ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

মালদ্বীপের মোহন মায়ায়

আবদুল্লাহ আল মোহন

(১ বছর আগে) ২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৯:৩২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:৩৫ পূর্বাহ্ন

mzamin

এশিয়ার সবচেয়ে ছোট এবং দুনিয়ার সবচেয়ে নিচু দেশ মালদ্বীপ। দেশটিতে প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করতে আসে। যেখানে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর ঢেউয়ের তালে তালে জ্বলজ্বলে করতে থাকে দেশটির বালুময় সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের পানি থেকে বিচ্ছুরিত হয় অদ্ভুত আলো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য যা দেখে চোখ বিস্ময়ে আটকে থাকে

 

‘মালদ্বীপ’ নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা তীব্র আকর্ষণ, মোহন মায়া রয়েছে। সেই সঙ্গে ‘মালে’ শব্দটিও ভীষণভাবে আমাকে টানে। মালদ্বীপ আর মালের প্রতি গভীর টান, অনুভবের অন্য অনেক কারণ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে অকাল প্রয়াত সুপ্রিয় স্বজন, প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব কায়েস ভাইয়ের স্মৃতি। আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকালের অন্যতম ‘খলিফা’ মিজারুল কায়েস ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ছিলেন এই মালদ্বীপেই বাংলাদেশের হাইকমিশনার। মালে ভ্রমণের বার বার তার আন্তরিক আমন্ত্রণ আহ্বানে সাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়ার বেদনার জলে নীলদ্বীপ গড়ে উঠেছিলো মনের বদ্বীপে। বেদনার মন্দিরে ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়ে কায়েস ভাইয়ের স্মৃতিকে স্মরণে রেখে নীলাভ অতল জলের প্রতি প্রবল প্রেমের টানে তাই করোনাকালের নানা বিধিনিষেধ মেনেই ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁন’কে অবজ্ঞা করে রওনা দেই মালদ্বীপে।

বিজ্ঞাপন
কলেজের অবকাশকালীন ছুটির সুযোগে ২০২২ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ জীবনজিজ্ঞাসুর অন্তর্গত, রং রসের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত স্মৃতিচিত্র হয়ে থাকলো আমি আর আমার ভ্রমণপিপাসু সাধনসঙ্গী শান্তা ম্যাডামের (রাশনা রশীদ, সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, গর্ভনমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স, ঢাকা) মালদ্বীপ ভ্রমণ। আমাদের সপ্তাহব্যাপী ভ্রমণ ছিলো অন্য যেকোনো দেশে ভ্রমণের চেয়ে সত্যিকার অর্থেই অনন্য, অভূতপূর্ব। যে পর্যটন এক দিগন্ত ছোঁয়া আলো, জীবনের স্বপ্নগুলো মোচড় দেয়া বিরল অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির মায়ার খেলা মনে প্রবল বিস্ময় জাগায়, নীলজলের বৈচিত্র্য, বৈভব ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলায়। অসীম প্রকৃতির সম্ভারগুলো প্রাণ পায় যেন। ‘দেখে দেখে আঁখি না মেটা’নো জীবন যথার্থই সুন্দর বলে প্রতীয়মান হয়। রূপ, রং, রসের সমাহারে অনিন্দ্য উপভোগ অনাবিল সুখের সন্ধান দেয়। ‘চোখের বালি’ না হয়ে স্পর্শের সুখ-অনুভবে পায়ে বেশিক্ষণ লেগে না থাকা, ঝরে পড়ে যাওয়ার স্মৃতিচিহ্ন কিন্তু রেখে যায়। যে স্মৃতিগুলো আমায় নিত্য পিছু ডাকে। আর তাইতো মনের ঘুড়ি উড়াই ভ্রমণানন্দের স্মৃতির আকাশে।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নানাবিধ বিপর্যয়ের মাঝে মনে হলো করোনাকালের কঠিন সময়ে, সীমিত পরিধির জীবনে প্রকৃতিই দিতে পারে নিরাময়ের আশার পরশ। সেই প্রিয় প্রকৃতির অপার টানে, গভীর প্রেমে সমুদ্রের স্বাদ নিতে উড়ে যাই পর্যটকদের জন্য ব্যয়বহুল বলে বিবেচিত ভ্রমণ গন্তব্য মালদ্বীপ। ঢাকা থেকে বিমানে উড়তেই দেখা মেলে প্রবাসী বাঙালি ভাইদের। বিমানের ৯০ শতাংশ যাত্রীই ছিলেন মালদ্বীপ প্রবাসী ভাইবোনেরা। তাদের সঙ্গে খুব সহজেই জমে ওঠে আলাপ। তাদের সঙ্গে সেলফি তুলতে তুলতে করোনাকালে ‘দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্যলোক’-এর অনন্য ছবিও খুঁজে পাই। অনুধাবন করি, মানুষের চেয়ে বিচিত্র আর কিছু দেখতে না পাই আর না পাই, এর অনন্য প্রকৃতি, ইতিহাস টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। বিমান থেকে যেমন দেখেছি, তেমনি কয়েকদিনের ভ্রমণেও মালদ্বীপের দিকে তাকালে সম্পর্কের নকশিকাঁথা দেখি, টের পাই শূন্যতার দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া সাগরের সুর-সংগীত, মেঘ-জ্যোৎস্নার প্রবল উচ্ছ্বাস। কাঁথার নিখুঁত নকশার মতো দ্বীপগুলো রাষ্ট্রের অবয়বে ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে আছে। সময়ের স্রোতে নিমজ্জিত মানব অস্তিত্ব খুঁজতে যাই, পাই মানব জীবনের পতন ও উত্থান, হাহাকার ও সংগ্রাম, বঞ্চনা ও পরিবর্তন। যে বিষাদ নিয়ন্ত্রণ করে, তারই মাঝে খুঁজে ফিরি অস্তিত্বের পরিচয়। অনুধাবন করি মালদ্বীপের একেকটা দ্বীপ যেন স্বাধীন রাজ্য। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়ার ‘ময়না দ্বীপ’ হয়ে ওঠে, দেখা মেলে মালদ্বীপে। প্রায় শতভাগ মুসলিমের দেশ মালদ্বীপে পবিত্র রমজানের দিনে বিভিন্ন ধর্মের-বর্ণের মানুষের নির্বিশেষে যে যার কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। হিজাব পরিচিতি রোজাদার মুসলিম নারীকে দেখেছি কাজ করছেন সমুদ্রজলের ইউরোপীয় বিকিনি পরিহিতা নারীর সেবাদানে। সন্ধ্যায় তীরে বসে মুসলিমরা ইফতারি করছেন, পাশেই জলকেলিতে ব্যস্ত স্বল্পবসনার নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীরা। কারও সঙ্গে কারও কোনো বিবাদ কিংবা অহেতুক ধর্মীয় উপদেশ দানের উত্তেজনা, মাতম দেখিনি। বিপরীতমুখী চরিত্রের এই সম্প্রীতির সম্পর্কের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো নীলজলের দ্বীপবাসীদের মাঝে ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে অনন্য ও অনুকরণীয় অপরূপ চিত্র প্রতিনিয়ত দেখে দেখে প্রীত হয়েছি। সেই সঙ্গে ভালো লেগেছে দোকানে দোকানে বিক্রির জন্য রাখা পণ্যগুলো রাতের বেলাতেও বাইরেই ঝুলিয়ে রাখতে দেখে। দোকানি বাঙালি ভাইদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি- নিরাপদ বলেই এমনটা করেন তারা। 

জিনিসপত্র চুরির সম্ভাবনা কম। প্রতারণার চেয়ে ব্যবসাতেই লাভ বেশি। মালদ্বীপের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে পর্যটনশিল্পে। তাই এত গুরুত্ব দিয়ে পর্যটকদের দেখা হয় নিরাপত্তাসহ যাবতীয় অনুষঙ্গকে। ফলে সকলের মনোযোগ সেদিকেই। ব্যবসা-বাণিজ্য করেই যদি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় তাহলে কে আর অসৎ পথে পা বাড়ায়? ভ্রমণকালে পেয়েছিলাম সহৃদয় মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল কাদিরদের মতোন অসংখ্য বাংলাদেশি তরুণ কর্মীদের আন্তরিকতার ছোঁয়া। বঙ্কিম অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘পালামৌ’তে লিখেছিলেন, ‘প্রবাসে বাঙালি মাত্রেই সজ্জন’ প্রবলভাবে প্রমাণ মেলে মালদ্বীপে। তেমনি মনে হয়েছে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে প্রকৃত জড়িতদের ব্যবস্থাপনাশাস্ত্র সঠিকভাবে শিখতে মালদ্বীপে শিক্ষা সফর জরুরি। ভ্রমণকালে সর্বত্রই সবচেয়ে ভালো লেগেছে পদসোপন ক্রম মেনে সবাইকে যে যার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত, সদা সচেষ্ট থাকতে দেখে। প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনে, সহবাসে স্বপ্নের সিদ্ধিলাভ ঘটে, কল্পনাবিলাস বাস্তবের মাটিতে পা রাখে মালদ্বীপ ভ্রমণ। সুন্দরের আসল সংজ্ঞা খুঁজতে আত্মোপলব্ধির মধ্যে প্রবাহিত অভিঘাত চেতনায় মাঝে মাঝে স্বপ্নভঙ্গও ঘটে যেন। সেখানকার প্রতিটি জিনিসের দাম তুলণামূলকভাবে অনেক বেশি। তাই কেনা-কাটার জন্য মালদ্বীপ মোটেই সুলভ জায়গা নয়। কারণ প্রায় সবকিছুই মালদ্বীপকে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয় বলে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। সেটা না হয় মানলাম তবে নারিকেল-ডাবের দেশে এক একটি কঁচি ডাবের দাম পাঁচ ডলার জেনে ডাবের পানি পানের তৃষ্ণা ঘুচে যায় আমার মতোন এক ডাব আর তার রসালো শাস প্রিয় মানুষের।

ইচ্ছাপূরণের অন্যরকমের একটি ভ্রমণ স্বর্গ মালদ্বীপ। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ। পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যম-িত দেশ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। শান্ত ও মনোরম পরিবেশ, পুরাতন এই সমুদ্র  সৈকত মালদ্বীপের প্রধান আকর্ষণ। যেখানে পানির রং নীল আর বালির রং সাদা। তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা মালদ্বীপের সবগুলো দ্বীপের চারদিকে ঘিরে আছে সাগরের অফুরন্ত জলরাশি। মালদ্বীপের বালুকণা স্থানীয়দের হাসির মতোই শুভ্র। সেখানে ভারত মহাসাগরের উষ্ণ জলে মাছ খুশিতে সাঁতার কাটে। সেখানে আবহাওয়া একটি স্বপ্ন এবং সূর্যের গভীর রশ্মিগুলো আলোয় ভরিয়ে দিতে অপেক্ষা করে। প্রাচীনকালে মালদ্বীপের তীরগুলো সাগরে হারিয়ে যাওয়া যাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছে। মালদ্বীপ এখনো স্বাগত জানায়। তীরগুলো রয়ে গেছে, সেগুলো দর্শনার্থীদের জন্য একটি প্রশান্তির স্বর্গ এনে দেয়। মালদ্বীপ হচ্ছে দ্বীপের মালা। শ্রীলঙ্কা থেকে প্রায় ৪৫০ মাইল পশ্চিম-দক্ষিণে মালদ্বীপ। সাগরের জলভাগসহ এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির মোট আয়তন ৯০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ভারত মহাসাগরে নীল জলরাশির ছোট ছোট প্রায় ১২০০ দ্বীপ নিয়ে স্থলভাগে ২৯৮ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত মালদ্বীপ। এর মধ্যে ২৫০টি দ্বীপ ব্যবহারযোগ্য। এতে রয়েছে ২৮টি অ্যাটোল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার। বিষুবরেখার কাছে অবস্থিত হওয়ায় মালদ্বীপ বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটিতে মাত্র একটি ঋতু আছে। সারা বছর গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শতভাগ মুসলিম দেশ মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় ভাষা ‘ধিবেহী’ আর মালদ্বীপীয় ‘রুপাইয়া’ হলো মুদ্রার নাম। তবে ‘রুপাইয়া’র চেয়ে বেশি প্রচলন দেখলাম মার্কিন ডলারের। জানা যায়, প্রাচীনকালে মুদ্রার পরিবর্তে যে ‘কড়ি’ ব্যবহার করা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, মালদ্বীপ তার বেশির ভাগের জোগান দিতো। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, আফ্রিকায়ও যেত মালদ্বীপের কড়ি। এ কারণে দ্বিতীয় শতকে মালদ্বীপকে ‘মানি আইল্যান্ড’ নামে ডাকা হতো। ছোট এই দেশের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১৭ হাজার ডলারের বেশি।

‘কি ভালো আমার লাগলো, কেমন করে বলি’র মতোন ভাষায় অপ্রকাশের ভারে বিমোহিত অপরূপ সৌন্দর্যের সমুদ্র সৈকত আর বিলাসবহুল বিচ ভিলা, ওয়াটার ভিলা ও রিসোর্টের জন্য দেশটি সুপরিচিত। ছোট দ্বীপগুলো বিশ্বের ধনী ও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের অবকাশযাপনের স্বপ্নের ঠিকানা হয়ে উঠেছে। তবে এই স্বপ্নরাজ্যকে ঘিরে আশঙ্কার কথাও শোনা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনকামীদের মুখে। মালদ্বীপ পৃথিবীর সর্বনিম্ন এবং সমতলতম দেশ, ফলে মালদ্বীপ সর্বদা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার, এ রকম এক জল ডুবুডুবু দেশের নাম মালদ্বীপ। তাবৎ পৃথিবীর পর্যটকদের বিলাস যাপনের অন্যতম লক্ষ্য এই দেশ। ঘন নীল আর শ্যাওলা সবুজ ঢেউ খেলানো ভারত মহাসাগরের বুকে দোল খাওয়া এই অনিন্দ্য সুন্দর ভূখ-ের কোনও তুলনাই নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, মালদ্বীপে এমন অনেক রিসোর্ট রয়েছে, যেগুলো এক একটি আলাদা দ্বীপ। আর আমাদের পর্যবেক্ষণে মালদ্বীপের পর্যটন সম্পর্কে অন্যতম সেরা তথ্য হলো এটি পুরো বিশ্বে ভ্রমণ করার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। এমনকি মালদ্বীপের খুব বিচ্ছিন্ন একটি রিসোর্ট অত্যন্ত নিরাপদ। একবারেই নির্জনে সময় কাটাতে চান এমন পর্যটকরা এসব রিসোর্ট খুবই পছন্দ করেন। দিন দিনই বাড়ছে এমন বিলাসবহুল রিসোর্টের সংখ্যা। এটা ঠিক যে, মালদ্বীপের মূল ভূখ- ডুবে গেলেও নানা দ্বীপেই থেকে যাবে অনেক রিসোর্ট। এ দ্বীপগুলো তৈরি হচ্ছে সেভাবেই। দু’ধরনের দ্বীপ আছে মালদ্বীপে- পাবলিক বা লোকাল আইল্যান্ড এবং ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট আইল্যান্ড। কেবলমাত্র পাবলিক বা লোকাল আইল্যান্ডেই স্থানীয় জনগণ বসবাস করেন।

‘মালে’ শব্দটি কেন তীব্রভাবে টানে সে প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষেত্রে ধীবর থেকে ধনী হয়ে ওঠা মালদ্বীপের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা জানাও জরুরি। যদিও মালদ্বীপ নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ দাবি করেন মালদ্বীপ অর্থ হচ্ছে ‘মেল দ্বীপ রাজ’ বা পুরুষশাসিত রাজ্য। মূলত ‘দ্বীপ’ একটি সংস্কৃত শব্দ আর ‘মাল’ শব্দটি দেশটির রাজধানীর নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঔপনিবেশিক আমলে ডাচরা তাদের নথিপত্রে এ দ্বীপপুঞ্জের নাম মালদ্বীপ বলে উল্লেখ করেন। পরে বৃটিশরাও একই নাম ব্যবহার করেন, যা দেশটির স্থানীয় নাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শ্রীলঙ্কান প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীদের দ্বীপ। তবে কিছু কিছু প-িত মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মালাদ্বীপ থেকে যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। তবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এ দ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্কাদ্বীপ’ বা শত হাজার দ্বীপ। তবে মালদ্বীপে এক হাজারের বেশি দ্বীপ থাকলেও এক লাখ দ্বীপ নেই। আবার আরব পর্যটক ইবনে বতুতা এ দ্বীপকে বলেছেন ‘মহল দ্বীপ’ বা রাজপ্রাসাদের দ্বীপ। আর মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে ইবনে বতুতার ব্যাখ্যার নিরিখে এখনো মহল বা রাজপ্রাসাদের ছবি ব্যবহৃত হয়।

এশিয়ার সবচেয়ে ছোট এবং দুনিয়ার সবচেয়ে নিচু দেশ মালদ্বীপ। দেশটিতে প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করতে আসে। যেখানে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর ঢেউয়ের তালে তালে জ্বলজ্বলে করতে থাকে দেশটির বালুময় সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের পানি থেকে বিচ্ছুরিত হয় অদ্ভুত আলো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য যা দেখে চোখ বিস্ময়ে আটকে থাকে। এজন্য অনেকের কাছেই হানিমুনের জন্য সবচেয়ে পছন্দের দেশ মালদ্বীপ। পৃথিবীর মধ্যে মালদ্বীপের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য বিশ্বব্যাপী আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। এখানকার সমুদ্রের রং অতি পরিষ্কার ও নীল এবং বালির রং সাদা। সমুদ্রের মধ্যে হাজার ধরনের মাছ দেখা যায়। মালদ্বীপে বেড়াতে এলে থাকতে পারেন সমুদ্রের পানির ওপর বিশেষভাবে নির্মিত রিসোর্ট, বাড়িতে। এসব রিসোর্ট থেকে পর্যটকরা সমুদ্রের বিভিন্ন রঙের মাছ ও প্রাণি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান; শুনতে পান সামুদ্রিক পাখির ডাক। আর যারা সমুদ্র সৈকতে থাকতে চান, তাহলে তাদের জন্য আছে বিশেষভাবে নির্মিত বিচ ভিলা বা বাড়ি। সাধারণত সমুদ্রের মধ্যে নির্মিত বাড়িগুলো সৈকত থেকে প্রায় ১০ মিটারের মতোন দূরে অবস্থিত। কাঠের সেতু দিয়ে সেগুলোকে সৈকতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় কাঠের সেতুও থাকে না; পর্যটকরা ছোট নৌকায় করে সমুদ্রের বুকে নির্মিত বাড়িতে প্রবেশ করেন। একমাত্র মালদ্বীপেই বিশালাকার সাবমেরিনে করে সমুদ্রের তলদেশে ঘুরে বেড়ানো যায়, পর্যটকদের প্রায় ১৮০ ফুট পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশে নিয়ে যায়। গভীর সমুদ্রের সৌন্দর্য সবাইকে বিমোহিত করে।

মালদ্বীপে রয়েছে এমন অনেক দর্শনীয় স্থান, যার কথা এখনও অনেকেই সেভাবে জানেন না। সমুদ্রের তীরবর্তী সেসব স্থানে ভ্রমণ করা যে কোনো ব্যক্তির জন্যই হতে পারে নতুন এক অভিজ্ঞতা। অসাধারণ ও রোমান্টিক অসংখ্য স্থানে প্রতি বছর প্রচুর মানুষ হানিমুন করতে আসেন। মালদ্বীপের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে বিচগুলো বিখ্যাত। সেখানে সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেই দ্বীপের সৈকত জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আর অসাধারণ সে দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ায় যেকোনো ব্যক্তির। প্রতিটি দ্বীপের নিজস্ব পরিকল্পনায় সৃষ্ট আরও বেশকিছু দর্শনীয় স্থান আছে। তবে পর্যটকদের কাছে এর সমুদ্র সৈকতই সবচেয়ে জনপ্রিয়। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউয়ের তালে তালে জ্বলজ্বল করতে থাকে এসব দ্বীপের বালুময় সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের অগভীর পানি থেকে যেন বিচ্ছুরিত হতে থাকে অদ্ভুত আলো। কিন্তু কেন সে দ্বীপের সৈকত এভাবে জ্বলজ্বল করে? এ প্রসঙ্গে গবেষকরা জানাচ্ছেন, ফাইটোপ্লাংকটন নামে ক্ষুদ্র এক ধরনের প্রাণী তৈরি করে এ আলো। এটি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। আর তা দেখে মোহিত হয় আমাদের মতোন ভ্রমণপিপাসু মানুষ।

মালদ্বীপের সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল দ্বীপ মাফুশি ছাড়াও সান সিয়াম ওলুভেলি রিসোর্ট আইল্যান্ডে আমরা সময় কাটাই। সুদ আসলে হোটেল কক্ষের জন্য বাড়তি ভাড়া গুনতে হলেও আমরা সুদাসলে তার স্বাদ নিতে পেরেছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যাওয়া সমুদ্র জলের রঙের বৈচিত্র্য ধরা নিয়ে মন-প্রাণকে মোহিত করেছে। বিকিনি বিচে সমুদ্র স্নানসহ সকালের চিকচিকে রোদে হোটেলের সামনে পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে সামুদ্রিক খাবার খাওয়া, রেস্তরাঁয় লাঞ্চ শেষে গাছের ছায়ায় বসে বসে ক্লান্তি দূর করা, মাথার উপর প্রাচীন কোনও গাছ থেকে নেমে আসা নানা রকমের পাখির কল-কাকলি, সন্ধ্যে নামার আগে বিষণœ ভালো লাগায় বালুকাবেলায় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো, রাতের বেলায় তীরে এসে আছড়ে পড়া স্ট্রিং রে মাছের সঙ্গে উৎসব, আরও বেশি রাত বেড়ে গেলে শুধুই প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার, কোথাও শব্দ যন্ত্রণা নাই, কোনো কোলাহল নাই, নির্জনতা বলতে যা বোঝায় মাফুশি কিংবা সান সিয়াম ওলুভেলি রিসোর্ট আইল্যান্ডে কেবল তাই। ওলুভেলি রিসোর্ট দ্বীপের চারপাশে দোতলা-একতলা বিচ বাংলো দিয়ে সাজানো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রিসেপশন অফিস, কনফারেন্স হল, রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল, খেলার মাঠ, ফিটনেস ক্লাব, চিলড্রেন পার্ক, স্পা, সুভেনির শপ, সেলুন ইত্যাদি। এ ছাড়া অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের জন্য আছে অনেকটা সমুদ্রের পানির উপরে তৈরি করা ওয়াটার ভিলা, হেভেন ভিলা, হেভেন স্যুট, ওশেন স্যুট প্রভৃতি। খেয়াল রাখবেন রিসোর্ট ভাড়ার সঙ্গে ব্রেকফার্স্ট, লাঞ্চ ও ডিনার কমপ্লিমেন্টারি হিসেবে অগ্রিম অর্থ দিয়ে নিতে হবে। তা না হলে খাবার নিয়ে তীব্র সমস্যায় পড়তে হতে পারে। কারণ সেখানে কোনো বিকল্প খাবারের হোটেল নাই। সব ধরনের খাবারে অভ্যস্ত না হওয়ায় ভ্রমণের একপর্যায়ে সান সিয়ামে আমার শারীরিক সমস্যার কারণে খাদ্য জটিলতায় আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছিলো সেখানকার নিবেদিতপ্রাণ বাঙালি যুবককর্মী মো. হোসেন হৃদয়। হৃদয়দের সহৃদয় সহযোগিতা পাবেন যে কোনো অতিথিই।

ঢাকা থেকে মালে বিমানে ভ্রমণকালে অনন্য অভিজ্ঞতাটি টের পাওয়া যায় পাইলটের ঘোষণায়, মহাসাগরের জলরাশির দিকে তাকানোর মধ্যদিয়ে। খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের উপর থেকে দেখতে পাওয়া যায় বিমানটি বিশাল সমুদ্রের উন্মত্ত জলরাশির উপর যেন অবতরণ করছে। চারদিকে কিছু নেই শুধু থৈ-থৈ নীলচে রঙের পানি আর পানি। ঢেউ আর ঢেউ। সেইসঙ্গে অসংখ্য ভাসমান সমুদ্র যান। অবতরণকালে মনে হবে বিমানটি যেন পানির তলদেশে তলিয়ে যাবে। কিন্তু না। ভয়ে যখন হতবিহ্ববল যাত্রীর যখন পানির উপর ভাসমান এয়ারপোর্টটি নজরে আসবে, ক্ষণিক আগের আতঙ্ক পরিণত হবে আকর্ষণে। এরপরই মনে প্রশ্ন জাগে- এই হিংস্র উদ্দাম ঊড়নচন্ডী জলদেবীর উপর কীভাবে এয়ারপোর্টটি স্বমহিমায় ভেসে আছে? এভাবে এখানেই মুগ্ধতার শুরু হয়, শেষ হতে হতে আসলেই শেষ হয় না, এই অভিযাত্রা যেন ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতোন ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’। ‘শেষের সে দিন কী ভয়ংকর’ আশঙ্কাটিও মনে জাগে, পরিবেশবাদীদের অনেকেই যেমনটি সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উচ্চতা সমুদ্রের মাত্রাটি মালদ্বীপের দ্বীপ রাষ্ট্রকে ডুবিয়ে দিতে পারে। তাই বলবো ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনার আগেই একবার ঘুরে আসতে পারেন এই স্বর্গপুরী থেকে। একজন নিসর্গপ্রেমীর আয়নায় দেশটির আকর্ষণীয় ছবি ফুটে উঠবে সন্দেহ নেই, কিন্তু পর্যবেক্ষকের অনুসন্ধানী চোখে এর চেহারা কিছুটা অন্য রকম।

১০

মালদ্বীপের বিমানবন্দরটি ‘ভেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নামে পরিচিত। যারাই যে দেশ থেকে আসুন না কেন, নামতে হয় এই বিমানবন্দরেই। আর সে কারণেই কখনো কখনো তীব্র ঝামেলাতেও পড়তে পারেন যে কেউ। মালদ্বীপে প্রবেশকালে আমরা সমস্যায় না পড়লেও ফেরার পথে একই সময়ে একাধিক ফ্লাইটের অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে চরম অব্যবস্থাপনায় শিকার হয়ে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ি। অল্পের জন্য ফ্লাইট মিস হওয়া থেকে রক্ষা পাই আমরা। এক্ষেত্রে ট্রাভেল এজেন্সির যোগাযোগ অদক্ষতা এবং প্রাইভেট অ্যাইল্যান্ডের ব্যবস্থাপকদের অসতর্কতাই দায়ী বলে মনে হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা মতোন তাদের সহযোগিতা পেলে এই উটকো ঝামেলা এড়ানো যেতো। কারণ নৌপথে যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করে। যেহেতু বিমান থেকে নেমে মালে এবং হোলেমালে দ্বীপ ছাড়া অন্য যেকোনো দ্বীপে যাওয়ার জন্য বোটে উঠতে হয়। তবে ২০১৯ সালে এ বিমানবন্দরটি সংযুক্ত হয়েছে সড়কপথে রাজধানী শহর মালে এবং হোলেমালে দ্বীপের সঙ্গে, চীনা সহায়তায় নির্মিত সিনোমালেহ্‌ব্রিজের মাধ্যমে। মালদ্বীপের মূল ভূখ- বা রাজধানী শহর মালে হলো কাফু এটল বা জোনের মধ্যেকার একটি দ্বীপ। এখানেই রয়েছে রাজভবনসহ সব মন্ত্রণালয়, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি। বিমান থেকে নেমে ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই মালে শহরে পৌঁছানো যায়। এখানে উল্লেখ করা জরুরি দ্বীপ থেকে দ্বীপে ভ্রমণের জন্য যাতায়াত একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই জটিলতা এড়াতে ভ্রমণের আগেই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ যাওয়ার জন্য স্পিডবোট ট্রান্সফার ফি বিষয়ে আপনার ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে নেবেন। তা না হলে সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি প্রচুর অর্থদণ্ডও দিতে হতে পারে। মাফুশি থেকে সান সিয়াম ওলুভেলি প্রাইভেট রিসোর্টে স্পিডবোটে স্থানান্তরকালে ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট যেমন হয়েছে তেমনি অর্থদণ্ডও গুনতে হয়েছে।

১১

মালদ্বীপের পানির নিচের জগৎ যেকোনো ভ্রমণকারীকে বিস্মিত করবেই। মালদ্বীপের নীল জলরাশির নিচে আলাদা এক জগৎ, যা জীবনে পরিপূর্ণ। সেখানে আছে বর্ণিল প্রবালপ্রাচীর, কচ্ছপ, তিমি ও হাঙর। স্নোরকেলিং ও ডাইভিংয়ের জন্য উপযুক্ত মালদ্বীপে তরঙ্গ ও তরঙ্গের নিচে- উভয় ক্ষেত্রেই উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতা মিলবে। মালদ্বীপের প্রবালপ্রাচীরগুলো ক্ষুদ্র প্রাণবন্ত রিফ ফিশ, মোরে আইলস, টুনাসহ শত শত প্রজাতির মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাদের সঙ্গে অন্য প্রাণী, যেমন- সামুদ্রিক কচ্ছপ, অক্টোপাস, স্কুইড, গলদা চিংড়ি ও ডলফিনের বসবাস। দর্শনার্থীদের জন্য সাগরের কয়েকটি বৃহৎ মাছমন্টা রে এবং তিমি ও হাঙরের সঙ্গে সাঁতার কাটার সুযোগ রয়েছে। দ্বীপপুঞ্জের চারপাশের ভারত মহাসাগর বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে পূর্ণ এবং এটির অভিজ্ঞতা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় স্নোরকেলিং। পুরো দ্বীপের নিজস্ব প্রবালপ্রাচীর আছে। তবে দ্বীপগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশে তিমি, হাঙর বা দানবীয় মন্টারের সঙ্গে সাঁতার কাটার মতো অজানা কিছু অভিজ্ঞতাও হতে পারে।

১২

অনেকটা ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’র মতোন ভ্রমণানন্দেও মালদ্বীপকে জানার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। অনেকের কাছেই মালদ্বীপ গ্রীষ্মম-লীয় দ্বীপপুঞ্জ, স্বচ্ছ ফিরোজা জল এবং পানির ওপর বিলাসবহুল ওয়াটার ভিলা। তবে বিশ্বমানের রিসোর্টগুলোর বাইরেও ওই দ্বীপ রাষ্ট্রটি নিজস্ব ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। মালদ্বীপের নিজস্ব অনন্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। ভারত মহাসাগরের প্রান্তের চারপাশের বিভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হলেও মালদ্বীপের সংস্কৃতি, কারু ও ঐতিহ্যগুলো দ্বীপের পরিবেশ এবং চারপাশের সমুদ্র দ্বারা প্রভাবিত। ‘দিভেহি’ মালদ্বীপের মানুষের মাতৃভাষা। আর বর্তমান লিপি ‘থানা’ অনন্য। ষোড়শ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে আরবি সংখ্যা থেকে এর বিকাশ হয়েছে। এ দেশের জনগণ নৌযান নির্মাণে পারদর্শী। মালদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী নৌকা ধোনিকে বহু শতাব্দী ধরে বর্তমান রূপ দেয়া হয়েছে। সাগরের বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে এটি মানানসই। ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো মূলত মাছ ও নারকেলভিত্তিক। এই অঞ্চলে এমনটি আর কোথাও নেই। মালদ্বীপের সংগীত ও নৃত্যে পূর্ব আফ্রিকা, আরব ও ভারতীয় উপমহাদেশের জোরালো প্রভাব রয়েছে। এ দেশের কারুকাজের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। কাঠের অলংকার, সূক্ষ্মভাবে বোনা নলখাগড়ার মাদুর এবং প্রবাল খোদাই কারুশিল্প কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।

১৩

সব জায়গাতেই বাঙালিদের দেখে একবারও মনে হয়নি যে আমি দেশের বাইরে কোথাও আছি। মাফুশির শিশুপার্কে বাংলা ভাষায় নোটিশ পড়ে সেই ধারণা আরো জোরালো হয়। আর তাই তো পুরনো না হওয়া, চমকে যাওয়া বিচিত্র প্রকৃতির প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল লীলা-খেলার মাঝেও খুঁজে ফিরি দেশটি সম্পর্কে। জানতে পারি, দেশটির জনসংখ্যা পাঁচ লাখের অধিক এবং অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। বিচ্ছিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও মালদ্বীপ বিগত দুই দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে। গত প্রায় এক যুগ ধরে ৬ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এবং মাথাপিছু আয় প্রায় ১৭ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে ইতিমধ্যে মালদ্বীপ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। মালদ্বীপের শিক্ষার হার প্রায় ১০০ শতাংশ। জনগণের গড় আয়ু ৭৮ বছর। এসবের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সেবা জনগণের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে সরকার। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর থেকে দুই দেশ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক সংকটে বাংলাদেশ সব সময় মালদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সুনামি-পরবর্তী সময়ে এবং মালেতে খাবার পানি সংকটে বাংলাদেশ দ্রুত মানবিক সহায়তাসহ মালদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপে প্রায় এক লাখের অধিক প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে, যা দেশটিতে কর্মরত মোট প্রবাসী কর্মীর প্রায় ৭০ ভাগ। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখানে নির্মাণ, পর্যটন, বিপণন, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মালদ্বীপ সরকারের গৃহীত নিয়মিতকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করছেন জেনে ভালো লেগেছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রিয় প্রবাসীদের নানান চাওয়া-পাওয়ার প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও সেখানকার দূতাবাস কর্তৃপক্ষ আরও সুনজর দেবেন বলেও প্রত্যাশা করছি।

১৪

শতভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ হয়েও, বিগত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ পৃথিবীর সেরা পর্যটক গন্তব্যের স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। সেটার প্রমাণ মেলে আমাদের ভ্রমণকালে। দেখে মুগ্ধ হয়েছি সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে সরকারি নীতির সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য কীভাবে পর্যটক বান্ধব স্বর্গরাজ্য  তৈরি করা হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হওয়া মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশেও এমন কিছু করার সম্ভাবনা থাকলেও, তা রয়ে গেছে শুধু কাগুজে বক্তব্যে। মালদ্বীপ মুসলিম দেশ হলেও মেয়েদের পোশাক পরিধানের ব্যাপারে কোনো বাধ্য বাধকতা নেই। মালদ্বীপের রাজধানী মালে কিংবা মাফুশির রাস্তায় স্থানীয় নারী মানেই বোরকা আর হিজাব পরা। এটি দেখে যারা কট্টর রক্ষণশীল মালদ্বীপের কথা ভাবছেন, তারা জেনেছেন বিগত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর সেরা পর্যটক গন্তব্যের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে মালদ্বীপ। সেটা অকারণে হচ্ছে না। ভ্রমণকারীদের চাহিদা পূরণের প্রেক্ষিতেই পর্যটনশিল্প দাঁড়িয়ে আছে। মালদ্বীপ একটি মুসলিম দেশ বলে পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের তাদের নিয়মকে সম্মান করার জন্য অনুরোধ করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র প্রাইভেট আইল্যান্ডে, রিসোর্টগুলোতে অ্যালকোহল বা মদ্যপানের অনুমতি রয়েছে। তবে ভাসমান বিলাসবহুল নৌ- তরীতেও বার ও নাচ-গানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। মালদ্বীপের অধিকাংশ রিসোর্ট সমুদ্রের মধ্যে কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত। এসব রিসোর্টে থাকতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। দেশটিতে সরকার পর্যটনের জন্য শুধু নীতি সহায়তা দেয়। আর বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের মতো করে পর্যটন ব্যবসা করছেন। এর জন্য যত প্রকার সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা যায় তার সব কিছুই করছে বেসরকারি খাত। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মত ও পথ যাই থাকুক না কেন, তারা পর্যটনকে শতভাগ নিরাপদ, নির্বিঘ্ন আর ঝামেলাহীন রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কারণ দেশটির মোট আয়ের ৭০ ভাগই আসে পর্যটন খাত থেকে। পর্যটনের মূল আকর্ষণ হলো রিসোর্ট আইল্যান্ড। সেখানে বিশ^ায়নের যুগে সেবার সহজীকরণ ও আন্তর্জাতিকীকরণের দেখতে পাই। আগত পর্যটকদের চাহিদা পূরণের প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে প্রয়োজনীয় আনন্দ উপাদানগুলোর জোগান দিয়ে সহজেই মন জয় করেছে মালদ্বীপের ব্যবসায়ীরা। নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সকলের প্রত্যাশার প্রতি মনোযোগ দেয়ায় সব ধরনের সংস্কৃতির মানুষই এখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আর এভাবেই এই পর্যটনই দুই দশকে দেশটির অবকাঠামোকে ইউরোপ মানে নিয়ে গেছে। আর তাই মালদ্বীপে বাংলাদেশি কর্মী ভাইদের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য মনে করি, পর্যটনে মালদ্বীপের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের প্রধানতম বাধা পর্যটনখাত নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের এই খাতটিকে বুঝতে না পারা। বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপকালে এই দেশটি থেকে পর্যটনের শিক্ষা নিতে পারলে বাংলাদেশেও বিপুল সম্ভাবনার এই খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন সেখানকার পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বাংলাদেশের জন্য অনুসরণযোগ্য হতে পারে পর্যটনে মালদ্বীপ ব্যবস্থাপনা মডেল।

১৫

দু’দণ্ড শান্তি পেতে মালদ্বীপ আমাকে আজো কাছে টানে ভ্রমণের আগের চেয়েও গভীর আকর্ষণে, প্রবলভাবে। মহাসাগরের ‘আকাশে উড়িয়ে বকপাতি’র দিকে তাকিয়ে থাকা উদাস ভ্রামণিকের মনে স্বামী রামকৃঞ্চ পরমহংসদেব যেমনটি বলেছিলেন- ‘সংসার, ভোগ-বাসনা যতদিন থাকবে, ততদিনই কেউ কর্মত্যাগ করতে পারে না’ চরণ স্মরণে এলেও মালদ্বীপে গেলে এই কর্মকথা ভুলে যেতেই হয় যেন। জীবনের সব কোলাহল ভুলে আমি বার বার যেতে চাই মালদ্বীপের নীল জলের কাছে, বালুকাবেলায় সমুদ্রের স্বাদ নিতে। মালদ্বীপের মোহন মায়ার আবেশ, আবেগ আমাকে নিত্য জীবনানন্দে স্নাতক করে, করে যাবে আমৃত্যু- এ নিয়ে কোনো দ্বিধা-সংশয়ই নাই একটুও। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status