেতাম। বাজারে নয় ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমেই বাসার সামনেই পাওয়া যেতো।
প্রায় ২ ঘণ্টার মতো আমরা এখানেই কাটালাম। খাওয়া শেষ করে আমরা রওয়ানা হলাম হায়দ্রাবাদের পথে। সূর্য তখনো দারুণ উত্তাপ ছড়িয়ে চলছে। আমরা যখন হায়দ্রাবাদের হোটেলে পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবে গিয়েছে। আমরা  হায়দ্রাবাদের ইনডাস হোটেল’-এ এসে পৌঁছলাম। হোটেলটি তিন তারকা। এই হোটেল পরিচালিত হচ্ছে সিন্ধু পর্যটন কর্পোরেশানের মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা এতদঅঞ্চলের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে। আমরা নিচতলা আর উপরতলায় স্থান নিলাম। রুমে প্রবেশ করে দেখলাম শোবার খাট যে এত উঁচু যে উঠে বসতেই কষ্ট হচ্ছিল। কিছু সময়ের মধ্যে আমরা রাতের খাবারের জন্যে হোটেল রেস্তরাঁতেই গেলাম।
হায়দ্রাবাদ নামে ভারতে একটি রাজ্যের শহর রয়েছে। অবশ্য এখন সে রাজ্য দু’ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের এ শহর বর্তমান সিন্ধু প্রদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এককালের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী ছিল যার পত্তন হয়েছিল ১৭৬৮ সালে মিয়া গোলাম শাহ কালহোরোর হাতে তিনি ছিলেন কালহোরো বংশের শাসক। পরে ১৮৪০ সালে সিন্ধুর এ শহর হতে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে সিদ্ধুকে যুক্ত করলে এ শহর রাজধানীর মর্যাদা হারায়। পরে করাচি সিন্ধুর রাজধানী হলে হায়দ্রাবাদের মর্যাদা কমে যায়।
আমি এই শহরে এসেছিলাম যখন স্কুলে পড়ি। তখন রাস্তা ঘাটগুলো এত উন্নত ছিল না। এসেছিলাম ট্রেনে। গত ষাট বছরে অবশ্যই অনেক উন্নত হয়েছে বটে। এখানে বেশ উঁচুতে একটি দুর্গ রয়েছে। যার নাম ‘প্যাকো কিলা’। আমার কামরাটির পেছনে ছোট একটি বেলকোনি রয়েছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ‘কত কত’ করে একটা আওয়াজ হয়েছিল বাইরে উঁকি মেরে দেখলাম আমার বেলকোনি থেকে উড়ে গিয়ে পাশের রুমের বেলকোনির উপরে বসা একটি ময়ুর। এখান থেকে নিচে একটি সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত বেশ পরিসরের আঙিনা রয়েছে যার তিনদিকেই একতলা টানা রুম রয়েছে। এখানেও অনেক অতিথিরা থাকেন। 
রাতের খাবার খেয়ে শুতে যাবো তখন আমানুল্লার ফোন পেলাম যে হাবিব খান সাহেব কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি তাদের রুম পৌঁছলাম। আমানুল্লাহ আর হাবিব খান শুরু থেকেই একই রুমে থাকছেন। তড়িঘড়ি করে রুমে আসলাম। একটু চিন্তিত ছিলাম এই সময় কারও অসুস্থ হওয়া খুব ভালো কথা নয়। গুরুতর কিছু হলে আমাদের সফরে অবশ্যই ছেদ পড়তে পারে। অবশ্য আমাদের সাথে আমার সহধর্মিনীসহ ডাঃ নাসরুল্লাহ রয়েছেন দু’জনেই চিকিৎসক। কাজেই তাদের মতামত তো রয়েছে। তবে রুমে পৌঁছে অনেকটাই আস্বস্থ হলাম এই শুনে যে খুব গুরুতর তেমন কিছু নয়। কিছুক্ষণ কাটিয়ে ওখানে এসে শুয়ে পড়লাম। সকালে নাস্তায় হাবিব খান বা হাবিব ভাইকে বেশ চাঙ্গাই পেলাম। পরে শুনলাম রাতে ঘুমাতে যাবার সময় উঁচু খাটের কিনারাতে বসতে গিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন। কোমরে কিছুটা ব্যথা পেয়েছিলেন।
নাস্তা শেষ করবার পর আমরা রওয়ানা হলাম মহেঞ্জোদারোর পথে। তবে সফর শুরু হবার আগেই হাবিব ভাই আমাকে বললেন যে তিনি শেওয়ান শরিফ-এ যাবেন। জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কেন হঠাৎ এই সুফি সাধকের মাজার-এ যেতে চান? ‘আপনি তো এসব জায়গায় যেতে আগ্রহী ছিলেন না।?’ বললেন যে তার খুব ইচ্ছা এই মাজার দেখার। কারণ এই জায়গা ঘিরেই উপমহাদেশ কাঁপানো সুফি সঙ্গীত ‘লাল মেরী পথে রাখিয়ো ভালা ঝুলে লালন দা, সিঙ্গরী দা, দমাদম মস্ত কালান্দার’। এ পথে গানের কারণেই তিনি দেখতে চান। অবশ্য তার এই অনুরোধে কেউই আপত্তি করেনি। সারতাজ শুধু বললেন ওখানে যাবার রাস্তাটি ভিন্ন। তবে মহেঞ্জোদারো ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। বলে রাখা ভালো হায়দ্রাবাদ ছাড়বার পর হতে আমাদের জন্য কর্তৃপক্ষ পূর্ণ পুলিশ এসকট-এর ব্যবস্থা করেছিল। কারণ আমি অনুমান করতে পারলাম যে আমরা বিদেশি সফরকারী আর অভ্যন্তরীণ সিন্ধু ততখানি নিরাপদ নয়। রাস্তায় ডাকাতির অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমরা যেসব রাস্তা ব্যবহার করছি সেগুলো জাতীয় হাইওয়ের বাইরের। তবে আমি পুলিশ এসকট-এর  কারণ অন্যদের কাছে প্রকাশ করিনি। বরং আমাদের গ্রুপ বেজায় খুশি যে তারা ভিআইপি ব্যবস্থায়  সফর করলেন। পাগলের সুখ মনে মনে।

 


বাইরের রোদের তাপ বেড়েই চলেছে। আমরা শেওয়ান শরিফের দিকে রওয়ানা হলাম। সারতাজ শেওয়ান-এর পুলিশ ফাঁড়িকে বলে  বার্তা পাঠালেন। প্রায় ৩ ঘণ্টার রাস্তা। সিন্ধুর প্রত্যন্ত অঞ্চল। প্রায় ধুসর। কিছুদূরে সিদ্ধু নদীর একটি শাখা নদী রয়েছে। তার আশেপাশে কিছু কৃষি কাজ হয় তাছাড়া প্রায় মরু অঞ্চল।  খুবই কম বসতি, যা আছে রাস্তার দু’ পাশে। আমরা ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫৫ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। শেওয়ান শরিফের পথে দু’ জায়গায় আমাদের গাড়িকে টোল দিতে হবে। টোল খুব বেশি নয়। রাস্তার পাশেই কিছু কিছু জায়গায় বসত রয়েছে, এ রাস্তাতেই আরও কয়েকজন সুফির মাজারের অস্তিত্ব থাকলেও সমগ্র উপমহাদেশে যার মাজার ‘লাল শাহবাস কালান্দার’ নামে পরিচিত তার পুরো নাম হযরত মারভান্দি ওরফে লাল শাহবাজ কালান্দার। পূর্বে উল্লেখিত গানটি গেয়ে বিখ্যাত হয়েছে বাংলাদেশের তথা উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লা।
হযরত মারভান্দির জন্ম সিসতান নামক জায়গায়। ঐতিহাসিকভাবে সিসতান বর্তমান ইরান এবং আফগানিস্তানের সীমান্তে। অবশ্য তার পূর্ব পুরুষ বাগদাদের। জন্মগ্রহণ করেন ১১৭০ সালে। পরিণত বয়সে সুফিবাদের দীক্ষা নিয়ে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য সিন্ধুর এ জায়গাতেই আস্তানা গাড়েন এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সিন্ধুর এ অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাকে ‘লাল শাহবাজ কালান্দারও’ বলা হয়। কথিত আছে যে তার গৌরবর্ণ এবং মুখের রং লাল আভায় রঞ্জিত ছিল বলে ‘লাল’ বলা হয়। ‘শাহবাজ’ মানে পবিত্র আর ‘কালান্দার’ মানে আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। তারই অনুসারী উনিশ শতকে সূফি মানকাবাত লিখেছিলেন ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ নামের সুফি গান, মানে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস আমার কালান্দারের জন্য। পরে সিদ্ধুর অন্যতম সাধক কবি, বুলে শাহ, এটাকে বিখ্যাত কাওয়ালীর রূপ দেন। সিন্ধু তথা উপমহাদেশের বিখ্যাত এই সুফির ’৯২-৯৪ বছর বয়সে ১২৭৪ সালে এখানেই মৃত্যু হয়। তাকে তারই আস্তানায় মানে এখানেই দাফন করা হয়।
আমরা ১২টার পরে শেওয়ানে পৌঁছালাম। মাজারের প্রধান ফটকের সামনেই গাড়ি দাঁড়ালো। উঁচু দেয়ালে ঘেরা। উঁচু ফটক। ফটকের উল্টোদিকে সেই চেনা দৃশ্য যেমনটা এই উপমহাদেশের সূফিদের মাজারের সামনে দেখা যায়। ফুলের, মালা, চাদর, ঝালর আর এখানকার বিখ্যাত ‘বেউরী’ এক ধরনের শুষ্ক মিষ্টি। আর একটি বিশেষ বস্তু চোখে পড়লো তা হলো রং-বে রংয়ের সুতো। মানত করে সুতো বাঁধার সংস্কৃতি যা সূফিরা গ্রহণ করেছিলেন স্থানীয় ভারতের সংস্কৃতি হতে। মনে পড়ল বেশ কয়েক বছর আগে  এসব কথিত ‘বেদাত’ অভ্যাসের কথিত প্রতিবাদে প্রথমবারের মতো এই মাজারে আইএস (ইসলামিক স্টেট ইন ইবাক, লেভেন্ট এন্ড সিরিয়া) বোমা হামলা করেছিল। সেদিন বিকালে ‘ধামাল’ হচ্ছিল। ধামাল জীপসীদের কথিত আধ্যাত্মিক নৃত্য। ৮৮ জন নারী পুরুষের মৃত্যু হয়েছিল সে আক্রমনে কিন্তু থেমে থাকেনি বাৎসরিক উৎসব।
গেটের বাইরে দাঁড়ানো ছিল ফাঁড়ির কয়েকজন পুলিশ আর দু’জন খাদেম। মাজার এ সময় সীমিত আকারে খোলা থাকে। দারুণ গরম। গা পুড়ে যাচ্ছিল। অপর প্রান্ত থেকে দোকানিদের হাঁক-ডাক মাজারে চড়াবার জন্য ফুল আর চাদর কেনার জন্য। আমরা কেউই কর্ণপাত করলাম না।
আমি ভিতরে প্রবেশ করে প্রথমেই আঙিনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সামনের মাজার দালানটির ছবি উঠাতে গিয়ে পারলাম না কারণ প্রায় ফুটবল মাঠের অর্ধেক সমান এই উঠানটি সাদা মার্বেল দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ায় তপ্ত গরমে যে পা রাখা দায়। অবশ্যই মাজার চত্বরে প্রবেশের মুখে জুতা খুলে ঢুকতে হয়েছে। সামনেই বিশাল গম্বুজ সোনালী রংয়ের টাইলস দিয়ে আচ্ছাদিত। গম্বুজের নিচেই ১০০ ফুট স্কয়ারের মাজারের অভ্যন্তর আর মাঝামাঝি শাহবাজ কালান্দারের সমাধি। সমাধিটি একজন পরিনত মানুষের উচ্চতায় চারদিকে রূপার জাফরি দেয়া। জাফরির ফাকগুলো রঙ্গিন সুতাতে গড়া। ভক্তরা এবং দর্শণার্থীরা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণের কল্পে সুতা বাধে। এ দৃশ্য উপমহাদেশের যে কোনো মাজারের।এটা উপমহাদেশের সনাতন পদ্ধতি মনের ইচ্ছা পূরণকল্পে সুতা বাধা। গম্বুজের চারধারে চারটি রূপার রংয়ের মিনার। গম্বুজের উচ্চতা ১১০ ফুট আর ব্যাসার্ধ ৫৬ ফুট। সামনে বড় দরোজা।
আমাকে দাঁড়ানো দেখে বয়সে তরুণ একজন খাদেম এসে দাঁড়ালেন। আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথা হতে এসেছি। বললাম, বাংলাদেশ। শুনে বেশ আনন্দিত হয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। বললেন তিনি বাংলাদেশ সম্বন্ধে তেমন বিশেষ কিছু জানেন না তবে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে পাকিস্তান হতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং এখন বাংলাদেশ যে পাকিস্তান থেকে অনেক ধনী এমনটাই তিনি শুনেছেন। তিনি স্থানীয় একজন। তার মুখেই অনেক বিস্তারিত শুনলাম। জানালেন যে মাজারটি ১৩৫৬ সালে তৈরি হয়। সামনের বড় দরোয়াজাটি ইরানের শেষ নৃপতী রেজা শাহ পাহলভী দিয়েছিলেন। বেনজীর ভুট্টোর সময় অনেক সংস্কার হয়। তখন গম্বুজটির সংস্কার হয় এবং সোনালী রংয়ের আর এমিরতে সাশক করিয়েছেন। তিনি জানালেন সামনে দু’ পাশে দুটি ছোট মসজিদ রয়েছে যার একটি শিয়া মসজিদ।
এই সিন্ধি খাদেম জানালেন যে, এই উঠানে ২০১৭ সালে এক বিকালের ধামাল-এর সময় হামলা হয়েছিল কিন্তু কোনোভাবেই তারা দমে যায়নি। আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মূল মাজারের দিকে চললাম। জিজ্ঞাসা করলাম সে সিন্ধুতে ‘ওডেরা’ (জমিদার)দের প্রভাব কতোখানি এখন? উত্তরে বললেন যে প্রয়াত ভুট্টোর সময় হতেই ‘ওডেরা’দের প্রভাব কমতে থাকে। তাছাড়া এখন শিক্ষা ব্যবস্থা আরও সার্বজনীন হওয়াতে ‘ওডেরা’দের প্রভাব এখন অনেক কম।
ধামাল সম্বন্ধে বলতে হলে বলতে হয় এটা অনেকটাই তুরস্কের দরবেশ নাচ যা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে স্থানীয়ভাবে ধামালে রূপ নিয়েছে। সাধারণত জিপসীরা এবং মালাংরা এখানে ধামাল করে থাকেন।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রধান দরজার কাছে পৌঁছলে ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। 
হাবিব ভাইকে দেখলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। সমাধির গ্রীলে বহু ভক্তরা ‘মানত’ করে রঙিন সুতা বাঁধছে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক মাজার প্রাঙ্গণে কাটিয়ে আমরা বাসে এসে বসলাম। অপর প্রান্ত থেকে দোকানিদের হাঁক-ডাক কিন্তু কেউ খুব একটা মনোযোগ দিলেন না। রাস্তায় দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা লারকানায় যাব ওখান থেকেই আমরা দেখতে যাব মহেঞ্জোদারো। সেখান থেকে আমরা ভাওয়ালপুর যাবো।
লারকানার পথের দু’পাশেও একই দৃশ্য সিন্ধুর বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চলের মতো। কিছু কিছু ক্যাকটাস, বাবলা গাছ- আর ধূ ধূ বিস্তীর্ণ এলাকা। রাস্তায় তেমন গাড়ি-ঘোড়া নেই। পাকিস্তানের এই অঞ্চলে শহরকেন্দ্রিক মানুষের বাস। গ্রামের জীবন বেশ কঠিন কারণ পানির অভাব। 
রাস্তায় যেতে যেতে হাবিব ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তার ‘ঝুলে লাল’ দেখবার অভিজ্ঞতা কেমন? বললেন যে ওনার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল লাল শাহবাজ কালান্দার দেখার খুব  ইচ্ছা ছিল যা পূরণ হলো। কিন্তু দুঃখ রয়েই গেল ধামাল দেখা হলো না। বললাম, বৃহস্পতিবার বিকাল হলে দেখতে পারতেন। আমরা তো রাতে এসব রাস্তায় সফর করবো না তা আগেই বলে রেখেছি। ধরুন এখন একদল ডাকাত হামলা করলে এই কয়েকজন পুলিশ কীভাবে ঠেকাবে?
আমরা চলছি। অনেকেই চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন। সারতাজ-এর কাছ থেকে জানতে চাইলাম ইমরান খানের পতনের পর এখন রাজনৈতিক অবস্থান। সারতাজ এবং সারতাজ-এর মতো পাকিস্তানের বর্তমান তরুণদের কাছে ইমরান খান একজন আদর্শ নেতা। সারতাজ তো মনে করেন ১৯৭১ এর পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন কিন্তু পাকিস্তান আর্মি এ দেশের রাজনীতিতে যে ধস এনেছে যার কারণে দেশ ভাগ হয়ে গেল তাদের প্রভাবের কারণে এদেশের অর্থনীতি আর রাজনীতিতে এই ধস। ইমরান খান ও তার দল পিটিআই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবার পর  এখন রাজপথে। সম্পূর্ণ পাকিস্তান চষে বেড়াচ্ছে। গণজাগরণ তার পক্ষে আনতে একমাথা হতে আরেক মাথায় ছোটাছুটি করছেন। দাবি আগাম নির্বাচনের। তবে আন্দোলনগুলো শান্তিপূর্ণ। কোনো ভঙ্গুর বা জ্বালাও পোড়াও নেই।
লারকানা যাবার পথে যখন আমরা এ উপমহাদেশের তথা বিশ্বের মানব সভ্যতার এবং সিন্ধু সভ্যতার ঊষালগ্নের শহর মহেঞ্জোদারোতে পৌঁছালাম তখন বিকাল প্রায় চারটা। গরমের দিন দিনের আলো থাকে সন্ধ্যা প্রায় ৭টা পর্যন্ত। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা মহেঞ্জোদারো পৌঁছালাম। আমি এর আগে কখনো মহেঞ্জোদারো আসতে পারিনি বা আসার সুযোগ হয়নি। আমরা প্রায় দুই ঘণ্টার উপরে সময় চলে পৌঁছলাম তখনো সূর্যের তাপ কমেনি। কমেনি গরমের ভাপ।
প্রত্যেকের জন্য ৩০০ রুপির টিকিট কেটে গাড়িকে ভিতরে পার্কিং এ রাখলে সবাই নামলো। প্রথমে ঢুকলাম দোতলা জাদুঘরে। জাদুঘর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাই সবাই পৌঁছলেন। একমাত্র হাবিব ভাইয়ের শ্যালিকা মনি গাড়িতেই রয়ে গেলেন।
জাদুঘরে মহেঞ্জোদারোর প্রায় ৪৫০০ বছরের ইতিহাস আর ওই সময়কার বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। রয়েছে মহেঞ্জোদারোর পূর্ণাঙ্গ ছবিগুলো। বেশ কিছুক্ষণ জাদুঘরে কাটিয়ে মহেঞ্জোদারোর ৪৫০০ বছরের পুরাতন শহর দেখতে বের হলাম। সেই স্কুলে ইতিহাস আর ভূগোলের পাঠে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার ইতিহাস আর ভৌগলিক অবস্থান পড়তে আর মুখস্ত করতে হয়েছিল। পরে শহরটি গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদীর তীরে কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সিন্ধু নদীর দিক ও স্থান পরিবর্তনের পর সম্ভবতই শহর পরিত্যক্ত হয়।
আমরা কয়েকজনই এ গরম সহ্য করে প্রায় কিলোমিটার হেঁটে মহেঞ্জোদারো ঐতিহাসিক শহরের দেয়ালঘেরা প্রধান ফটকে পৌঁছলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র চারজন এ পর্যন্ত এসেছি। আমার সাথে ফারুক, আমানুল্লাহ, নাসরুল্লাহ সহ হেঁটে দিয়ে প্রবেশ করলাম। ঐতিহাসিক শহরের প্রধান অংশ অনেকটা টিলার মতো উঁচু জায়গায়। কোনো গাছপালা নেই থাকবারও কথা নয়। ছোট ছোট ইট আর শক্ত মাটির গাঁথুনিতে তৈরি পুরো শহর। আমরা প্রথমেই পৌঁছলামÑবিশাল সুইমিং পুল এর মতো গোসল করবার পুকুরের মতো জায়গায়। এর নাম ‘গ্রেট বাথ’। এর আশপাশে শহর থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্যে পাকা ড্রেন। এর উপরের অংশে উঁচু জায়গায় মন্দির ছিলÑ সূর্য মন্দির। এ অংশ নিশ্চয়ই এই শহরের অভিজাত এলাকা ছিল। বাড়িঘরের ভগ্নাংশ দেখলে তেমনই মনে হয়।
আকার আর নির্মাণশৈলী দেখলে তেমনই মনে হয়। সূর্য মন্দিরের নিচেই বড় ঘরটি হয়ত প্রধান পুরহিত অথবা ওই সময়ের এ শহর প্রধানের বাসস্থান ছিল।


শহরটি আরও বিস্তীর্ণ তবে আরেকটু নিচে এবং দূরে। অতদূর আর যাওয়া হয়নি। মহেঞ্জোদারোতে দাঁড়িয়ে যা উপলব্ধি করা যায় যে ওই সময়ের মানুষের নগর পরিকল্পনার শক্তি। এখানে শুধু মন্দিরই নয় গুরুগৃহের অবস্থানও দেখা যায়।
মহেঞ্জোদারো মানে মৃত মানুষের টিলা।’ বিশ্বের কয়েকটি সভ্যতার অন্যতম সিন্ধু সভ্যতা। শহরটি ওই সময়ের অন্যতম বৃহৎতম শহর। মহেঞ্জোদারো-মিশরীয়, মেসোপোটেমিয়া অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতার সমতুল্য। ইতিহাস বলে এই শহরের প্রায় ৪০,০০০ মানুষের বসতি ছিল। তথ্যে প্রকাশ মহেঞ্জোদারোতে ১৭০০ খৃস্টপূর্ব পর্যন্ত আবাদ ছিল। তথ্যে আরও প্রকাশ যে এই শহরটিতে খৃস্টপূর্ব ১৯ শতক পর্যন্ত আবাদ ছিল।
সম্পূর্ণ শহরটি ৬২০ একরের উপরে বিস্তীর্ণ। আগেই বলেছি সিন্ধু নদীর গতি পরিবর্তন আর বিবর্তনের কারণে ক্রমেই সিন্ধু সভ্যতার ক্রমেই পতন হয়। ওই সময় এই সভ্যতা ইরান এবং ভারতের পূর্বপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিল। পুরো শহরটি মাটির নিচে চাপা পড়েছিল। পরে এ অঞ্চলে রো.... রেল লাইন বসাবার সার্ভের সময় ১৯২০ সালের দিকে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পুরো শহর আবিষ্কৃত হয়।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এখানে প্রায় ৫০০০ মানুষের বাসের জন্যে বাসস্থান ছিল। যেমনটা বলেছি আর উপরে ছিল মন্দির। এ মন্দিরের উচ্চতা ৩৯ ফুট। এখানকার সবচাইতে বড় ঘরটি ছিল শস্য গোডাউন। ঠিক তার নিচে আমরা যেখানে দাঁড়ানো, যার ছবি ইতিহাসের পাতায় দেখে বড় হয়েছি, সেই বৃহৎ গোসলের আঁধার বা ‘গ্রেট বাথ’। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক এর দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট, পাশে ২৩ ফুট আর গভীরতা ৮ ফুট। এখানে নামতে আর উঠতে দু’দিকে দুটো সিঁড়ি রয়েছে। এই সভ্যতার সাথে জড়িত রয়েছে হরপ্পা সভ্যতা। আমরা হরপ্পায় যাচ্ছি না কারণ দুটোই একই ধাঁচের আর হরপ্পা মহেঞ্জোদারো হতে ছোট পরিসরে।
এই গ্রেট বাথ মাটির সাথে বিটুমিন জাতীয় পদার্থ দিয়ে ইটের বন্ধন হয়েছিল বলে পানি ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। এখানে একটি তথ্য ফলকে লেখা:
“এই গোসলের জায়গা এখানকার মানুষকে পবিত্র করতে ধর্মীয় কারণে ব্যবহার করা হতো। এতেই প্রমাণ হয় মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম ছিল এই পবিত্র গোসল-(আর্কিওলজিস্ট  জে এম কেনোইয়ার:  J.M Kenoyer)’’
মহেঞ্জোদারোর এই বিশাল ঐতিহাসিক শহর এর এক সময়ের প্রাণকেন্দ্রে দাড়িয়ে ভাবছিলাম আমাদের এই উপমহাদেশ মানব সভ্যতার উত্থানের জায়গা। পদে পদে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর সভ্যতার সমাধি। আজ হতে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের শহরে দাঁড়িয়ে আমি হারিয়ে গেলাম। কীভাবে ওই সময় এমন একটি পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে পারে। তখনতো বহু ডিগ্রিধারী নগরবিদ ছিলেন না। অথচ এত নগরবিদ থাকা সত্ত্বেও আমরা যে সব নগরীতে থাকি তা আর কিছুই নয় ইট পাথর আর কংক্রিটের জঙ্গল। দম নেবার এমন উন্মুক্ত জায়গা নেই যে জায়গায় আমরা দাঁড়ানো।
প্রায় ঘণ্টা খানেক মহেঞ্জোদারোর প্রধান স্থাপত্যগুলো দেখে বের হবার পথে দাঁড়ালাম। মহেঞ্জোদারোর প্রধান পুরোহিত বলে কথিত পুরোহিত বা রাজার বড় ধরনের ভাস্কর্যের সামনে। এর আগে জাদুঘরে দেখেছিলাম দেবী ও কথিত নর্তকীর ছোট ভাস্কর্য যা পাঠ্যপুস্তকেও সন্নিবেশিত ছিল। বলা হয়ে থাকে সিন্ধু সভ্যতা ছিল দ্রাবিড় সভ্যতার নিদর্শন। অবশ্যই এই অঞ্চলেই উত্থান হয়েছিল দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের যা কালের বিবর্তনে উপমহাদের দক্ষিণ এবং পূর্বে ছড়িয়ে যায়। আমরা তাদেরই পরমপরার মানুষ। অন্তত এখানকার মানুষদের জীবন জীবিকায় অভ্যাস আর অবয়বের সাথে আমাদের অনেক মিল রয়েছে। হয় আমরা এই বদ্ধভূমির মানুষ এদেরই উত্তরসূরী।
আমরা বের হয়ে আসলাম। গাড়িতে উঠে লারকানার দিকে রওয়ানা হতে শুনলাম টিকিটের সাথে ঠাণ্ডা কোকাকোলা পাওয়া যেতো। কিন্তু আমরা তা না নিয়েই মহেঞ্জোদারো ছাড়লাম। ছাড়লাম বিশ্বের মানব সভ্যতার এমন নিদর্শন। আমাদের যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই সভ্যতার সূতিগ্রহ দেখা। 
সে বাসনা পূর্ণ হল। গরম তার তাপ উপেক্ষা করে আমরা যে কয়জন এখানে ঘণ্টাখানেক কাটালাম তা হয়তো যথেষ্ট নয়। তথাপি ভুগোল ইতিহাস পাঠকে স্বরণীয় করতে পেরেছি তাতেই প্রশান্তি।
 

(লেখক প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার, প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এস আই পিডি এর সিনিয়র ফেলো। লেখকের আগামী ভ্রমনকাহিনীর একাংশ হতে উদ্ধৃত)। 

 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status