ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ আনন্দ ২০২৩

মুঘল ঐতিহ্যের হৃৎপিণ্ড আগ্রা

ড. মাহফুজ পারভেজ

(১ বছর আগে) ২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ২:৪১ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:২৯ পূর্বাহ্ন

mzamin

আমরা আগ্রায় প্রবেশ করি তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে। সারা উত্তর ভারতই তখন বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। মধ্য সেপ্টেম্বরের বর্ষণে কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব। বৃষ্টিভেজা সড়ক পথে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে আগ্রায় এসেই মুখোমুখি হলাম প্রবল বর্ষণের। 
মধ্যযুগে ভারতের রাজধানী আগ্রা নানা কারণে এখনো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত মুঘল স্থাপনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রাচীন আগ্রা। বাগিচা, প্রাসাদ ও দুর্গের নগরীতে ঢুকতেই গা ছমছমে ইতিহাসের পরশ পেলাম।
রাজনৈতিক ও যোগাযোগের দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলগত স্থান আগ্রায় প্রবেশের অনেকগুলো পথ রয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুঘল বিজেতারা দিল্লি জয় করলেও রাজধানী বানিয়েছিলেন আগ্রাকে। আগেকার মুসলিম শাসকদের হাতে গড়া রাজধানী দিল্লিকে ছেড়ে আগ্রায় ক্ষমতার মূলকেন্দ্র ও রাজধানী তৈরির পেছনে অনেকগুলো বিবেচনার মধ্যে আগ্রার কৌশলগত যোগাযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।
আগ্রা থেকে ভারতের সব দিকে যাওয়ার পথ সুগম। সব জায়গা থেকে আগ্রায় আসাও সহজ। উত্তর প্রদেশের অংশ হলেও আগ্রা দিল্লির কাছেই।

বিজ্ঞাপন
পাঞ্জাব থেকে সন্নিকটে। রাজস্থান, গুজরাট হয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দিকেও পথ উন্মুক্ত। মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র থেকেও আসা যায় আগ্রায়। আর লখনউ , আলীগড় ছুঁয়ে বিহারের পাটনা হয়ে বাংলায় যাতায়াতের সুবিধাও আগ্রার রয়েছে।

এক সময়ে ভারতের রাজধানী বা এক নম্বর শহর আগ্রা এখন উত্তর প্রদেশের চতুর্থ আর সারা ভারতের ২৪তম গুরুত্বপূর্ণ শহর। উত্তর ভারতের হিন্দি-উর্দু বলয়ের এই শহরের প্রধান ভাষা হিন্দুস্থানি তথা হিন্দি ও উর্দু। জনসংখ্যার ৮৫%ভাগ হিন্দু, ১০% মুসলমান আর বাকি জনসংখ্যা জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত হিন্দি পত্রিকা ‘দৈনিক জাগরণ’র প্রধান দপ্তর আগ্রায়, যদিও উত্তর ভারতের অন্যান্য শহর থেকেও পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় একযোগে।
আগ্রাকে বলা যায় উত্তর ভারত বা হিন্দি বলয়ের অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন কেন্দ্র। মুঘল স্থাপনা ছাড়াও এখানে আছে ক্যান্টনমেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা। আগ্রার প্রধান দ্রষ্টব্য তাজমহল, আগ্রার দুর্গ ও সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিজেট বা বিশ্বসভ্যতার অংশ। এগুলো ছাড়াও ছোট-বড় আরও বহু দর্শনীয় স্থান, বাগ-বাগিচা-উদ্যান ছড়িয়ে আছে আগ্রার সর্বত্র।
ভারতের প্রধান পর্যটন ডেসটিনেশন বা ভ্রমণ এলাকাকে বলা হয় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বা সোনালি ত্রিভুজ, যার একবাহু দিল্লিতে, আরেক বাহু জয়পুরে এবং অন্য বাহু আগ্রায় মিশেছে। ত্রিভুজের মতো এই তিনটি এলাকাতেই ভারতের সিংহভাগ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। 

জয়পুর থেকে আসার কারণে আমরা পথে পেয়েছি উত্তর প্রদেশের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যার মধ্যে রয়েছে মথুরা ও বৃন্দাবন। জয়পুর-আগ্রা সুপার হাইওয়ে ধরে রিজার্ভ কারে চলতে চলতে সুবিধা মতো থেমে থেমে এগিয়েছি আমরা। পথের ধারে রাজস্থানী ধাবায় চা, নাস্তা করে দেখেছি ঊষর মরুময় প্রান্তরে সবুজের সমাবেশ। রঙ-বেরঙের শাড়ি ও ওড়নায় ঢাকা রাজস্থানের গ্রাম্য নারীদের। বিশালাকায় পাগড়ি মাথায় রাজস্থানের রাজপুত বা জাট। কখনো ময়ূরের সমাবেশ বা উটের বহর। 
গ্রামের দিকে পুরুষদের সবারই বড় পাগড়ি ব্যবহারের রহস্য বুঝতে গিয়ে দেখলাম, এর সঙ্গে ঐতিহ্য ও বাস্তব প্রয়োজন মিশে আছে। রাজস্থানের মরুময় ও ঊষর ভূমি থেকে প্রচুর ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। বিরাট পাগড়িতে নাক, মুখ, মাথা, শরীর ঢেকে ফেলার সুবিধা নিয়ে থাকেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
জয়পুর থেকে আগ্রা যেতে একটি পাহাড়ের ভেতরের সংক্ষিপ্ত টানেল পেরিয়ে ধরতে হয় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মাঝ দিয়ে প্রসারিত সুপার হাইওয়ে। ২০০ মাইলের এই দূরত্ব নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর। পথের পাশে হাট, বাজার ও ছোট ছোট শহর। আর আছে প্রতিমা ও পূজার মঞ্চ তৈরির কুটির শিল্প। মার্বেল ও গ্রাফাইট পাথর কেটে কেটে বানানো হয় মনোরম প্রতিমূর্তি, যেজন্য যোধপুর, কিষাণগড়, জয়সালমের থেকে আসে বাহারি পাথর।

রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের সীমানায় হিন্দু তীর্থক্ষেত্র মথুরা ও বৃন্দাবন জয়পুর-আগ্রা সড়কের পাশেই। ফলে পূজার সামগ্রী ও প্রতিমা বানানো আর বিক্রির জমজমাট বাজার চারপাশে। হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে এই নির্দিষ্ট স্থানে।  
সড়কের রাজস্থান অংশ পেরিয়ে উত্তর প্রদেশে ঢুকতেই হিন্দি ভাষা, পোশাক, পরিচ্ছদে পার্থক্য দেখা গেল। রাজস্থানের হিন্দিতে গুজরাতি, মাড়োয়ারি ও পাঞ্জাবি টান বদলে গেল। উত্তর প্রদেশের হিন্দিতে পাওয়া গেলো উর্দু আর বিহারি হিন্দির প্রভাব। হিন্দি ভাষার অনেকগুলো উপভাষা ও কথ্যরূপ আছে। যার মধ্যে মৈথিলি, ভোজপুরি, ব্রজবুলি ইত্যাদি অন্যতম। বিশাল উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ে চর্চিত হচ্ছে হিন্দি ভাষার একেকটি ধারা।    
মথুরা ও বৃন্দাবনে এক চক্কর দিতে গিয়ে পেলাম পেয়ারিলালকে। অবসর নিয়ে ‘ফৌজি ধাবা’ নামে জলপানির দোকান চালাচ্ছেন তিনি। চাকরি করেছেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামেও। ভাঙা ভাঙা বাংলা জানেন। ঢাকা ও বাংলাদেশের অনেক কথা বললেন তিনি।
কৃষ্ণের কারণে মথুরা আর রাধার জন্য বৃন্দাবন। স্থান দু’টি বৈষ্ণব ভাবধারার হিন্দুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মন্দির আর ভক্তের উপস্থিতিতে মুখর স্থানটি। একটির থেকে আরেকটি মোটামুটি নিকটবর্তী। তবে বৃন্দা বা তুলসী বন নামে পরিচিতি বৃন্দবনে নগরায়নের ফলে বনাঞ্চল কমছে। তবে ধর্মীয় আবেগ আর প্রেমের বাতাবরণ সেখানে এখনো অটুট। সংক্ষিপ্ততম চোখের দেখা দেখে ফিরে আসার সময় অজানন্তেই মনে বাজে দু’টি লাইন: “সে কি মথুরায় থাকে আমায় ভুলে/বাজে বাঁশি যুগে যুগে যমুনা কূলে।” 
ধর্মীয় ভক্তির নিদর্শন কিন্তু ভারতের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে খুবই স্পষ্ট। রাজস্থানের মুসলিম ধর্মীয় কেন্দ্র আজিম থেকে খানিক এগিয়ে গেলে টিলা ও মরুর উপান্তে পৃথিবীর একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির ‘পুষ্পক’। সেসব স্থানে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমাদের মূল আকর্ষণ যেহেতু আগ্রা, তাই পথের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে যথেষ্ট সময় দেওয়া যায় নি। এমনিতেই বৃষ্টি পিছু নেওয়ায় গাড়ির গতি কমিয়ে রেখেছে ড্রাইভার সুরজিৎ। এসিতে বসে গাড়ির এফএম রেডিওতে রাজস্থানী কান্ট্রি মিউজিক শুনতে শুনতে চলে এলাম আগ্রার কাছাকাছি। আগ্রার শহরে প্রবেশের আগে আগে পথে পড়লো বিখ্যাত ফতেহপুর সিক্রি। দিল্লি হয়ে এলে মূল আগ্রা শহর আগে পড়তো। আমরা বিপরীত দিক দিয়ে আসায় এ সুবিধা পেলাম। ভোরে রওয়ানা দিয়ে ১০টা নাগাদ ফতেহপুরের সামনে পৌঁছে গেলাম মূল সড়ক থেকে ডানে মোড় দিয়ে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। যদিও হাইওয়ে থেকে ফতেহপুরের প্রাচীর ঘেরা দুর্গ-সদৃশ্য বিশালাকায় নগরী দেখা যায়, তথাপি এতে প্রবেশ করতে হয় মূল সড়ক থেকে উপপথ পথ ধরে খানিকটা ভেতরে এসে। 
আমরা ঠিক করেছি দুপুরটা এখানে কাটিয়ে বিকেলে যাবো বিশ্বের বিস্ময় তাজমহলে। তারপর রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন অন্যান্য স্থানে। যমুনা তীরে স্থাপিত ইতিহাসের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় ঐতিহাসিক আগ্রা-ফতেহপুরের বৃষ্টিভেজা বাতাসের স্পর্শে কেমন একটা শিহরণ দোলা দিলো শরীর ও মনে। গাড়ি থেমে নামতে সময় লাগলো কিছুটা। তন্ময় চোখে ফতেহপুর সিক্রিতে প্রবেশের অতিকায় ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ নামের রাজকীয় তোরণের দিকে তাকাতেই মনে হলো ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছি ইতিহাসের অলিন্দে।
  
পরিত্যক্ত মুঘল রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে
ষোড়শ শতকে শুরু হয়ে (৩০ এপ্রিল, ১৫২৬) ঊনিশ শতকে সমাপ্ত (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭) কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে মাত্র ১৪ বছর রাজধানী ছিল ফতেহপুর সিক্রি। সে আমলে রাজা-বাদশাহের খেয়াল-খুশির অন্ত ছিল না। আর সেসব ছিল বড়ই বিচিত্র ও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের চেয়ে অনেক আলাদা। ফতেহপুর সিক্রিতে মিশে আছে সেইসব রাজসিক খেয়ালের খানিকটা ঝলক।
স্বল্প জীবনপ্রাপ্ত হলেও ফতেহপুর সিক্রির দীর্ঘ ইতিহাস ও তাৎপর্য আছে। ১৫৭১ সালে এখানে রাজধানী বানিয়ে তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালেই তা সরিয়ে নেন। ১৬১০ সালে শহরটি সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়। পরিত্যক্ত হয়ে নিঃসঙ্গভাবে পড়ে থাকে বিশাল স্থাপনাসমূহ, যা এখন ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যের অংশ। 
রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি ফতেহপুর সিক্রির সঙ্গে মিশে আছে আধিভৌতিক রহস্যময়তা। টুপটুপ বৃষ্টিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন রাজধানীর পাদদেশে দাঁড়িয়ে সেই পরশ এসে শরীরে লাগলো। খানিক অপেক্ষার পর বৃষ্টির আঁচ কমে এলে আমরা ফতেহপুরের ভেতরে প্রবেশ করি আর তখনো এর অতীত ও ইতিহাসের গুঞ্জন সঙ্গী হলো আমাদের। 
সম্রাট আকবর এখানে রাজধানী স্থাপন করার আগে সিক্রি নামের একটি গ্রাম ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এ জায়গাটি চিনতেন এবং পছন্দও করতেন। ফলে জায়গাটি মুঘলদের কাছে অচেনা-অজানা ছিল না। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সিক্রি নামটি সম্রাট বাবরের দেওয়া। বাবর এই এলাকটিকে বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য অনেকবার ব্যবহার করেছিলেন এবং সিক্রির নিকটবর্তী সীমান্তে রাজস্থান-পাঞ্জাব থেকে আগত মহারাজা রানা সংগ্রাম সিংহের বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন।

বাবরের জীবনীকার বেভারেজ লিখেছেন, রানা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে বাবুর এখানে ‘ফতেহবাগ’ বা ‘বিজয় উদ্যান’ নামে একটি বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্য এশিয়ান মুঘলদের উদ্যানপ্রীতি ছিল সর্বজনবিদিত। তারা যেখানেই কর্তৃত্ব করেছে, সেখানেই সুপরিকল্পিত বাগান বা উদ্যান বানিয়েছেন। বাগানকে তারা বলতেন ‘গুলিস্তাঁ’। আগ্রার চারদিকে শত শত বছর পরেও ছড়িয়ে আছে মুঘল রাজন্যদের উদ্যানপ্রেমের চিহ্ন। দিল্লি, ঢাকা, কাশ্মীর, লাহোর, সর্বত্র মুঘল-প্রতিষ্ঠিত বাগানের দেখা পাওয়া যায় এখনো।
ফতেহপুরে বাবুরের বাগান সম্পর্কে তার কন্যা ও সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী ‘হুমায়ূননামা’র রচয়িতা গুলবদন বেগম লিখেছেন, ‘বাবুর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন, যা তিনি বিনোদন ও লেখার কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি নিকটবর্তী ঝিলের মাঝখানে একটি বেদীও নির্মাণ করেন।      
সম্রাট আকবর রাজধানী বানানোর সময় (১৫৭১) আনুষ্ঠানিক নামকরণ করেননি। রাজকীয় ফরমান দিয়ে ‘ফতেহপুর’ বা ‘বিজয়ের শহর’ নামটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৫৭৩ সালে গুজরাট জয় উপলক্ষ্যে। তারও আগে, ১৫৬৯ সালে বেশ পরিণত বয়সে এইস্থানে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে আকবরের ঔরসে। আগে থেকেই এখানে শেখ সেলিম নামে একজন বুজুর্গ পিরের খানকাহ বা আশ্রম ছিল এবং পিরের দোয়ায় আকবর পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন বলে পুত্রের নামও রাখা হয় পিরের নামানুসারে, সেলিম, যিনি পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে খ্যাত। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় জন্ম দিনে আকবর এখানে রাজধানী নির্মাণও শুরু করেন।   

জয়পুর-আগ্রা হাইওয়ে থেকে ডানে মোড় দিয়ে যে গলিপথ, তাতে কিছুদূর এগিয়ে আবার ডানে কিঞ্চিত উপরের দিকে উঠতে হয় ফতেহপুর সিক্রিতে যেতে। আকবর বাদশাহের এই রাজধানী নগরীটি কিছুটা উচ্চভূমিতে অবস্থিত। নগরের প্রবেশের মুখেই ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ নামে বিশাল গেট। মধ্যযুগের বিবেচনায় সুবিশাল তোরণে এক সুপরিকল্পিত নগরীর প্রাচীন আবছায়া ভেসে আসে প্রথম দর্শনেই। মুঘল পূর্ব-পুরুষ তৈমুর লং প্রচলিত পারসিক আদালতের আদলে আকবর এটি নির্মাণ করতে চাইলেও এতে স্থানীয় স্থাপত্যরীতির মিশেল হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পার্শ্ববর্তী রাজস্থানে প্রচুর ও বিচিত্র বেলেপাথর থাকায় ভেতরের অট্টালিকাগুলো পাথুরে এবং অধিকাংশই লালচে রঙের।     
মুঘলরা ভারতকে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও স্থাপত্য উপহার দিয়েই শেষ করেনি, এখনো আয়ের পথ খুলে দিয়ে গেছে। টিকেট কেটে ঢুকতে হচ্ছে এসব স্থাপনায়। এতে ভারতীয়দের জন্য টিকেটের দাম কম হলেও বিদেশিদের জন্য যথেষ্ট উচ্চমূল্য। তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, কুতুব মিনারসহ বিভিন্ন মুঘল ও মুসলিম স্থাপনায় লক্ষ লক্ষ পযটক কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে ভারত সরকারের তহবিলে। টিকেটের পাশাপাশি দালাল ও গাইডের লম্বা বহর। সব কিছু চিনিয়ে-জানিয়ে দেওয়ার জন্য পিছু নেয় তারা। ভারতের মুঘল ঐতিহ্য এমনই এক নিঃশেষ-না-হওয়া বিষয়, যা এখনো খুলে রেখেছে রোজগারের পথ!

বৃষ্টির কারণে ফতেহপুর সিক্রিতে ভিড় কম। দালাল ও গাইডরাও তেমন নেই। ড্রাইভার সুরজিৎ সঙ্গী হলো। রাজপুত যুবক এ পথে পযটক আনা-নেওয়া করতে করতে ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থান-কাল সম্পর্কে বেশ ওয়াকেবহাল। যথারীতি ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ দিয়েই প্রবেশ করি আমরা। তবে ‘বাদশাহী দরওয়াজা’ নামে আরেকটি প্রবেশদ্বারও রয়েছে। লাল-হলুদ বেলে পাথরে নিমির্ত ফটকে সাদা-কালো মার্বেল দিয়ে নকশা করা। মাটি থেকে ৫৪ মিটার লম্বা দরওয়াজা পযন্ত পৌঁছাতে ৪২টি সিঁড়ির ধাপ উঠতে হলো। দরজার পাল্লাগুলো কাঠের কারুকাজ করা এবং এর মাথায় এক সারি প্যারাপেট ও পেছনে তিনটি ছত্রী রয়েছে। মূল দ্বারের দেওয়ালে খোদাই করা আছে ধর্মকথা, যাতে এই বিশ্বের নশ্বরতার উল্লেখ করে অবিনশ্বর সৃষ্টিকর্তার গুণ কীর্তন করা হয়েছে। বুলন্দ বা সুমহান নামে খ্যাত প্রবেশ তোরণে সৃষ্টিকর্তার মহিমাব্যঞ্জক বাণী থাকাই স্বাভাবিক।
ফতেহপুরের ভেতরে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ, যেখানে জ্যামিতিকভাবে সজ্জিত বেশকিছু চাতাল দেখা গেল। রয়েছে বুজুর্গ-পীর সেলিম চিস্তির মাজার শরীফ। দুর্দান্ত শিল্প ভাবনা ও নান্দনিক স্থাপত্যের ফতেহপুর সিক্রির চারদিকে তাকিয়েই নিজের বোকামির জন্য লজ্জিত হলাম। বৃষ্টিসিক্ত বিরূপ আবহাওয়া আ স্বল্প সময় নিয়ে এখানে আসার কোনো মানেই হয় না। পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করে দেখতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে এখানে আসাই শ্রেয়। তা না হলে দুই মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া প্রাসাদ আর প্রাঙ্গণ দেখা মোটেও সম্ভব নয়।

পুরো ফতেহপুর সিক্রি পাঁচ মাইল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মনে করা হয়, রাজপুত, জাঠ, মারাঠা, শিখ আক্রমণের কারণে শহরটিকে দুর্গ-সদৃশ্য করা হয়েছে। আগ্রা দুর্গও তেমনি। রাজস্থানেও দুর্গ শহর দেখেছি। মধ্যযুগের শহরগুলো সামরিক নিরাপত্তার কারণে সুদৃঢ় প্রাচীর বেষ্টিত দেখতে পাওয়া যায়। আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো, শত শত বছর পরেও প্রাচীর বেশ মজবুত ও সুরক্ষিত। 
সুললিত ও সুসজ্জিত ফতেহপুর আবাস দেখে মুঘলদের পরিচ্ছন্ন রুচি ও গুছানো প্রশাসনিক কাযক্রমের নমুনা বোঝা যায়। রাষ্ট্রীয় কাজ, বসবাস ও অন্যান্য তৎপরতায় জীবনকে চমৎকার অবকাঠামোয় প্রবাহিত করেছিলেন মুঘলরা। তৎকালের ভারতে সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, খাদ্য, উন্নত প্রশাসনের পাশাপাশি দিয়েছিলেন স্থাপত্য সুষমায় বিস্তৃত বসবাসের আমেজ।
হাতের সময়কে যথাসম্ভব কাজে লাগানোর পরও ফতেহপুর সিক্রি পুরো ঘুরে না দেখতে পারার অতৃপ্তি নিয়ে ফিরতে হলো। ভেতরে অনেক ছোট বড় স্থাপনা, মহল, প্রাঙ্গণ এবং এসবের ইতিহাস ও শিল্প গুণ পরখ করে দেখার জন্য পুরো একটি দিনও মনে হয় যথেষ্ট নয়। অনুচ্চ ফতেহপুর সিক্রির চারপাশে প্রসারিত বিশাল ভারতের সবগুলো দিক, যেখানে বসে মধ্য এশিয়ার পারস্য-তুর্কি-মোঙ্গল শিল্প ঐতিহ্যের ভারতীয় সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুঘলরা। 
কয়েক শত বছর মুঘলরা ভারত শাসন করে চুঘতাই তুর্কি ও পার্সি ভাষা ও সংস্কৃতি ছেড়ে হিন্দি ও উর্দুর সঙ্গে এদেশীয় অনেক কিছুই নিয়েছিলেন। ফতেহপুর সিক্রিতে দাঁড়িয়ে মনে হলো, তারা ছিলেন মিলনের দূত। তারা না ছিলেন বিদেশি, না ছিলেন এদেশীয়। তারা ছিলেন এ উপমহাদেশে সংস্কৃতি, শিল্পকলার সমন্বয়ের প্রতীক। উন্নত সকল কিছুর মিশ্রণে ও ভালোবাসায় ভারতকে তারা সাজিয়ে ছিলেন।

মুঘলরা একই সঙ্গে তৈমুর ও চেঙ্গিস খানের বংশধারার ঐতিহ্য বহন করলেও তাদের ধমনীতে মিশেছিল এদেশের রক্ত। এজন্যই তারা ছিলেন দেশজ কাঠামোতে উত্তর-পুরুষের ঐতিহ্যের সমন্বয়ক। ইতিহাস বলে, শুধুমাত্র বাবর ও হুমায়ূন ছিলেন প্রকৃত মধ্য এশীয়। আকবর ছিলেন পার্সিয়ান হামিদা বানুর গর্ভজাত অর্ধেক ইরানি। মাতা যোধাবাঈ’র কারণে জাহাঙ্গীর ছিলেন অর্ধেক রাজপুত। পূর্বের বাংলা থেকে পশ্চিমের কাবুল আর উত্তরের কাশ্মীর থেকে দক্ষিণের কাবেরী নদী পর্যন্ত শাসন করেছিলেন তারা সমন্বয় ও মিলনের মাধ্যমে। ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষকে নিয়ে যে সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে মুঘলরা শাসন করেছিলেন, তা ছিলো তৎকালীন বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এবং সমৃদ্ধতম দেশ, যার অপসৃয়মান ঝলক এখনো মিশে আছে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, ঢাকা এবং সংক্ষিপ্ততম রাজধানী ফতেহপুর সিত্রির সুনিপুণ বিন্যাসে।        
ফতেপুর সিক্রির শান বাঁধানো চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে অতীত ঐতিহ্যের সেইসব কথা প্রতিধ্বনি তুলে। বার বার মনে জাগে, শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট ও নগরের গোড়াপত্তনকারী আকবরের কথাও। স্বল্প সময়ের রাজধানী হলেও ফতেহপুর সিক্রিতে আকবর তার অভিনব দ্বীন-ই-ইলাহি বিষয়ে নানা ধর্মের প-িতদের সঙ্গে আলোচনায় মত্ত হতেন। নিঃসন্তান আকবরের শেষজীবনে একমাত্র পুত্রও পির সেলিম চিস্তির দোয়ায় ভূমিষ্ঠ হয় ফতেহপুরের মাটিতে। আর এখানেই পরবর্তীকালে শেষ দিকের মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের প্রতিনিধি সৈয়দ হাসান আলী খানকে হত্যা করা হয় ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদারদের ইঙ্গিতে। মুঘলরা দুর্বল হলে এই পরিত্যক্ত রাজধানী কখনো মারাঠা, কখনো রাজপুত, জাঠ বা শিখ জাতির দখলে আসে। সর্বশেষে ইংরেজরা ভারত দখল করে তারা এখানে গড়ে সেনা ছাউনি। এতো কিছুর হয়েেেছ এই সংক্ষিপ্ত রাজধানী শহরে। ফলে এখানে রয়েছে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পাশাপাশি আনন্দ ও বেদনার অশ্রু। বৃষ্টিভেজা ফতেহপুর সিক্রি ঘুরে ফিরে আসার সময় সেসব কথাই বার বার দোলা দেয় মনে।

প্রেম ও বেদনার মহাকাব্য 
তাজমহলের সামনে এসে আমি বৃষ্টির সঙ্গে ভেঙে পড়লাম বিষাদে। পৃথিবীর সপ্তমার্শ্চয শ্বেতমর্মরকাব্য নামে পরিচিত তাজমহলও কম বেদনার্ত নয়। যার বুকের উপর দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য সুষমাময় তাজ, সেই মমতাজ মহল দেখতে পারেননি তাজকে। প্রেমে ও আবেগে আপ্লূত নির্মাতা সম্রাট শাহজাহানও বন্দি জীবন কাটিয়েছেন অদূরের আগ্রা দুর্গে, সেখান থেকে তাজের দিকে চেয়ে চেয়ে তার চোখ হয়েছে অশ্রুসিক্ত। হৃদয় হয়েছে রক্তাক্ত। কারণ তাজের চত্বরে সমাহিত করা হয় তার প্রিয় পুত্র, ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত দারাশিকোহ’র মস্তকবিহীন দেহ। 


আরজুমান্দ বানু নামে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর ফুফু ছিলেন মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। ১৬০৭ সালে পারস্য বংশধারার এই কিশোরীর প্রেমে পড়েন শাহজাদা খুররম, যিনি পরে পরিণত হন সম্রাট শাহজাহান নামে। প্রেম ও পরিচয়ের পাঁচ বছর পর ১৬১২ সালে আরজুমান্দকে বিয়ে করে শাহজাহান নাম দেন মমতাজ মহল বা প্রাসাদের রত্ন। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের শেষে ১৪তম সন্তানের (কন্যা গওহর বেগম) জন্ম দিতে গিয়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মমতাজ মারা যান। ব্যথিত শাহজাহান, আরও স্ত্রী থাকার পরেও মমতাজের প্রেম ও স্মৃতি ভুলতে পারেননি। মমতাজের সমাধিস্থলে তাজমহল নির্মাণ শুরু করেন তিনি।   
১৬৩১ সালে মমতাজের মৃত্যুর পরের বছর (১৬৩২) শাহজাহান তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মূল সমাধি ছাড়াও উদ্যান আর অন্যান্য স্থাপনা নিয়ে তাজমহল নামে বিরাট কমপ্লেক্সের মূল নির্মাণ ১৬৪৮ সালে এবং সামগ্রিক নির্মাণ কাজ ১৬৫৩ সালে শেষ হয়। অনেক শিল্পী ও নকশাকারক ছাড়াও দেশ-বিদেশের ২০ হাজার সুদক্ষ কর্মী জড়িত ছিলেন তাজমহল নির্মাণে। এদের মধ্যে উস্তাদ আহমেদ লাহোরীর নাম রয়েছে সর্বাগ্রে। এছাড়াও পারস্য থেকে আনা হয় স্থপতি ঈসাকে। বেনারসের পুরু নামের একজন কিছু কাজ করেন। বড় গম্বুজটির নকশা করেন উসমানিয়া সাম্রাজ্য থেকে আগত তুর্কি শিল্পী ইসমাঈল খান। বড় গম্বুজের শীর্ষে স্বর্ণের দ- নির্মাণ ও স্থাপন করেন লাহোরের কাজিম খান। পাথর খোদাইয়ের কাজের নেতৃত্ব দেন দিল্লির ভাস্বর চিরঞ্জিলাল। পারস্যের সিরাজ থেকে এসেছিলেন চারুলিপিকর আমানত খান, যার নাম তাজমহলের প্রবেশ পথের দরজায় প্রত্যায়ন করা হয়েছে। পুরো কাজের রাজমিস্ত্রীদের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ হানিফ। ইরানের মীর আ. করিম ও মুকার্রিমাত খান সমগ্র কাজের ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক হিসাবের দায়িত্বে ছিলেন। মোটামুটি এমন কয়েকজনের নাম নানা সূত্রে উল্লেখিত হলেও তাজমহলের পেছনে আরও বহু শিল্পী ও শ্রমিক যে নিয়োজিত ছিলেন তা এর বিরাট এবং সূক্ষ কাজের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।   

তাজমহলে প্রবেশের তিনটি গেট আছে। যানবাহনের কালো ধুয়া তাজমহলের শুভ্রতা সৌন্দর্য ম্লান করছে বলে বেশ দূরে গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। আমরা নগরীর রাজপথ ছেড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে তাজমহলে প্রবেশের অপেক্ষাকৃত গলিতে পথের মুখে আসি। সেখানে বেজায় ভিড়। গাইড, টাঙ্গা, ব্যাটারিচালিত ও মানবচালিত রিকশার হট্টগোল। আরও আছে হুইল চেয়ারের সারি এবং গাইডের দল। এদের এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াও বেশ মুশকিল। বছরে যাকে দেখতে ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন পর্যটক আসেন, সেখানে ভিড় হবে না তো কোথায় হবে!
তাজমহলের আশেপাশে প্রাচীন মুঘল ধরনের নগর বিন্যাস দেখা গেল, যদিও পুরনো কাঠামো বদল করে অস্থায়ী দোকান, হোটেল গড়ে উঠেছে সেখানে। জায়গাটির নাম তাজগঞ্জি বা মুমতাজাবাদ। তাজের দক্ষিণ দিকে এলাকাটি নির্মাণ করা হয়েছিল দর্শনার্থীদের জন্য থাকার সরাইখানা ও অন্যান্য প্রয়োজনে। এখন নানা দোকানে ঘিঞ্জি অবস্থা। এসব ভিড় ঠেলেই আসতে হলো মূল ফটকের কাছে এবং যথারীতি টিকেট কেটে ঢুকতে হলো ভেতরে।   

তাজমহল আসলে একটি নয়, অনেকগুলো স্থাপনার মিলনে একটি উদ্যানময় কমপ্লেক্স। মমতাজের মূল সমাধিস্থলই তাজমহল নামে পরিচিতি। তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার ভিত্তিতে, যাতে মুঘল, পারস্য, তুর্কি, তৈমুর প্রভাব রয়েছে। সমরখন্দে তৈমুর নির্মিত ‘গুর-ই-আমির’-এর পরোক্ষ প্রভাব এখানে কেউ কেউ লক্ষ করেন। যদিও মুঘলদের দুর্গ, লালকেল্লা, জামে মসজিদ, দেওয়ানে খাস, দেওয়ানে আম ইত্যাদিতে মধ্য এশীয় প্রভাব সুবিদিত।
তাজমহলের ক্ষেত্রে ভবন, মিনার, কারুকাজ, লিপি, অলঙ্করণ ইত্যাদির মধ্যে সুসমন্বয় রক্ষা করা হয়েছে চমৎকারভাবে। বাগানের বিন্যাসেও মুঘল, পারস্য, তুর্কি শিল্প ও স্থাপত্য কলাকে একাকার করা হয়েছে। প্রথম দর্শনের সবুজ গালিচাময় পুষ্পিত বাগানের মধ্যে শ্বেত-শুত্র তাজমহল ও পুরো কমপ্লেক্সকে দেখে মনে হয়েছে শান্ত-সমাহিত এমন এক উদ্যান, যা পৃথিবীর কোলাহল ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে একখ- নান্দনিক আরাম।

খুব কাছে নয়, তাজমহলের সামনের চত্বরের বাগান থেকে তাজের সামগ্রিক সৌন্দর্য প্রস্ফূটিত হয় সবচেয়ে বেশি। বাগানটি চারটি অংশে বিভক্ত এবং একে বলা হয় চারবাগ বা চারটি বাগান। বাগানের মাঝখানে স্বচ্ছ জলের চৌবাচ্চা, যেখানে তাজমহলের প্রতিবিম্ব জলে টলমল করে। ভেতরের পুরোটাই পাকা সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত, যার চারপাশ পুষ্পিত ও বৃক্ষময়। 
তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। এতে মমতাজের বড় ও আরও কয়েকটি ছোট সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। এতে লাল বেলে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। সমাধি ছাড়াও দেয়াল, স্তম্ভ ইত্যাদি অপূর্ব নান্দনিক অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। বরফি-কাটা ঝালর, খিলান, প্রভৃতির জ্যামিতিক বিন্যাস পুরো স্থাপনাকেই শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বলতর করেছে। তাজ কমপ্লেক্সে অনন্য সুন্দর একটি মসজিদও রয়েছে। 
শুধু ভবন নয়, প্রসারিত দেয়াল আর তাজমহলের গম্বুজ ও মিনারের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে কোনও ক্লান্তি আসে না। কেন হাজার হাজার মানুষের এতো বছর লেগেছিল তাজমহল বানাতে, তা টের পাওয়া যায় শৈল্পিক কাজের দিকে নজর দিলে। গম্বুজ ও মিনারের সৌন্দয ছাড়াও কারুকাজ, জালির কাজ, অলঙ্করণ, হস্তলিপি, খোদাই, সূক্ষ্ণ কাট-স্টাইলে দেয়াল বা আচ্ছাদনের ঝালক পুরো আযোজনকে একটি সামগ্রিক শিল্পকর্ম বা আর্টপিসে রূপ দিয়েছে। দূরের তাজমহল কাছে থেকে দেখলে মনে হয়, রাজকীয় পোশাক পরিহিত তার প্রতিটি অঙ্গ ও অংশ। প্রতিটি স্থানে শিল্পীর নানা রকমের স্পর্শ উদ্ভাসিত হয়ে আছে। কোথাও পারস্য ইমেজ তো কোথাও তুর্কি চিত্রময়তা কিংবা কোথায় মধ্য এশীয় সমুন্নত রূপ। 

সমাধি সৌধ মূল কেন্দ্রে রেখে সমগ্র তাজমহল কমপ্লেক্স প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এতো মানুষের অংশগ্রহণ ও দীর্ঘ সময় ছাড়াও তাজের নির্মাণসামগ্রী ছিল বিশ্বসেরা উপাদানের তৈরি। নির্মাণ সামগ্রী আনাতে মানুষের পাশাপাশি হাজার হাজার হাতি ব্যবহৃত হয়। রাজস্থানের স্বচ্ছ আলো-প্রবাহী পাথর, পাঞ্জাবের মার্বেল ও রঙিন পাথর, চীন দেশের সবুজ রত্ন ও স্ফটিক, তিব্বতের ফিরোজা পাথর, আফগানিস্তানের নীলকান্তমণি, শ্রীলঙ্কার বর্ণময় পাথর ও রত্ন তাজমহলের নির্মাণের সময় সৌন্দর্য বিধানের কাজে ব্যবহার করা হয়। আর নির্মাণে খরচ করা হয় তৎকালীন সময়ের আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন রুপি, যা আজকের হিসাবে অকল্পনীয়ভাবে বিশাল অঙ্ক।    
তাজমহল নিয়ে ভাবালুতা ও আবেগ আসা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। নির্মম শাসক ও বহু নারীর স্বামী হয়েও যে প্রেমের প্রকাশ ঘটানো যায়, তাজমহল সে প্রমাণবহ। তাজমহল মুঘল নির্মাণশৈল্পী ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার বিশ্বজনীন নিদর্শনও বটে। প্রেম ও সৌন্দর্যে তাজ এতোই আকর্ষক যে ভারতের সিংহভাগ পর্যটকের প্রায়-সবাই এখানে আসেন, যাদের মধ্যে বিদেশিই বেশি। বৃষ্টির হাল্কা দাপটের মধ্যে আমরা যখন তাজমহল পরিদর্শন করি, তখনো পর্যটকদের কমতি ছিল না। অধিকাংশই ছিলেন বিদেশি এবং নানা বয়সের। 
সন্ধ্যার মুখে তাজ কমপ্লেক্স থেকে ফিরে আসার সময় বৃষ্টিভেজা মেঘলা আকাশের কারণে রাতের চন্দ্রালোকে তাজমহলের আরেক মায়াবী রূপ দেখার সুযোগ ঘটেনি। তাজমহলের মূল গম্বুজ আর চারটি মিনার ও কারুময় দেয়াল, খিলান, গম্বুজ, হর্ম্য, ঝালর থেকে পাশের যমুনা নদীতে জোছনা ছুঁয়ে চির শায়িত মমতাজ মহলের বিষাদ মিশে যাওয়ার ছবিটিও দেখা হলো না। বরং নিজের ভেতরে কেন যেন টের পাওয়া গেলো অন্য রকম অচেনা এক তরঙ্গ। উত্তর ভারতের ঐতিহাসিক বাতাসে ভেসে আসা সে তরঙ্গে হাহাকার নয়, প্রেম নয়, বেদনা নয়, আনন্দ নয়, মিলন নয়, ছিল অন্যরকম, অন্য কিছুর পরশ, যা এসে মিশে যাচ্ছিল হৃদয়ের মর্মমূলে, পাওয়া-না-পাওয়ার মাঝখানের গভীর শূন্যতায়।  

রাতের আগ্রায়
তাজমহল থেকে বের হয়ে অলিগলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে রাতের আগ্রার মুখোমুখি হলাম। পুরনো আগ্রার গিঞ্জি এলাকার ভিড়, রিকশার টুংটাং, মিনা বাজারের হৈচৈ ফেলে চলে এসেছি নগরীর আলো-শোভিত এভিনিউ-এ। মোবাইল অ্যাপে হোটেল বুক করা আছে, ড্রাইভার সুরজিৎ সেখানে ব্যাগ রেখে বিশ্রাম নিতে চলে গেলো। আমরা কাল সারাদিন ঘুরে রাতের মধ্যে জয়পুর ফিরে যাবো, এমন চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে। কাজটি ভুল হয়েছে। যে টাকায় আগ্রা-জয়পুর আপ-ডাউন করছি, তাতে জয়পুর-আগ্রা হয়ে দিল্লি চলে যাওয়া যেতো। রাস্তায় যেতে কষ্ট হবে ভেবে আমরা জয়পুর থেকে দিল্লির প্লেনের টিকেট কেটে রেখেছি। ফলে আমাদের জয়পুরই ফিরতে হচ্ছে। এতে সময় ও টাকা খরচ হলো বেশি। একই পথ দু’বার ঘুরতে হলো।
সবচেয়ে ভালো হতো, জয়পুর থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লি চলে যাওয়া। জয়পুর-আগ্রা-জয়পুরের খরচে জয়পুর-আগ্রা-দিল্লি যাতায়াত হয়ে যেতো। সময় যেমন বাঁচতো, তেমনি হোটেল আর জয়পুর-দিল্লির বিমান ভাড়াও লাগতো না। অভিজ্ঞতা না থাকার ভুলে সময় ও টাকার গচ্চা দিতেই হলো।
উত্তর ভারতে হোটেল বেশ সুলভ, কলকাতার চেয়েও কম টাকায় ভালো হোটেল পাওয়া যায় অ্যাপে। গাড়িও অ্যাপে নেওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে, টু ওয়ে, ঘণ্টা ধরে গাড়ি পাওয়া যায়। সুরজিৎ সার্বক্ষণিক থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ। সে গাড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলও। কাল আবার জার্নি করবে আর আমি হেঁটে শহরের জীবনকে স্পর্শ করতে চাই বলে ওকে বিদায় দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরতে শুরু করি। অবশ্য প্রয়োজন হলে ফোনে ডাকলেই সে ছুটে আসবে। আর আমাদের হোটেলের পাশেই কম দামের একটি হোটেলে সে উঠেছে। অতএব চিন্তার কিছু নেই।

ঘোরাঘুরির সময় খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটাও আমি ঝামেলাহীন রাখি। যেখানে সুবিধা হয় খেয়ে নিই। প্রধানত পাউরুটি, কলা, আপেল, ডিম সেদ্ধ, দুধ থেয়ে দিব্যি চলছে। রাতের দিকে ভারি ডিনার করবো ভেবে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম আগ্রার মূলকেন্দ্রে।
এতো বছরের পুরনো হলেও আগ্রা শহরের সর্বত্র ‘মুঘলাই রোশনাই’ ঝলমল করছে। চারিদিকে বাগান, উদ্যানের ছড়াছড়ি। আগ্রা ফোর্টের সামনে শাহজাহান গার্ডেন তো এলাহী ব্যাপার। আর আছে মোড়ে মোড়ে নেতৃবৃন্দের ভাস্কর্য। নেতাজী সুভাস বসুর মূর্তি পেলাম। পেলাম উত্তর ভারতের পুরনো হিন্দু শাসক পৃথ্বিরাজ চৌহানের মূর্তি। উত্তর প্রদেশ হিন্দু সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন বিজেপি’র শাসনে থাকায় হিন্দুত্ব পুনরুত্থানের বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মূখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় এসেই প্রাচীন নগর এলাহাবাদের নাম বদলে রেখেছেন প্রয়াগ। বিখ্যাত মুঘলসরাই রেলজংশন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নামও বদল করা হয়েছে। শুনতে পেলাম, আগ্রার নামও বদলে অগ্রবন রাখা হবে। কিন্তু ইতিহাসবিদ ও সুশীল সমাজ তা হতে দিচ্ছেন না। তারা অগ্রবন নামের অস্তিত্ব পাচ্ছেন না। বরং আগ্রা নামের মজবুত ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে। মুঘলদের আগে লোদি বংশও আগ্রায় অনেক স্থাপনা করেছে। আগ্রা সম্পূর্ণভাবে মুঘল ও মুঘল-পূর্ব মুসলিশ শাসকদের শহর। ফলে যোগী খানিক পিছিয়ে গেছেন।

আলোশোভিত, উদ্যানময় এভিনিউ ফেলে চলে এলাম আগ্রার বিখ্যাত জামে মসজিদে। বিরাট চত্বর, মিনার, গম্বুজ, ক্যালিগ্রাফিতে সমৃদ্ধ মসজিদটি চট করে দেখলে মধ্য এশীয় কোনও স্থাপনা বলে ভ্রম হবেই। পাথুরে কাঠামোতে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে। দেশি-বিদেশি পযটক-দর্শনার্থীদের ভিড় এখানেও দেখতে পাওয়া গেলো। 
মসজিদের পাশে আগ্রার বিখ্যাত পাইকারি বাজারগুলো অবস্থিত। চামড়ার জুতা, পোশাক, ধাতব তৈষজপত্র ইত্যাদিতে ঠাসা ছোট ছোট অসংখ্য দোকান। পুরনো ঢাকার চকবাজার বা লালবাগের মুঘল নগর বিন্যাসের আদল এখানেও লক্ষ্যণীয়। দোকানের মালামাল আর হরেক রকম ক্রেতায় ঠাসাঠাসি ভিড়। দামও আধুনিক মলের চেয়ে অনেক কম। সস্তায় মজাদার খাবারের অনেক হোটেলও পাওয়া গেল। কাবাব ও মাংসের প্রাধান্যে মুঘলাই রান্নার প্রাচুর্য হোটেলগুলোতে। 

অনেকেই আমাদের ইতিমুদ্দৌলাহ নামের একটি সমাধিস্থলে যেতে পরামর্শ দিলেন, যাকে শিশু তাজমহল বলা হয়। এটা দিল্লির হুমায়ূন মাকবারা আর সেকেন্দার আকবর মাকবার অনুরূপ। মাকবারা মানে সমাধিস্থল। মুঘলরা মধ্য এশীয় রীতিতে সমাধি সৌধ নির্মাণ করতেন, যার অনেকগুলো এখনো ভারতের নানা স্থানে অটুট। ইতিমুদ্দৌলা যমুনা নদীর পূর্ব পাশে অবস্থিত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ও মাতা আসমৎ বেগমের কবরগাহ। নূরজাহান নিজের অর্থে এই সুরম্য সৌধ নির্মাণ করেন। 
আরেকটি জায়গায় যাওয়ার জন্যও পরামর্শ ছিল। সেটার নাম মাহতাব বাগ, যার বাংলা হলো ‘চন্দ্রালোকিত বাগান’ (মুনলাইট গার্ডেন)। সম্রাট বাবুর এটি নির্মাণ করেন যমুনার অপর তীরে, যেখান থেকে ভিন্ন কৌণিক অ্যাঙ্গেলে তাজমহল ও আগ্রা দুর্গকে দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষত রাতে এবং জোছনায় মাহ্তাব বাগ থেকে তাজের অসামান্য সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নদীর জোছনা প্লাবিত স্তোতের পাশে শ্বেত মর্মর তাজের অনিন্দ্য অবয়ব দেখার জন্য মোহতাব বাগ শ্রেষ্ঠ স্থান।
বৃষ্টিমগ্ন আবহাওয়া এবং সময় স্বল্পতার কারণে এসব এবং আরও কিছু ছোট-খাট স্থাপনা, ঐতিহাসিক, দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব হলো না এবারে ভ্রমণে। মনে মনে ঠিক করলাম, এটা কেবল প্রাথমিক দেখা, ‘এ দেখাই শেষ দেখা নয়।’
না দেখার আফসোস আর যতটুকু দেখেছি, তার তৃপ্তি নিয়ে নগর পরিভ্রমণ শেষে হোটেলে ফিরে এলাম।আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেটি একটি বিশাল ও আধুনিক স্থাপনার তিনতলার পুরো ফ্লোর নিয়ে অবস্থিত। একতলায় দেখতে পেলাম কোচিং সেন্টার চলছে। বাইকে চেপে জিন্স আর টি-শার্ট চাপিয়ে শত শত ছেলেমেয়ে ক্লাসে আসছে, যাচ্ছে। সম্ভবত দিনে কোনও চাকরি করে প্রাইভেটে তারা পড়াশোনা করছে। ক্যারিয়ার আগে বাড়াতে এসব প্রতিযোগিতামূলক শহরে ডিগ্রি, ট্রেনিং নিয়েই চলতে হয়। আগ্রাতেও তেমন ধারা চলছে।

দিল্লি বা বেঙ্গালুরুর মতো নারীর নিরাপত্তাহীনতা আগ্রায় ততটা প্রকট মনে হলো না। রাত ১১/১২টা পযন্ত অনায়সে তরুণ-তরুণীরা নিজস্ব বাইকে চড়ে চলাফেরা করছে। দীপক রাঠোর নামে একটি ১৯/২০ বছরের ছেলে হোটেলে দেখা করতে এলো। আমাদের জয়পুরের বন্ধুর পরিচিত ছেলেটি কলেজে পড়ে এবং স্থানীয় ক্লাবে ক্রিকেটে খেলে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক খোঁজ-খবরই সে রাখে। সুস্বাস্থ্যবান দীপক ছাড়াও প্রতিটি ছেলেমেয়েকেই স্বাস্থ্য সচেতন মনে হলো। দীপকের বাইকে আশেপাশের এলাকায় এক চক্কর দিতে দিয়ে পথে পথে জিম দেখেছি অনেকগুলো। জীবনকে উপভোগ করতে হলে অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার মন্ত্র তরুণ প্রজন্মের চোখে-মুখে। নিজের কাজ অন্য কারো ভরসা ছাড়া নিজেকেই যে করতে হবে, এই কাণ্ডজ্ঞানটি আগ্রায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রকট। পথে পথে অলস আড্ডা, চা খেয়ে, সিগারেট ফুঁকে ফুটপাত দখল করতে বিশেস কাউকে দেখিনি। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত এবং সেটা অবশ্যই উদ্দেশ্যভিত্তিক, লাভজনক ও প্রয়োজনীয়। আর বিখ্যাত পযটক শহর বলে এখানে নানা কিসিমের কাজের কমতি নেই।

শুধু স্বাস্থ্য নয়, আগ্রায় বসবাস করতে আরেকটি জিনিস লাগবে, তা হলো মুঘল বাদশাহ হয়ে জন্মানোর ভাগ্য। বিরাট বিরাট বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি ও তকমাধারী স্থাপনা ছাড়াও আগ্রায় ছড়িয়ে আসে অসংখ্য রাজকীয় ঢঙের প্রাসাদ, বাড়ি-ঘর। ইংরেজ আমলে তৈরি রাজসিক ভবনও কম নয়। সম্ভবত এসব দেখেই কথাটি বলেছিলেন কবি ও অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু। যাদবপুরের অধ্যাপক বুদ্ধদেব এক চিঠিতে দার্শনিক দেবীপ্রসাদকে কথাটি জানিয়ে ছিলেন। সেই ভাষ্যটিই তুলে দিচ্ছি: 
“আমি এখন আগ্রায়। এসব শহরে বসবাস করতে হলে মুঘল বাদশাহ হয়েই জন্মাতে হয়। আগ্রা ফোর্টে জাহান আরার ঘরগুলো ভারি ভালো, ও-রকম বাড়িতে থাকতে পারলে তবেই এ-অঞ্চলে বসবাস সম্ভব। কিংবা তাজমহলের ভিতরটাও মন্দ নয়। এছাড়া আর ঠা-া জায়গা এখানে আছে বলে মনে হয় না। যে যুগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না, সে যুগে ও-ধরনের বিরাট কেল্লা গড়তেই হতো শাহানশাহদের, নয়তো প্রাণ কি বাঁচতো? স্নানের কী বিলাসিতা! শ্বেতপাথরের কী উদার মসৃণ শীতলতা! ইলেকট্রিসিটি থাকলে অত দরকার হতো না, এয়ার কন্ডিশন করে দিলেই হতো। তবু ওঁরা ওগুলো করেছিলেন বলেই আজ সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা একটু বুঝতে পারি যে ভারতবর্ষ এককালে সত্যিই ইংরেজ বর্জিত ছিল এবং ইংরেজ-বর্জিত সে ভারত তখনকার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের চাইতে কোনো অংশে ছোটও ছিল না। নবাবী আমলের সূর্যাস্তের সোনা এ অঞ্চলে চেখে বেড়াচ্ছি-পচে গেছে, কিন্তু একটা রূপ আছে।” 
১৯৪১ সালের ১০ অক্টোবর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে বুদ্ধদেব বসু চিঠিতে কথাগুলো বলেছিলেন। আগ্রায় শত শত বছরের প্রাচীন মুঘল ঐতিহ্যের অপসৃয়মান সেইসব স্থাপনার দ্যুতিময় রশ্মি এখনো চমকাচ্ছে।    

আগ্রা দূর্গে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
বৃষ্টির মধ্যে সকাল হলো আগ্রায়। ক’দিন ধরেই উত্তর ভারতে অবিরাম বর্ষণের রেশ থেমে থেমে চলছে। সকালের শুরুতে তাজমহলের দিকে এক চক্কর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেটা স্থগিত করতে হলো আবহাওয়ার বিরূপতায়। কিছুক্ষণ হোটেলে অপেক্ষার পর বৃষ্টি সহনীয় হলে চলে এলাম আগ্রা দুর্গে।
আগ্রা দুর্গ নামটি শুনে মনে হতে পারে পারে যে, এটি কোনও সামরিক ছাউনি বিশেষ। আসলে মোটেও তা নয়। আগ্রা দুর্গ হলো একটি আস্ত শহর। মুঘল সচিবালয়, বাসগৃহ, সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি মিলিয়ে পরিকল্পিত এক রাজধানী।
তাজমহল থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আগ্রা দুর্গের সামনে, রাস্তার আরেক পাশে শাহজাহান গার্ডেন। বিশাল মুঘল উদ্যান আর আগ্রা দুর্গের মাঝখান দিয়ে চলে গেলে বিশাল এভিনিউ। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা দুর্গ-নগরী।
৯৪ একক আয়তন বিশিষ্ট অতিকায় আগ্রা দুর্গে প্রবেশের জন্য দু’টি প্রবেশ তোরণ আছে। একটির নাম অমর সিং গেট, যাকে লাহোর গেটও বলা হয়।আরেকটি দিল্লি গেট, যা দুর্গের পশ্চিমাংশে অবস্থিত। বর্তমানে দিল্লি গেট বন্ধ আর একমাত্র প্রবেশ পথ হলো অমর সিং গেট। তবে দুর্গের আরও দু’টি ছোট আকারের প্রবেশ পথ আছে। দুর্গে অনেকটাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাসুট ব্রিগেডের সদর দফতর আগ্রা দুর্গের উত্তরাংশে অবস্থিত।   
আগ্রা দুর্গ হলো একমাত্র স্থান, যেখানের ভারতের সব শাসকরাই কর্তৃত্ব করেছে। আফগান-গজনির শাসকরা আগ্রায় প্রথমে সামরিক ছাউনি গড়েন এই দুর্গে। পরে চৌহান, রাজপুত, জাঠ, শিখরা এখানে কর্তৃত্ব করেন। দিল্লি দখল করে রাজধানী স্থাপন করা হলেও সিকান্দার লোদি পরবর্তীতে আগ্রায় রাজধানী নিয়ে আসেন ষোড়শ শতকে। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ী হয়ে বাবুরও এ দুর্গ থেকেই রাজত্ব করেন। পুত্র হুমায়ূনের রাজ-অভিষেকও আগ্রা দুর্গে সম্পন্ন হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন। তা হলো আগ্রা দুর্গের নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার কারিকরগণ, সঙ্গে ছিলেন গুজরাতের শ্রমিকরা।  

হুমায়ূনের শাসনামলে বাংলার আফগান-সুরি বংশ শের শাহের নেতৃত্বে ভারত দখল করে আগ্রা থেকে শাসন চালায়। পরে মুঘলরা আবার ভারতের ক্ষমতা দখল করলে আগ্রার দুর্গ হয় শাসনের মূল কেন্দ্র। আকবর আগ্রা দুর্গকে বিশাল আকারে নির্মাণ করেন। তিনি কিছুদিনের জন্য রাজধানী পাশের ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে গেলেও পরবর্তী শাসকরা আগ্রাকেই রাজধানী হিসাবে বেছে নেন। পরে রাজধানী কিছু দিনের জন্য লাহোর এবং পরে দিল্লি স্থানান্তরিত হলেও মুঘল শাসনে আগ্রার গৌরব, শক্তি ও ঐতিহ্য সমুন্নত ছিল। ফলে আগ্রা দুর্গের প্রতিটি বালি-কণা ও ইটে বহু বছরের বিচিত্র ইতিহাসের জানা-অজানা বহু কথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। 
আগ্রার দুর্গ একজনের হাতে নয়, অনেক মুঘল নৃপতির দ্বারা সংস্কার ও পরিবর্ধন লাভ করে। তবে আকবরের সময় এর সর্বোচ্চ বিকাশ হয়। তিনি রাজস্থানের লাল বেলে পাথর দিয়ে আগ্রা দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো স্থাপনা নির্মাণ করেন এবং সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে পুরো স্থাপনাকে পরিবেষ্টন করেন।     
আগ্রার দুর্গস্থ সমগ্র এলাকা অর্ধবৃত্তাকার ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে নির্মিত। প্রবেশ তোরণ থেকে শুরু করে দুর্গের প্রতিটি স্থাপনা অত্যন্ত সুনির্মিত ও কারুকাযময়। লাল বেলে পাথরের সঙ্গে সাদা মার্বেলের ব্যবহারও দুর্গটির বিশেষ নির্মাণ বৈশিষ্ট। ফলে ভাবগাম্ভীযপূর্ণ দুর্গের দিকে তাকালেই গা ছমছম করে। 

রাজকীয় মুঘলাই ফটক দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করে লালের সঙ্গে সবুজের মিতালিতে চোখ জুড়িয়ে গেল। সাজানো উদ্যান দুর্গের ভেতরে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মুঘলরা যেখানেই গেছেন, যে স্থাপনাই গড়েছে, তাতে বাগানের উপস্থিতি আবশ্যিক। হালকা বৃষ্টি থাকলেও দর্শনার্থীর ভিড় কম নেই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম মুঘল ঐতিহ্যের অনবদ্য আকর্ষণ আগ্রা দুর্গ।
দুর্গের ভেতরেও একটি গেট আছে, যাকে বলা হয় হাতি গেট। খুবই পরিকল্পিত স্থাপত্য বিন্যাস চারিদিকে। অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে কালের করাল গ্রাস থেকে সামান্যই রক্ষা পেয়েছে। শত শত যুদ্ধ, দাঙ্গা, বিশেষত দখলদার ইংরেজদের হাতে অনেক সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে। ভাঙা-গড়া হয়েছে ভেতরের অনেক ইরামত ও প্রাসাদ। মুঘল সম্রাটের অধিষ্ঠানের ময়ূর সিংহাসন আর কোহিনূর হীরক সম্পদও ইংরেজরা এখান থেকে লুট করে নিয়ে গেছে বিলাতে। সিপাহি বিপ্লবের পর বিজয়ী হয়ে ইংরেজরা শুধু গণহত্যাই করেনি, হীরা-জহরত, বই-পত্র, তৈজযপত্র, ব্যবহার সামগ্রী লুটে নিয়ে গেছে। ইংল্যান্ডের মিউজিয়াম, বাজার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় এসবের কিছু কিছু এখনো রয়েছে।

আগ্রা দুর্গের প্রধান আকর্ষণ দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জাহাঙ্গীর হৌস, যা আকবর নির্মাণ করিয়েছিলেন পুত্রের জন্য। বাবুরের আমলে নির্মিত বাওলি (পানির কূপ) আছে। আছে মসজিদ, আকবর মহল। সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত মহলও আছে, যাতে তার দুই কন্যা রওশান আরা ও জাহান আরা বসবাস করতেন।
আশর্চয হলাম, আগ্রার দুর্গে বাংলা মহল দেখে। কথিত আছে, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান এটি নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মাণশৈলীতে বাংলার কুটিরের ছাপ আছে। নূরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরিণত সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে ছিলেন বাংলার এক সবেদারের স্ত্রী। বাংলার সঙ্গে নূরজাহানের একটি সম্পর্ক ছিল। বাংলার আম গাছ তিনি আগ্রার দুর্গে রোপণ করেছিলেন এবং ঢাকাই মসলিন কাপড়ের উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।
দুর্গের যমুনা নদীমুখী একটি আবাসে সম্রাজ শাহজাহানের বন্দি জীবন কেটেছিল। এর বারান্দা থেকে দূরের তাজমহল দেখা যায়। বন্দি সম্রাটের জীবন কাটে এখান থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাজ দেখে আর তাজে শায়িত প্রিযতমা স্ত্রী মমতাজমহলের স্মৃতিতে।
আগ্রার দুর্গ নিয়ে প্রচলিত আছে বহু উপকথা ও কাহিনী। দুর্গের নিচে সুরঙ্গপথ নাকি নানা জায়গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ছিল অনেক গোপন কুঠরী, যেখানে সংকটকালে সম্রাট আত্মগোপন করতে পারতেন বা প্রতিপক্ষকে লোকচক্ষুর আড়ালে বন্দি করে রাখতে পারতেন।

মুঘল হেরেম নিয়ে শত শত উপাখ্যানের ভিত্তিভূমিও আগ্রার দুর্গ। যেখানে সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) ও আনারকলির করুণ প্রেম-উপাখ্যান ছাড়াও বহু বাদশাহজাদি ও শাহজাদার নানা ইতিবৃত্ত রয়েছে। বলতে গেলে মুঘল ইতিহাসের আখ্যান রচনা করতে গেলেই চলে আসে আগ্রা দুর্গের নাম। বিশ্বসেরা গোয়েন্দা শার্লক হোমস পযন্ত আগ্রা দুর্গের পটভূমিতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। শার্লক হোমসের রচয়িতা স্যার আর্থার কোনাল ডুয়েল ‘দ্য সাইন অব ফোর’ গ্রন্থটিতে আগ্রা দুর্গের পটভূমি নিয়ে এসেছেন। এমন আরও শত শত গ্রন্থ আছে আগ্রা দুর্গের সামগ্রিক বা বিশেষ বিশেষ ঘটনার আলোকে। স্থাপত্য ও নির্মাণ প্রকৌশলেও আগ্রা দুর্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। মধ্যযুগে বাগদাদ, দামেস্ক, ইস্পাহান, সিরাজ, কায়রোর মতোই আগ্রা ছিল এক আন্তজার্তিক শহর, যার প্রাণকেন্দ্র ছিল আগ্রা দুর্গকেন্দ্রিক রাজপ্রাসাদসমূহ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা।
বৃষ্টি কমে এক সময় হাল্কা রোদ ঝলক দেওয়ায় মনে হলো শত শত বছরের ঘুম ছেড়ে চমকে উঠেছে আগ্রা দুর্গের ভেতরের স্থাপনাগুলো। শুধু দর্শনীয় স্থান হিসাবে দুর্গের নানা স্থাপনা দেখতেই সময় কেটে যায়না, প্রতিটি স্থানের পেছনের ইতিহাস ও ইতিবৃত্তও সামনে চলে আসে হারিয়ে যাওয়া অশ্বধ্বনির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে।
সুদূর মধ্য এশীয় অঞ্চলের মোঙ্গল-তুর্ক-পারস্য ঐতিহ্য নিয়ে যে মুঘলরা ভারতে এসেছিলেন, তারা শাসন ও সংস্কৃতির প্রতিটি অঙ্গনকে করেছিলেন আলোকিত ও সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে আধুনিক জীবনবোধ ও যাপন প্রণালী মিলে আছে অর্ধ-সহস্র বছরের মুঘল শাসনের পরতে পরতে। তাদের প্রাসাদ, হর্ম্য, স্থাপনা, প্রশাসনিক রীতি, খাদ্য, পোষাক, লোকাচার, কাব্য, সঙ্গীত ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই ষুধু ভারত নয়, বিশ্ব সভ্যতা ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল রত্নস্বরূপ। সেই মুঘলদের নাভিমূল আগ্রার দূর্গে প্রতিটি পদক্ষেপে কানে বাজে ইতিহাসের শব্দ-ঝঙ্কার। অতীত পুরনো হলেও যে দীপ্তি হারায় না, মুঘল ঐতিহ্যের হৃৎপিণ্ড ও রাজধানী আগ্রা সে সত্যটিই মনে করিয়ে দেয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম রাজধানী আগ্রা 
আগ্রার দুর্গ থেকে বের হলাম পড়ন্ত বেলায়। অতীতের উজ্জ্বলতায় ঝলমল আগ্রা শহরের কথায় ইতিহাসের নানা কথা মনে পড়ে। যদিও বিশাল ভারতবর্ষের কথা আসলেই চলে আসে দিল্লির নাম, তথাপি দিল্লি নয়, অধিকাংশ সময় আগ্রা ছিল ভারতের রাজধানী। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের রাজধানী হিসাবে যেসব শহরের নাম জানা যায়, তার মধ্যে আগ্রা ছিল সুদীর্ঘকাল। দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রা ছাড়া অন্য কোনও শহর এতো অধিক বছর রাজধানীর মর্যাদা পায়নি।
মুসলিমরা ভারত জয় করে রাজধানী গড়েন দিল্লিতে। দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা ধরা মুহাম্মদ ঘোরীকে। দিল্লি সালতানাতের শাসনকালেরই এক পর্যায়ে আগ্রায় রাজধানী স্থাপন করা হয়, যেখানে কয়েক শত বছর আগে গজনীর সুলতান মাহমুদ দুর্গ গড়েছিলেন। আগ্রা থেকে উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ভারত শাসন ছিল সহজতর। এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে গমনের পথও ছিল সুগম। ফলে আগ্রা রাজধানী ও কেন্দ্রীয় শহরের মর্যাদা পায় রাজনৈতিক এবং ভূকৌশলগত গুরুত্বের কারণে। 

পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের মতোই মুঘলরাও ছিলেন প্রধানত আগ্রা কেন্দ্রীক। উপমহাদেশের নানা স্থানে নানা স্থাপনা, দুর্গ, প্রাসাদ নির্মাণ করলেও মুঘলদের মূল আবাস ছিল আগ্রা এবং শাসনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এই শহর। যদিও আকবর কিছুদিনের জন্য রাজধানী আগ্রার পাশে ফতেহপুর সিক্রিতে স্থানান্তরিত করেন, যা আসলের আগ্রারই সম্প্রসারিত এলাকা বিশেষ । গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য হলো এই যে, মাত্র একটি ছাড়া, মুঘলদের সবগুলো রাজধানীই বর্তমান ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্তিত। ভারতের বাইরে একমাত্র শহর পাকিস্তানের লাহোর, যেখানে সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় স্বল্পকালের জন্য। তারপর আগ্রা হয়ে দিল্লি হয়। ভারতের রাজধানী। তথাপি মুঘল ক্ষমতা ও স্থাপনার অন্যতম শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী কেন্দ্র ছিল আগ্রা ।

কলকাতায় ক্ষমতাসান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত দখল করে ইংরেজরা রাজধানী বানায় কলকাতায়। তারপর ১৯১৩ সালে আবার ভারতের রাজধানী হয় দিল্লি। এভাবে আগ্রার ক্ষমতা ও শক্তি লোপ পায়। তথাপি আগ্রার চেয়ে সুদীর্ঘ বছর রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার গৌরব ভারত বা সম দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কোনও দেশের অন্য কোনও শহরের নেই ।

শাহজাহান বাগিচা আর আগ্রা দুর্গের দিকে ফিরে আসার সময় পেছন তাকিয়ে দেখতে পেলাম, অপসৃয়মান সূর্যের রক্তিমাভায় আগ্রার লালাভ দুর্গ স্থাপনায় টকটক করছে। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে সূর্যের স্বচ্ছ আলো ছড়িয়েছে প্রাসাদ আর উদ্যান ঘেরা নগরী আগ্রার দিগন্তে। পায়ে পায়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে কানে বাজে রণধ্বনি, উৎসব আর হুল্লোড়ের কোলাহল। আগ্রার আশেপাশেই হয়েছে ভারতবর্ষে বিখ্যাত ও ভাগ্যনির্ণায়ক যুদ্ধগুলো। কাছেই মুহাম্মদ ঘোরী আজমিরের শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে ভারত অধিকার করেন। সন্নিকটের পানিপথে লোদি বংশকে পরাজিত করে বাবুর বসেন মসনদে। আকবর এই পানি পথেই হিমুকে হারিয়ে ভারতের ক্ষমতা সুসংহত করেন। আফগান আহমাদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা-শিখদের বিতারণ করেন। আগ্রাকে নাভিশূলে রেখেই মধ্যযুগের ভারতের ক্ষমতার পালাবদল আর বিন্যাস রচিত হয়েছে।

এতো যুদ্ধ ও দামামার মধ্যেও আগ্রাকে সাজানো হয়েছে সুরম্যভাবে। লোদি গার্ডেন, শাহজাহান গার্ডেন, মাহতাব বাগ ইত্যাদি বহু কিছু এখনো অটুট সবুজে-শ্যামলে। আর স্থাপনার তো শেষ নেই! ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া তাজমহল, ফতেহপুর সিক্রি, আগ্রা দুর্গ ছাড়াও শত শত মসজিদ, প্রাসাদ ছড়িয়ে আছে আগ্রায় ।

বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্তে আগ্রা লাভ করেছে স্বপ্নের শহরের মযাদা। শান-শওকত, আভিজাত্য, সমৃদ্ধিতে আগ্রাতে তুলনা করা হয়েছে ভেনিস, প্যারিসের সঙ্গে। আগ্রার নান্দনিক অবয়ব লোভনীয় হয়ে ধরা দিয়েছিল পৃিথিবীর মানুষের কাছে। আগ্রা দুর্গ পরিদর্শনের পর প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর কথা মনে পড়ে । কি নেই এই দুর্গে। একটি আস্ত শহর আড়াই-তিন মাইল জায়গা জুড়ে  সুপরিকল্পিতভাবে সজ্জিত করার কৃতিত্ব মুঘলদের। আবাস, রাজা, যুদ্ধ, বিনোদন ইত্যাদি সবই হয়েছে এখানে। খেলার মাঠ, হাতি বা বাঘের শীশ মহল, স্নানাগার, ও হাভেলিতে মশগুল আসার প্রবহমান আরব্য রজনীর মখমল কার্পেটে।

আগ্রা দুর্গের বাইরেও সাধারণদের বসবাসের জায়গায় মিনাবাজার, মসজিদ, প্রমোদালয়, বিশ্রামাগার, সরাইখানার অন্ত ছিল না। এখনো আগ্রার পথে পথে গম্বুজওয়ালা প্রহরী ছাউনির দেখা পাওয়া যায়, যা মুঘল নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হয়ে স্মৃতি-স্বরূপ বিরাজমান।

শুধু ইতিহাস আর ঐতিহ্যই নয়, কিংবা যুদ্ধ আর বিজয়ই নয়, আগ্রার উপর দিয়ে বয়ে গেছে মর্মান্তিক রক্তস্রোত। সিপাহি 

বিদ্রোহে মুঘল-ভারতীয় পক্ষ পরাজিত হলে দিল্লির মতো আগ্রাতেও বয়ে যায় রক্তের বন্যা। শুধু মুঘল পরিবারের সদস্যই নয়, মুসলিম সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ও সৈনিকদের গণহারে হত্যা করা হয়। দিল্লির পতন হলে বিপুল মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আগ্রা দুর্গে। তাদের ধরতে সশস্ত্র অভিযান ও গণহত্যা চালানো হয়।

এখনো আগ্রার পথে-প্রান্তরে, দুর্গের দেয়ালে কালচে রক্তের ছোপ মিশে আছে। নিহতের আহাজারি আর নিগৃহীত রমণীর বিলাপ গুমরে কাঁদে আগ্রায় । একটি প্রচলিত উপকথার বিষয়ে লোকমুখে শুনেছি। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরকে পরাজিত করে ইংরেজরা বন্দি বানিয়ে পাঠিয়ে দেয় সুদূর বার্মার রেঙ্গুনে। তার পরিবারের অনেককেই হত্যা করা হয় দিল্লিতে। দিল্লির হুমায়ূন মাকবারা বা কবরগাহে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা । সেই স্থান কাতার বন্দি করে মুঘল পরিবারের শত শত সদস্যকে হত্যা করে ইংরেজ সেনাপতি। আগ্রায় যারা লুকিয়ে এসেছিলেন, তাদেরকেও দুর্গের ভেতরে চিরুনি তল্লাশি করে খুঁজে বের করে মারা হয়। 'আজও নাকি সেসব নিহত আত্মা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আগ্রা দুর্গে ফিরে আসে। অনেকেই দুর্গের অভ্যন্তরে, খিলান ও স্তম্ভের পাশে নারী ও শিশুদের কান্না শুনতে পান।

এইসব কাহিনীর সত্যাসত্য যাচাই করা দুরূহ। কিন্তু যে বীভৎসতা এ নগরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সাজানো-সুন্দর শহরকে ছারখার শ্মশানে পরিণত করার কষ্ট শুধু মানবতার কষ্ট নয়, সভ্যতার জন্যও বেদনার। আগ্রা এখনও বেঁচে আছে মৃত্যুর বিষাদ নিয়ে। সঙ্গে আছে সভ্যতার এমন বহু চিহ্ন, যা ধ্বংস ও আক্রমণের কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মুঘল সভ্যতার জয়গান গাইছে।

আবার ফিরে যাবো জয়পুরে, সেখান থেকে দিল্লি। ভ্রমণ পরিকল্পনায় ভুল করায় এখান থেকে সহজে দিল্লি যাওয়ার বদলে আবার জয়পুর হয়ে দিল্লি যেতে হচ্ছে। ফেরার পথে গাড়িতে একে একে চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল তাজমহল, অসংখ্য বাগিচা, স্থাপনা, আগ্রা দুর্গের মজবুত দেয়াল, ফতেহপুর সিক্রির আবছা কাঠামো, যা প্রমাণ করে এই সত্য যে, ধ্বংস করলেই সব শেষ হয় না; হত্যা করলেও সবকিছুর অবসান ঘটানো যায় না। সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে নিষ্পেষিত হয়েও শত বছরের মুঘল ঐতিহ্য ঠিকই মাথা উঁচিয়ে আছে সারা ভারতে, দক্ষিণ এশিয়ায়, সমগ্র বিশ্বে। বিশ্বসভ্যতার অংশ হয়ে বিশ্বসাংস্কৃতিক গৌরব বৃদ্ধি করছে মুঘল ঐতিহ্য। আর প্রতিনিয়ত শাসক ও শোষকদের সামনে হাজির করছে, ইতিহাসের সেই শিক্ষা, যে শিক্ষা স্বৈরাচারীরা কখনোই গ্রহণ করে না। এটাও এক অমোঘ ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় বিষয়, ইতিহাস শিক্ষা দিলেও ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তবু ইতিহাস শিক্ষা দিয়েই যাচ্ছে। একদার মুঘল রাজধানী সুরম্য আগ্রা নগরী ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে নিজেকে রক্ষা করে তেমনই এক ইতিহাসের শিক্ষালয় হয়ে আছে। আগ্রা, জীবন্ত ইতিহাস বইয়ের মতো ইতিহাসের কঠিন অধ্যায়গুলোর শিক্ষা বিতরণ করছে আজ এবং আগামীর পৃথিবীকে ।
 

ঈদ আনন্দ ২০২৩ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ আনন্দ ২০২৩ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status