ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

পুরান ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব

বাবর আশরাফুল হক

(১১ মাস আগে) ২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৭:০২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:৩৬ পূর্বাহ্ন

mzamin

আমার জন্ম হয়েছে পুরান ঢাকা ১৯ নম্বর ইসলামপুর রোডের বাড়িতে। বর্তমানে ইসলামপুর বাংলাদেশের প্রধান পাইকারি কাপড়ের মার্কেট। আর আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকের জীবনটা কেটেছে ১০৭ কেপি ঘোষ স্ট্রিট আরমানিটোলার বাড়িতে। এর  অর্থ আমার শৈশব ও ছাত্রজীবনের সিংহভাগই কেটেছে পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার শৈশবের সেই মধুর স্মৃতিগুলো কখনো ভুলবার নয়। কখনো ভুলে যাইনি আমার স্কুল জীবনের বন্ধুদের। সে সময়কার খেলাধুলা, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক মেলবন্ধনের কথা। আমি পড়তাম পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সে সময় এ স্কুলটি পড়ালেখা ও খেলাধুলায় ছিল খুবই ভালো। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ ক্যাম্পাসে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছিল।

বিজ্ঞাপন
স্কুলটিতে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল ও হকিসহ সব ধরনেই খেলাধুলার সুব্যবস্থা ছিল। স্কুলটিতে বড় বড় চারটি খেলার মাঠ ছিল। আরও ছিল বাস্কেটবল কোর্ট ও বিশাল জিমনেসিয়াম। আমাদের স্কুলের ছাত্ররা সব খেলায়ই ছিল পারদর্শী। প্রায় প্রতি বছরই ইন্টার স্কুল হকি টুর্নামেন্টে আমাদের স্কুল চ্যাম্পিয়ন হতো। মাঝে মাঝে ফুটবল ও বাস্কেটবলেও আমাদের স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি ছাত্রজীবন থেকেই একটু দুর্বল ও ভিতু ছিলাম। তাই কিঞ্চিৎ ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিকেট, ফুটবল বা হকি খেলতাম না। সব সময় খেলতে পছন্দ করতাম টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন ভলিবল এবং বাস্কেটবল। 

আমাদের স্কুল থেকে তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় দল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় দলে অনেকে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রতাপ শংকর হাজরা, আব্দুস সাদেক, আব্দুর রাজ্জাক সোনামিয়া ওরফে টাইগার রাজ্জাক, ইব্রাহিম সাবের, সাব্বির ইবনে ইউসুফ, বশির আহমেদ, তারেকসহ আর অনেকে। এদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক, সোনামিয়া তদনীন্তন পাকিস্তান হকি দলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার সময় চমৎকার ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য তাকে টাইগার রাজ্জাক উপাধি দেয়া হয়। সে সময় পাকিস্তান হকি দল মাঝে মাঝেই অলিম্পিক ও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতো। এদের মধ্যে আমাদের স্কুলের আরেক গুণী ছাত্র প্রতাপ শঙ্কর হাজরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তখন প্রতাপ শঙ্কর হাজরার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ফুটবল দল ভারতের অনেক শীর্ষস্থানীয় দলকে পরাজিত করেছে। এসব খেলাধুলা ছাড়াও তখন পুরান ঢাকায় ঘুড়ি বা ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন ছিল। কিশোর, তরুণ, যুবকসহ বয়স্করাও ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করতো। অপরাহ্নের পর থেকেই পুরান ঢাকার আকাশে নানা রং-বেরংয়ের ও  নানা আকারের ঘুড়ি উড়তে দেখা যেতো। সে সময় পুরান ঢাকায় প্রায় সব বাড়িই ছিল একতলা, দোতলা বা তিনতলা বাড়ি। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ছাদেই কাউকে না কাউকে ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যেতো। ঘুড়ি ওড়ানোর অনুসঙ্গ হিসেবে পাওয়া যেতো নানা আকৃতির নাটাই, রং-বেরংয়ের ঘুড়ি ও নানান ধরনের সুতা। সুতা কিনে সে সুতাতে মাঞ্জা দেয়া হতো। মাঞ্জা ধারালো করে সে সুতা দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হতো। বিভিন্ন বাড়ি থেকে ওড়নো ঘুড়ির মধ্যে কাটাকাটি খেলা হতো। এক উড়ন্ত ঘুড়ির নিচ দিয়ে আরেক উড়ন্ত ঘুড়ি ঢুকিয়ে জোরে টান দেয়া হতো, তখন যে ঘুড়ির সুতা কম ধারালো সেটা কেটে যেতো। ঘুড়ির সুতা কেটে যাওয়াকে বলা হতো বাকাট্টা। পুরান ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানোটা ছিল বিরাট উৎসব। রেলিংবিহীন ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে যেয়ে ছাদ থেকে পড়ে অনেক মৃত্যুর খবরও শোনা যেতো। 

 

সাকরাইন ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসবের দিন। পৌষ মাসের শেষ দিন পৌষ সংক্রান্তির এ উৎসব। এ সাকরাইনেই ঘুড়ি ওড়ানোর মহাউৎসব হতো। সাকরাইন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবটি উদ্যাপন করে থাকেন। পৌষ মাসের শেষদিন ঢাকার মতো সারা ভারতবর্ষেই পৌষ সংক্রান্তি উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। বৃহত্তর বাংলায় দিনটিকে পৌষ সংক্রান্তি আর ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় এ দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলা হয়। পৌষ মাসের শুরু থেকেই পুরান ঢাকার মানুষ পৌষ সংক্রান্তি উৎসবের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নাটাই, সুতা ও ঘুড়ি ব্যবসায়ীরা তাদের মজুত বাড়াতে থাকে। সারা বছরই ঘুড়ি ওড়ানো হলেও সাকরাইনের দিনই ঘুড়ি ওড়ানোর প্রধান উৎসবের দিন। আমার মায়ের মুখে শুনেছি ঢাকার নবাবরা খুব জাঁকজমকের সঙ্গে এ উৎসবটি পালন করতো। উৎসবটিকে কেন্দ্র করে এর জন্য ব্যাপক আয়োজন করতো ঢাকার নবাবরা। নানা আকার ও বর্ণে ঘুড়ি তৈরি করা মজবুত ও ভারী নাটাই তৈরি করা। কখনো কখনো কাঠ-বাঁশ-লোহা ও পিতল দিয়েও নাটাই তৈরি করা হতো। সুতাকে ধারালো করার জন্য সিরিষ, রং ও কাঁচের গুড়া বা কাঁচের চুর জোগাড় করতে হতো। তখন সেলাই করার জন্য সিংহ মার্কা মজবুত ব্রান্ডের সুতার রিল পাওয়া যেতো, মূল্য ছিল ছ-আনা। এ ছাড়া অন্য ব্রান্ডেরও সুতা পাওয়া যেতো। তবে মজবুত ব্রান্ডের সিংহ মার্কা সুতারই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। হাঁড়িতে পানি দিয়ে তার মধ্যে সিরিষ ও ৫৫৫ রং মিশিয়ে চুলায় জাল দিতে হয়। সিরিষ গলে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে। তারপর সুতা রিলের চোং-এর ভেতর একটা কাঠি বা মোটা তার ঠুকিয়ে হাঁড়ির রং দেয়া গলিত সিরিষের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হবে। আর এ অবস্থায় সুতার মাথা নাটাইয়ে বেঁধে পেঁচিয়ে নিতে হবে। শিরিশ মাখানো ভেজা সুতাগুলো হাঁড়ি থেকে নাটাইতে পেঁচানোর সময় একজনকে কাগজ বা কাপড়ের মধ্যে কাঁচের গুঁড়াগুলো এমনভাবে ধরে রাখতে হতো যাতে করে শিরিশ ও রং মাখানো সুতাগুলো কাঁচের গুঁড়ার ভেতর দিয়ে যায়। এভাবে পুরো রিলের সুতার মধ্যে কাঁচের গুঁড়া লাগানো হয়ে গেলে বার কয়েক এক নাটাই থেকে আরেক নাটাইয়ে সুতা পেঁচিয়ে তা শুকিয়ে নিতে হতো। এক নাটাই থেকে আরেক নাটাইয়ে সুতা পেঁচানোর কাজটি অবশ্যই রোদে দাঁড়িয়ে করতে হতো। যাতে দ্রুত ধার দেয়া সুতা শুকিয়ে যায়। সুতা না শুকিয়ে রাখলে শিরিশ মাখানো আঠালো সুতা জমাট বেঁধে যেতে পারে। এ জন্য মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে কখনো কেউ সুতায় মাঞ্জা দিতো না। মায়ের কাছে আরও শুনেছি ঢাকার নবাবরা সাকরাইনের দিনে ঘুড়ির মধ্যে টাকা লাগিয়ে ঘুড়ি ওড়াতেন এবং কাটাকাটি খেলতেন। 


ঐতিহাসিক তথ্যমতে পৌষ সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ সাকরাইনের দিন ঐতিহ্য অনুযায়ী ঘুড়ি বা ঘুড্ডি ওড়ানোই ছিল মূল উৎসব। সাকরাইনের দিন ঢাকাবাসী পিঠাপুলি ও উন্নত খাবার-দাবারের আয়োজন করতেন। রং-বেরংয়ের জামা কাপড় (বিশেষ করে লাল রংয়ের) পরিধান করতেন। কিন্তু কোনো রকম উচ্ছৃংখল হতো না। ইদানিংকালে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি পটকা ও আতশবাজি ফোটানো, উচ্চ শব্দে লাউড স্পিকারে বিদেশি গান বাজানো, ফানুস ওড়ানো, রাতে লেজার শো করা, ডিজে পার্টি করা ইত্যাদি। এসবের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে অশান্তি নেমে আসে। যা আমাদের নির্মল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিপন্থি। এদেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা-ঐতিহ্যবাহী পৌষ পার্বণসহ দেশীয় সংস্কৃতি নিষ্কলুষভাবে টিকে থাকুক। 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status