ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

একজন ‘কারিগরের’ ধমক এবং...

শিহাব শাকির, সাবেক স্পোর্টস রিপোর্টার, মানবজমিন
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

নিজের লেখা প্রথম কোনো খবরের কাগজে দেখেছিলাম দৈনিক মানবজমিনে। ছাপার হরফে নিজের লেখা দেখে প্রসব বেদনা কাটিয়ে ওঠা জননীর সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মুখ দেখার অবর্ণনীয় আনন্দ পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে দীর্ঘ অর্ধযুগ ছোট ছোট বাক্যে, কম ভুলে, মেদহীন ও বাহুল্যবর্জিত ঝরঝরে লেখার শিক্ষা হাতে-কলমে পেয়েছি প্রিয় এ পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে। আর এর দীক্ষাগুরু হিসেবে, নিয়ামক হিসেবে ছিলেন প্রতিথযশা সাংবাদিক, জীবন্ত কিংবদন্তি মতিউর রহমান চৌধুরী।
‘দৈনিক মানবজমিন’ আমার জন্য তারুণ্যের শুরুতে বালিকা মেয়ের উদ্দাম আবেগী নিরেট ভালোবাসার মতো। যতটুকু ভালোবেসেছি তারচেয়ে বহুগুণ ভালোবাসা মানবজমিনের কাছ থেকে পেয়েছি। ফলে দীর্ঘদিন পত্রিকা থেকে শারীরিক ইন্তেকাল (স্থানান্তর) হলেও মানসিকভাবে তারুণ্যের প্রথম প্রেমের মতো এখনো আমার হৃদয়ে সেঁটে আছে মানবজমিনের সঙ্গে। মনে গেঁথে আছে কাওরান বাজারের জেনিথ টাওয়ারের ছবি। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের 
মতো মানবজমিন ও মতিউর রহমান চৌধুরী। একটাকে আলাদা করলে অন্যটির অস্তিত্ব ভাবা যায় না। সাংবাদিক মহলে যিনি ‘মতি ভাই’ বলে সুপরিচিত।
মিডিয়া পাড়ায় ‘সাংবাদিক তৈরির কারখানা’ বলে পরিচিত দৈনিক মানবজমিন।

বিজ্ঞাপন
বর্তমানে বাংলাদেশের খুব কম মিডিয়া হাউজ আছে যেখানে মানবজমিনের ‘প্রোডাক্ট’ নেই। প্রতিথযশা সাংবাদিক ও কলামিস্ট জন্ম দিয়েছে এ পত্রিকাটি। কীভাবে খবর বাছাই করতে হয়, কীভাবে লিখতে হয় এবং কীভাবে লেখাকে সমৃদ্ধ করে একজন সাংবাদিক ভবিষ্যতে আরও ভালো লেখার প্রেরণা ও সাহস পান তার কিছু দৃষ্টান্ত আমার মানবজমিনকালীন জীবনে ঘটেছে বহুবার।
২০১৬ সাল। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ইউরোপের সবচেয়ে বড় আসর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হতে তখনো প্রায় মাসখানেক বাকি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর  ফুটবলের প্রভাব নিয়ে লিখছে বৃটিশ ও ইউরোপিয়ান মিডিয়াগুলো। স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে সেগুলো আমিও লিখছি। মানবজমিনে প্রকাশিত হচ্ছে। মতি ভাই তখন ইংল্যান্ডে। সেখানে বসে মাঝেমধ্যে বৃটিশ মিডিয়ার নানা ধরনের খবর ও রিপোর্টের লিংক পাঠিয়ে আমাদেরকে অনুবাদের দিকনির্দেশনা দেন। আন্তর্জাতিক বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক আবুল হোসেন ভাইকে তেমনই কোনো একটি ফিচারের লিংক পাঠিয়ে অনুবাদ করতে বললেন। লেখাটিকে সমৃদ্ধ করতে খেলাধুলা বিষয়ক তথ্যগুলো আমার কাছ থেকে জেনে নেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। আবুল হোসেন ভাই আমার টেবিলে এসে অনেকক্ষণ বসে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও ক্লাব ফুটবলের অনেক তথ্য নোট করে নিয়ে গেলেন। লেখাটি শেষ করে মতি ভাইকে মেইল করলেন। পুরোটা পড়ে তিনি খুব রাগ করলেন। ভুল তথ্য দিয়ে লেখা হয়েছে জানিয়ে তিনি আবুল হোসেন ভাইয়ের ওপর ক্ষেপে গেলেন। ফুটবলীয় তথ্যগুলো কার কাছ থেকে নিয়েছেন তা জানতে চাইলেন। আবুল হোসেন ভাই আমার কথা জানালেন। মতি ভাই লন্ডন থেকে একটু পরে আমাকে কল করলেন। রিসিভ করেই তার ঝাঁঝালো কণ্ঠ পেলাম। রাগতস্বরে যা বললেন তা অনেকটা এমন- ঠিকঠাক না জেনে কেন তথ্য দেন? ভুল তথ্য কেন দেন? আপনি এসব কোথায় পেয়েছেন? এরপর স্বভাবসুলভ বাক্য- আপনাকে চাকরি কে দিয়েছে? আমি শুধু শুনে গেলাম। কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। কল কেটে দিলেন হুট করে। ফোনের রিসিভার মুঠো করে আমি হতবিহ্বল। স্থানুর মতো বসে আছি। পলকহীন দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে। চোখ লাল হয়ে উঠেছে। আবুল হোসেন ভাই বিষয়টি আঁচ করতে পারলেন। নিজ আসন ছেড়ে আমার কাছে এসে সান্ত্বনা দিলেন। দু’জনে মিলে ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্যগুলো আবার মিলালাম। ভুল নেই। লেখায় ঠিক তথ্যই দেয়া হয়েছে। কোথায় ভুল হয়েছে বুঝতে পারছি না। পুরো অফিস টাইম গোমড়ামুখে কাজ করে গেলাম। মাথার ভেতরে একটাই প্রশ্ন- ভুলটা কোথায় করলাম। শুধরাতে হবে তো! কিন্তু পাচ্ছি না। অফিস থেকে ফিরে দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম নির্বিঘ্ন হলো না। সকালে লাল চোখ নিয়ে অফিসে ঢুকলাম নির্ধারিত সময়ের ১০-১৫ মিনিট পরে। কাঁচের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকতেই রিসিপশনের ফেরদৌসী আপা হৈ হৈ করে উঠলেন। জানালেন, ঠিক ৯টায় মতি ভাই অফিসের ফোনে কল দিয়ে আমার খবর নিয়েছেন! আমাকে কল করতে বলেছেন। আতঙ্কিত আমি। গতকালের অমন ঘটনার পর আজ অফিসে বিলম্ব! ঠিক সময়ে অফিসে পেলেন না! খারাপ কিছু ঘটবার শঙ্কায় চেহারা পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। নিজ আসনে বসে দুরুদুরু বুকে মতি ভাইকে লাইন দিতে বললাম। রিসিভ হলো। অপরপ্রান্তে নরম কোমল কণ্ঠ। মতি ভাই। প্রথম শব্দটি ছিল, ‘স্যরি।’ সংক্ষেপে যা বললেন তা অনেকটা এমন, ‘স্যরি, শিহাব। গতকাল আপনার তথ্য ঠিক ছিল। অন্য একটি ভুল তথ্যের কারণে আপনাকে অযথা বকলাম। মনে কিছু করবেন না। ঠিক আছে আপনি কাজ করেন।’
তার কথার মাঝে আমি অস্ফুট স্বরে শুধু একবার বলতে পেরেছিলাম, ‘না ভাইয়া, ঠিক আছে।’ তখন আমি আর কিছু বলতে পারিনি। এবারও নির্বাক। চোখে পানি। ঠোঁটে-মুখে বিরাট এক প্রাপ্তির হাসি। আনন্দে মিটিমিটি হাসছি। ভাবছি, এক মহান সাংবাদিক ও দরদী অভিভাবকের কথা। একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মীকে এভাবেও ‘স্যরি’ বলা যায়! দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কতো বড় মন, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বচ্ছ হৃদয় থাকলে এমন করা যায়। বুঝলাম, কেন তিনি সাংবাদিক তৈরির কারিগর, কেন তিনি সবার অভিভাবক, কেন তিনি প্রিয় মতি ভাই, কেন তিনি সততা ও আচরণে অনন্য দৃষ্টান্ত। মানবজমিনের অর্ধযুগের জীবনে কখনো তাকে “আপনি” শব্দ ছাড়া সম্বোধন করতে শুনিনি। আকুণ্ঠ চিত্তে ভালো লেখার প্রশংসা করতে দেখেছি তাকে। ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার রোনালদিনহোর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল বৃটিশ ট্যাবলয়েড ‘ডেইলি মেইল’। সেটা নিয়ে আমি একটি সাক্ষাৎকারধর্মী ফিচার করেছিলাম। যাতে কৈশোরেই রোনালদিনহোর যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। খেলার পাতার প্রায় অর্ধেক জুড়ে সেটা ছেপে আমাকে গর্বিত করেছিলের স্পোর্টসের বিভাগীয় সম্পাদক তালহা বিন নজরুল। সেদিন সন্ধ্যায় নিবিষ্ট মনে কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে কী বোর্ড চেপে চলেছি। হঠাৎ পেছন থেকে মতি ভাইয়ের কণ্ঠ- এই তালহা, এটা কে লিখেছে? পেছনে ফিরে দেখি মতি ভাইয়ের হাতে খোলা পত্রিকা। রোনালদিনহোকে নিয়ে আমার লেখাটি ইঙ্গিত করছেন। লেখায় ভুল হয়েছে ভেবে প্রমাদ গুনলাম! স্পোর্টস বিভাগের সবাই তখন দাঁড়িয়ে। তালহা ভাই আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন- শিহাব। গলা শুকিয়ে আসার দশা তখন। কিন্তু মুহূর্তে আমার ধারণা পাল্টে দিলেন মতি ভাই। বিভাগীয় সম্পাদককে বললেন, ‘আরে, এই লেখাগুলো বাই নেমে ছাপেন না কেন? নাম দেবেন।’ এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শিহাব, আপনি ভালো লিখেছেন। পাঠক এমন লেখা পড়তে চায়। লিখেন।’
মতি ভাইয়ের এ স্বীকৃতি আমাকে ভালো লেখার প্রেরণা যুগায় এখনো। একজন মতিউর রহমান চৌধুরী বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাংবাদিক হয়ে সাংবাদিক তৈরির কারিগর হয়ে উঠেছেন এভাবেই। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে ২৫টি বছর পার করে ফেলেছে প্রিয় মানবজমিন। একটি পত্রিকার সাফল্যগাঁথা গাইতে গেলে এরচেয়ে বেশি কিছু দরকার হয় না। রজতজয়ন্তীতে  ‘ছোট মরিচের ঝাল বেশি’ খ্যাত প্রিয় মানবজমিনের জন্য শুভকামনা ও নিরন্তর ভালোবাসা রইলো। সবার প্রিয় মতি ভাইয়ের সুস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status